Sponsor



Slider

বিশ্ব

জাতীয়

সাম্প্রতিক খবর


খেলাধুলা

বিনোদন

ফিচার

mujib

w

যাবতীয় খবর

জিওগ্রাফিক্যাল

ফেসবুকে মুজিবনগর খবর

» » উজ্জ্বল রেডিয়ামের আবিষ্কারক বিজ্ঞানী মাদাম কুরি অবিশ্বাস্য সাফল্যে




>মাদাম কুরি বা মারি স্ক্লদোভস্কা কুরি (জন্মনাম মারিয়া সালোমিয়া স্ক্লদোভস্কা, ৭ নভেম্বর ১৮৬৭ – ৪ জুলাই ১৯৩৪) ছিলেন একজন পোলিশ এবং প্রাকৃতায়িত-ফরাসি পদার্থবিদ এবং রসায়নবিদ, যিনি তেজস্ক্রিয়তার উপর বিশ শতকে অগ্রণী গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন। তিনি নোবেল পুরস্কার অর্জনকারী প্রথম নারী ব্যক্তিত্ব ব্যক্তি এবং দু’বার নোবেল বিজয়ী একমাত্র নারী আর দুটি ভিন্ন বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার অর্জনকারী একমাত্র ব্যক্তি। তিনি পাঁচটি নোবেল পুরষ্কার অর্জনকারী কুরি পরিবারের উত্তরাধিকার ছিলেন। তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হওয়া প্রথম নারীও ছিলেন এবং ১৯৯৫ সালে প্যারিসের প্যানথনে তাঁর নিজের যোগ্যতায় সমাহিত হওয়া প্রথম নারী ছিলেন।

প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাড়ির একতলায় স্যাতসেঁতে একটি ঘর তাঁদের ল্যাবরেটরি। না আছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপতি, না উপযুক্ত কাজের পরিবেশ। তারই মধ্যে গবেষণা চলেছে এক বিজ্ঞানী দম্পতির, এক মৌল আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠেছেন তারা। একদিন অনেক রাত পর্যন্ত গবেষণার পর ঘর বন্ধ করে চলে গিয়েছেন। একটি টেস্ট টিউবের মধ্যে রেখে গিয়েছেন ‘পিচব্লেন্ড’ খনিজ থেকে পাওয়া একটি পদার্থ। পর দিন সকালে ঘর খুলতেই দেখেন, টেস্ট টিউবের ভিতর থেকে এক আশ্চর্য নীলাভ আলো ঠিকরে বেরচ্ছে। সেই আলো আভা ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরে। উত্তেজনায় পরস্পর হাত চেপে ধরলেন দুই বিজ্ঞানী। 

টেস্ট টিউব থেকে বেরনো ওই আলো আসছে এক অজ্ঞাত মৌল থেকে। দুই বিজ্ঞানী তার নাম দিলেন ‘রেডিয়াম’। বিশ্ববিখ্যাত ওই বিজ্ঞানী দম্পতির নাম মাদাম মারি কুরি এবং পিয়ের কুরি। রেডিয়াম আবিষ্কারের জন্যে দু’জনেই ১৯০৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে যৌথভাবে ওই পুরস্কার পান ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকারেল, ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয় ধর্ম আবিষ্কারের জন্যে। বেকারেলের গবেষণা রেডিয়াম আবিষ্কারের সূত্র সন্ধানে কুরিদের সাহায্য করেছিল।

মারি কুরি, মাদাম কুরি নামেই যিনি বিখ্যাত, পিয়ের কুরির সঙ্গে বিয়ের আগে তার পদবি ছিল স্কুলদোভস্কা। পোল্যান্ডের মানুষ তিনি। ওই দেশের রাজধানী ওয়ারশতে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট এই মেয়েটির আদরের ডাকনাম ছিল মারিয়া। বাবা-মা দু জনেই ছিলেন স্কুলশিক্ষক। বাবা পড়াতেন অঙ্ক আর বিজ্ঞান। এ দুটি বিষয়ে মারিয়ার প্রথম পাঠ বাবার কাছ থেকেই। খুব ছেলেবেলা থেকেই বই পড়ায় অসম্ভব ঝোঁক ছিল মারিয়ার। পাছে বই-পোকা হয়ে পড়ে, সেই ভয়ে মা জোর করে দুই বড় বোনের সঙ্গে তাকে খেলতে পাঠাতেন। এই পড়ার নেশাই পরবর্তিকালে অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে বড় বিজ্ঞানী হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে।

মারিয়াদের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। তাই মাধ্যমিক স্তর পাশ করেই ভাইবোনেদের কাজের চেষ্টা করতে হয়। সেই কাজ হলো ধনীদের বাড়িতে ছেলেমেয়ে পড়ানো। জিমনাশিয়াম অর্থাৎ উচ্চ বিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পান মারি স্ক্লদোভস্কা। দিদি ব্রনিয়াও খুব ভাল ফল করেন। কিন্তু তাতে কী? সে সময় রাশিয়ার জার-শাসিত পোল্যান্ডে মেয়েদের উচ্চতর শিক্ষার অধিকার ছিল না। স্কুল-কলেজে মাতৃভাষা হিসেবে পড়ানো হত ‘রাশিয়ান’। পোল্যান্ডের নিজস্ব ‘পোলিশ’ ছিল নেহাতই বিদেশি ভাষা। এ নিয়ে মারিদের মনে জমে উঠেছিল অসহনীয় ক্ষোভ, কিন্তু তা প্রকাশ করার উপায় ছিল না। ক্লাসে রুশ ইনস্পেক্টর এসে প্রশ্ন করলে মারি রুশ ভাষায় চটপট উত্তর দিতেন, কিন্তু ইনস্পেক্টর ঘর থেকে বেরনো মাত্র রাগে দুঃখে জল এসে যেত চোখে, হয়তো এভাবেই ছোট্ট মেয়েটির মনে জন্ম নিয়েছিল এক অপরিসীম জেদ। এই ব্যবস্থার নিগড় ভেঙে বেরতেই হবে, পোল্যান্ড ছেড়ে যেতে হবে প্যারিস, যেখানে উচ্চতর পড়াশোনা করে বড় হতেই হবে। 

উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে পড়তেই মারি ও ব্রনিয়ার মনে এই স্বপ্ন বাসা বাঁধে। দু জনেই ‘গভর্নেস’ অর্থাৎ গৃহশিক্ষিকার কাজ করে একটু একটু করে পয়সা জমাতে থাকেন। কিন্তু যখন দেখা গেল, সেই পয়সায় দু’জনের পক্ষে প্যারিস গিয়ে কলেজে ভর্তি হওয়া সম্ভব নয়, তখন মারি তার সঞ্চয়ের অর্থ তুলে দেন ব্রনিয়ার হাতে। উদ্দেশ্য, ব্রনিয়া ডাক্তারি পাশ করে ফিরে এসে সংসারের দায়িত্ব নেবেন, তারপর মারি যাবেন প্যারিস।

এর পর কয়েকটা বছর চলে কঠোর সংগ্রাম। বিভিন্ন ধনী পরিবারে গভর্নেসের চাকরি করেন মেয়াদি চুক্তিতে। এরই মধ্যে অবসর সময়ে চলছিল বিজ্ঞানের পড়াশোনা। হাতে যে বই পেতেন, পড়ে ফেলতেন। এভাবেই বিজ্ঞানে মারির আগ্রহ দিন দিন বাড়তে থাকে। সে সময় পোল্যান্ডে কেবল পোলিশ মেয়েদের উচ্চশিক্ষা দেওয়ার জন্যে ‘ফ্লাইং ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি ভ্রাম্যমাণ বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছিল, খানিকটা লুকিয়ে-চুরিয়েই মারি সেখানেও ক্লাস করতেন সুযোগ পেলেই। এমনকী, এক আত্মীয়ের সহায়তায় প্রথম ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করারও সুযোগ পেয়ে যান, সেটি ছিল ওয়ারশতে ‘মিউজিয়াম অব ইন্ডাষ্ট্রি অ্যান্ড এগ্রিকালচার’-এর গবেষণাগার। আত্মীয়টি চাকরি করতেন ওই প্রতিষ্ঠানে। এভাবেই বিজ্ঞানের চর্চা ও সাধনার বীজ লালিত, অঙ্কুরিত হচ্ছিল সংকল্পে কঠিন এক তরুণীর মনে। সে ছিল এক স্বপ্ন সফল করার লক্ষ্যে কঠোর প্রস্তুতি।

বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চের অনূদিত মারি কুরির জীবনী

অবশেষে একদিন এল সেই স্বপ্নপূরণের ডাক। ব্রনিয়া স্নাতক হয়ে এক ডাক্তারকে বিয়ে করে প্যারিসেই থিতু হলেন। বোনকে বললেন, তাঁর কাছে থেকে পড়াশোনা চালাতে। মারি দোস্কা প্যারিস রওনা হলেন ১৮৯১ সালের নভেম্বরে। তার বয়স তখন ২৪। এর পর তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি।

প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন মারি। প্রথমে পদার্থবিদ্যা এবং তারপর গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে শুরু হলো কঠোর পরিশ্রম। দুটি বিষয়ে ডিগ্রি পাওয়ার জন্যে অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ খাটতে হত। গোড়ার দিকে প্রতি সন্ধ্যায় শহরতলিতে দিদির বাসায় যেতেন শুধু রাতের খাবারটুকু খেয়ে ঘুমনোর জন্যে। তাতে সময় নষ্ট হচ্ছিল। তাই শহরে দরিদ্রদের আবাসস্থল ‘ল্যাটিন কোয়ার্টার’-এ একটি চিলেকোঠার ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে আরম্ভ করলেন। সারা দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, তারপর ক্লান্ত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে প্রায় আসবাবহীন স্বল্পালোকিত ঘরটিতে পৌছে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা। ভাল করে খাবারও জুটত না। কোনও দিন শুধু রুটি-মাখন, কখনও বা এক ব্যাগ চেরিফল নিয়ে ঘরে ঢুকতেন, তা চিবতে চিবতে চলত লেখাপড়া। মাঝেমধ্যে এক-আধটা ডিম, কিন্তু সে তো প্রায় বিলাসিতা। শীত ঠেকানোর জন্যে উপযুক্ত পোশাক-আশাকও ছিল না। ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ল। অসুখেও পড়লেন কয়েক বার। কিন্তু কিছুতেই হার মানার পাত্রী ছিলেন না মারি স্ক্লদোভস্কা।

এই হার-না-মানা মানসিকতাই শেষ পর্যন্ত তাকে এনে দিয়েছিল বিশ্বের প্রথম মহিলা নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হওয়ার দুর্লভ সম্মান। মারি পদার্থবিদ্যায় ডিগ্রি পান, পরীক্ষায় একেবারে প্রথম হয়ে। মজার কথা হলো, বিদেশে সেই সাফল্যের জন্যে পোল্যান্ডের ‘আলেকজান্দ্রোভিকে ফাউন্ডেশন’ তাকে বৃত্তি দেয়। সেই বৃত্তির অর্থ পরে তিনি অবশ্য ফেরত দিয়ে ফাউন্ডেশনকে জানিয়েছিলেন, টাকাটা তিনি ঋণ হিসেবেই ধরেছেন, এখন ফেরত দিচ্ছেন, যদি কোনও দরিদ্র মেধাবী ছাত্রের কাজে লাগে। একই মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি রেডিয়াম আবিষ্কারের পর তার পেটেন্ট না নিয়ে।

কয়েক মাস পরে গণিতেও ভালভাবে এম এ পাশ করেন মারি। এর পরই ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার লক্ষ্যে শুরু হয় গবেষণা। প্রথমে বিভিন্ন ধরনের ইস্পাতের চৌম্বক ধর্ম নিয়ে। পরে তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় রেডিয়াম। তিনি লক্ষ করলেন, ইউরেনিয়ামের খনিজ ‘পিচব্লেন্ড’ থেকে যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হচ্ছে, তার মাত্রা খোদ ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার তুলনায় অনেক বেশি। তা হলে কি পিচব্লেন্ডের মধ্যে অন্য কোনও অজ্ঞাত তেজস্ক্রিয় মৌল আছে? চলল নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা। ল্যাবরেটরি বলতে একটি বাড়ির একতলার এক ঘুপচি ঘর, পরে কাঠের তৈরি একটি পরিত্যক্ত শেড, যার ফুটোফাটা ছাদ থেকে এখানে-ওখানে জল পড়ত বর্ষায়। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এর চেয়ে ভাল গবেষণার সুযোগ তাকে দেয়নি। ওই কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবও ছিল প্রচণ্ড। সমস্ত প্রতিবন্ধকতাই তিনি জয় করেছিলেন স্বামীর একনিষ্ঠ সহযোগিতায়। প্রায় চার বছর ধরে উদয়াস্ত গবেষণা ও পরিশ্রমের ফল মিলল এক দিন। আবিষ্কৃত হল দুটি নতুন মৌল। প্রথমে পোলোনিয়াম,তারপর রেডিয়াম। দুইয়েরই তেজস্ক্রিয়তা ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি। রেডিয়াম আবিষ্কারের ওপরেই ‘থিসিস’ লিখে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট হলেন মারি। এর পর বিশুদ্ধ পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম নিষ্কাশন এবং তার ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম নির্ণয়ের জন্যে মাদাম কুরি দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার পান ১৯১১ সালে। সে বার রসায়নে এবং এককভাবে। তার কয়েক বছর আগেই ১৯০৬ সালে স্বামী পিয়ের কুরি মারা যান এক পথ দুর্ঘটনায়।

পিয়ের কুরিও ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণির বিজ্ঞানী। কেলাসের চরিত্র এবং চৌম্বকত্বের ওপর বিশ্বমানের কাজের জন্যে বিয়ের আগেই বিজ্ঞানী মহলে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। চৌম্বকত্ব নিয়ে কাজের সূত্রেই মারি স্লদোভস্কার সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ, তারপর প্রেম এবং বিয়ে। তাদের দুটি কন্যাসন্তানও হয়েছিল। এক কন্যা আইরিন কুরি, তাঁর স্বামী ফ্রেডারিক জুলিও কুরির সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারও পান। একটি পরিবার থেকে এত জনের নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।  জীবনে আঘাতও কম পাননি মাদাম কুরি। মাত্র ১০ বছর বয়েসে মাকে হারান। আর ৩৯ বছর বয়েসে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু তাকে একেবারে টলিয়ে দিয়েছিল। দাম্পত্য ও কাজের জীবনে দু জনেই দু জনে আদর্শ পরিপূরক ছিলেন। কিন্তু সব ধাক্কা সামলে ফের গবেষণার জগতে ফিরে এসেছিলেন মারি। অবিরাম তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে শেষ পর্যন্ত তিনি লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হন। ১৯৩৪ সালে তাতেই তার মৃত্যু ঘটে। বলা যায় রেডিয়ামের জন্যেই জীবন দিয়েছিলেন মাদাম কুরি। কেবল রেডিয়াম আবিষ্কারই নয়, বিশ শতকের প্রথম দিকে এক নারীর অবিশ্বাস্য সংগ্রাম ও সাফল্যের নিরিখেও তার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন।[১]

h3>তথ্যসূত্র

১. বিমল বসু, বিজ্ঞানে অগ্রপথিক, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ মে ২০১৬, পৃষ্ঠা ১৬১-১৬৪।






«
Next
Newer Post
»
Previous
Older Post

No comments:

Leave a Reply