চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতার পেছনে পশ্চিমাদের দায় কতটা
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামসহ অস্থিরতা বিরাজ করছে দেশে দেশে। চরম গ্যাস সংকটে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। তার আঁচ পড়েছে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপরও। ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্বজুড়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার জন্য পশ্চিমারা রাশিয়াকে দায়ী করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতার পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে পশ্চিমাদের।
ন্যাটোর উসকানিতেই যুদ্ধের সূত্রপাত
রাশিয়ার ‘আগ্রাসন’ থেকে বাঁচাতে নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়েই মূলত ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সূত্রপাত। রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ না করার বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের সময় পশ্চিমারা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা থেকে সরে আসে তারা। রুশ সীমান্তবর্তী ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ন্যাটোতে যোগদানের আহ্বান জানালে তাতে আপত্তি জানায় রাশিয়া।
এর জেরেই গেল ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া, পরে যা যুদ্ধে রূপ নেয়। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংঘাত উসকে দিয়ে এখন রাশিয়ার ওপর দায় চাপাতে বিভিন্নভাবে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো।
শান্তির বার্তার আড়ালে রমরমা অস্ত্র ব্যবসা
ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের রসদ জোগাচ্ছে পশ্চিমারা। নিজেরা সরাসরি সংঘাতে না জড়ালেও অস্ত্র সরবরাহের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো পক্ষান্তরে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে বলে মনে করছে রাশিয়া। অন্যদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, মুখে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও মানবতার কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে নিজেদের রমরমা অস্ত্র ব্যবসার স্বার্থে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছে পশ্চিমারাই।
উদাহরণ হিসেবে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের সামরিক সরঞ্জাম প্যাকেজের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর জন্য এখন পর্যন্ত ৫৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে যুক্তরাজ্য।
এমনকি কয়েক দশক ধরে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মতো দেশগুলো তাদের নীতি ভঙ্গ করে ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে। অর্থাৎ সুখী দেশ হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রগুলোও দ্বিমুখী অবস্থান নিয়ে বিশ্ববাসীকে বোকা বানাচ্ছে।
গ্যাস সংকটের নেপথ্যেও পশ্চিমারাই?
গ্যাস ও জ্বালানি নিয়ে গোটা বিশ্বজুড়েই হাহাকার চলছে। গ্যাসের উচ্চমূল্যের প্রভাব পড়েছে বিশ্ববাজারেও। বেড়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও। মূলত ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের জেরে মস্কোকে একঘরে করতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পশ্চিমারা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার ব্যাংক, বৈদেশিক রিজার্ভসহ বাণিজ্যিক ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্র লক্ষ্য করে তড়িঘড়ি নিষেধাজ্ঞাও দেয়। যে কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহ আশঙ্কাজনকহারে কমে যায়।
পশ্চিমারা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে গ্যাসকে ব্যবহারের অভিযোগ তুললেও কানাডীয় কলামিস্ট রাচেল মার্সডেন বলছেন, বিশ্বব্যাপী গ্যাসের সংকটের জন্য পশ্চিমারাই দায়ী। বিশেষ করে পশ্চিমাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকেই দায়ী করেছেন তিনি।
রাচেল মার্সডেন তার ব্যাখ্যায় বলছেন, রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে খুব সহজেই পশ্চিমারা এই জ্বালানি সংকট শেষ করে দিতে পারত। কিন্তু তা না করে পুতিনের বিরুদ্ধে রাজনীতির খেলায় মেতে উঠেছে তারা। আর এভাবে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নেতারা বিশ্ববাসীকে বোকা বানাচ্ছে।
আবার পশ্চিমারা রাশিয়াকে একঘরে করার জন্য আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে বাদ দিয়ে দেয়। বিকল্প না থাকায় রফতানির ক্ষেত্রে রুশ মুদ্রা রুবলে গ্যাসের মূল্য পরিশোধের কথা জানায় পুতিন সরকার। এখন পশ্চিমারা উল্টো অভিযোগ তুলে বলছে, মস্কো গ্যাস রফতানির ক্ষেত্রে রুবলে মূল্য পরিশোধের ‘শর্ত’ দিয়েছে।
এ ছাড়া রক্ষাণাবেক্ষণ কাজের জন্য জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের একমাত্র পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম ওয়ান বন্ধের সময়ও রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। রাশিয়া আর গ্যাস সরবরাহ করবে না বলেও বিভিন্ন প্রপাগান্ডা চালিয়েছে। যদিও পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছে রাশিয়া।
অন্যদিকে নর্ড স্ট্রিম ওয়ান মেরামতের জন্য সরঞ্জাম ফেরত না দিতে কানাডাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন জেলেনস্কি। সরঞ্জাম ফেরত দিতে রাজি হলেও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কণ্ঠে পশ্চিমাদের সেই গৎবাঁধা মিথ্যা সুরেরই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। ট্রুডোও রাশিয়ার বিরুদ্ধে গ্যাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ তুলেছেন। অথচ বাস্তবে গ্যাসের এ সংকট তৈরি হয়েছে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণেই। আর গ্যাস সংকট নিয়ে এত নাটকের পেছনেও কলকাঠি নাড়ছে পশ্চিমারাই।
No comments: