নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর এক প্রকার অনিশ্চিত
আগামী অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন করে চাপে পড়তে যাচ্ছে সরকার। কারণ নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর এক প্রকার অনিশ্চিত। সরকারি বিভিন্ন সূত্র থেকেই বলা হচ্ছে, এ আইন নতুন অর্থবছর থেকে কার্যকর না-ও হতে পারে। তবে এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল কেউ এখনও নিশ্চিত করে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ জুন সংসদে এ বিষয়ে বক্তব্য রাখবেন। তখন নিশ্চিত হওয়া যাবে নতুন ভ্যাট আইনের ভবিষ্যৎ।
গত বুধবার বিভিন্ন পত্রিকায় নতুন ভ্যাট আইন আগামী অর্থবছর থেকে কার্যকর হচ্ছে না_ এ মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এটি কার্যকর না হলে রাজস্ব আয়ের দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়বে সরকার। ফলে পুরো বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে বড় ধরনের আর্থিক সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
১ জুলাই থেকে ভ্যাট আইন কার্যকর হবে কি-না, তা নিয়ে গতকাল বুধবার দিনভর আলোচনা হয় সচিবালয়সহ ব্যবসায়ী মহলে। অনেকে বলেছেন, একটি মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে শুধু অর্থমন্ত্রীর ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের
সদস্যরা তাকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করছেন। কিন্তু বাজেট প্রণয়নে মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও অনেক ভূমিকা থাকে। এটি মন্ত্রিসভার বৈঠকেও অনুমোদন করে নিতে হয়। তারপর সংসদে পেশ করা হয়।
আইএমএফের পরামর্শে ২০১২ সালে চুলচেরা বিশ্লেষণের পর নতুন ভ্যাট আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকেও এটির অনুমোদন নেওয়া হয়। এরও আগে অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে এটি নিয়ে আলোচনা করা হয়। তখন ওই আইন নিয়ে কোনো বিতর্ক বা আপত্তি ওঠেনি। এখন যারা অর্থমন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর, তখন কেউ কোনো কথা বলেননি। এরপর আইনটি বাস্তবায়নের জন্য সার্বিক প্রস্তুতির লক্ষ্যে তিন বছর সময় নেয় সরকার। গত অর্থবছরে তা কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপে আবারও এক বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর অর্থমন্ত্রী সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে কয়েক দফা আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকেই নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হবে। সংসদে বাজেট ঘোষণার পর খোদ সরকারি দল থেকে এ আইন বাস্তবায়নে প্রবল বিরোধিতা আসে। সংসদে অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও তোলে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। সবকিছু মিলিয়ে ভ্যাট আইন কার্যকর অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
তবে বুধবার সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ অর্থমন্ত্রীর পক্ষে অবস্থান নেন। বিশেষ করে অর্থমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করায় জাতীয় পার্টির সদস্যদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'এ বাজেট ক্যাবিনেটে অনুমোদিত। অর্থমন্ত্রীর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আস্থা আছে। উনি বেঁচে থাকলে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তিনি আরও বাজেট দেবেন।' অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবির সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, 'মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে আমিও এ বাজেট প্রণয়নে জড়িত।'
এবারের বাজেটের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু নতুন ভ্যাট আইন। এ আইন কার্যকর হবে_ এমন বিবেচনা মাথায় নিয়েই অধিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়। আইনটি শেষ পর্যন্ত প্রয়োগ করতে না পারলে রাজস্ব আদায় অনেক কমে যাবে। ফলে অর্থায়নে সংকট তৈরি হবে এবং ঘাটতি বাড়বে। এতে করে নির্বাচন সামনে রেখে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, সেই অর্থের জোগান নিশ্চিত করা যাবে না। ফলে পুরো বাজেট বাস্তবায়নে সংকট তৈরি হতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় প্রাথমিক হিসাব করে দেখেছে, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হলে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম হবে। সরাসরি ভ্যাট থেকে আদায় কমবে বড় অঙ্কের। একই সঙ্গে আয়কর, আমদানি পর্যায়সহ অন্যান্য খাতেও আদায় কমবে। ফলে সামগ্রিকভাবে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে পড়বে এনবিআর।
এবারের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ভ্যাট আইন কার্যকর না হলে রাজস্ব আয়ে যে ক্ষতি হবে, তা পোষাতে হলে দুটি পথ খোলা আছে। একটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ কমাতে হবে। অন্যটি ব্যাংক থেকে ঋণ আরও বেশি নিতে হবে। জানা গেছে, নতুন আইন কার্যকর না হলে পুরাতন, অর্থাৎ ১৯৯১ সালের আইন অব্যাহত থাকবে। সে ক্ষেত্রে আদায় বাড়াতে নতুন করে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে নতুন বাজেটে ভ্যাটে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা অর্জন করা যাবে না। এবারের বাজেটে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৯১ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, বাজেট ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর দুই দফা বৈঠক হয়। এ বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ এনবিআরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ভ্যাট আইনের বিস্তারিত অবহিত করা হয় প্রধানমন্ত্রীকে। বাজেট ঘোষণার দু'দিন আগে অর্থমন্ত্রী সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ভ্যাট আইন নিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের বিষয়টিও অবহিত করেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সম্মতি নেওয়ার পরই বাজেট বক্তৃতা চূড়ান্ত করেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া যেদিন বাজেট ঘোষণা করা হয়, সেদিন সকালে সংসদে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেটে অনুমোদন দেওয়া হয়। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পরই বাজেট পেশ করা হয় সংসদে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজেট প্রণয়নে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রীরা সম্পৃক্ত থাকেন। ফলে এখন এককভাবে অর্থমন্ত্রীকে যেভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে, তা সমীচীন নয়।
সূত্র জানায়, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে না পারলে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হবে। অর্থমন্ত্রীর জন্যও এক ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কেননা, এ আইন বাস্তবায়নের শর্ত হিসেবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নেওয়া হয়। আইনটি ছয় বছরেও কার্যকর করা যায়নি। এ সময়ের মধ্যে দাতা সংস্থাগুলোকে কয়েক দফা প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। এবারের বাজেটে আইনটি কার্যকর করার ঘোষণাও দেওয়া হয়। শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক চাপে আবার পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, এত বছর পরও কেন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়নি। তা হলে এ আইনে কি কোনো ত্রুটি আছে? যদি থাকে, তাহলে এর জন্য কে দায়ী?
নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের অন্যতম শর্ত হিসেবে আইএমএফের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার বা সমপরিমাণ আট হাজার কোটি টাকা ঋণ-সহায়তা নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া এ আইন বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অনলাইন প্রকল্পের জন্য ৫৫০ কোটি টাকা নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ভ্যাট আইন কার্যকর না হলে এ দুটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
সূত্র জানায়, নতুন ভ্যাট আইন যাতে কার্যকর না হয়, সে জন্য শুরু থেকেই বর্তমান সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় কতিপয় ব্যবসায়ী চাপ প্রয়োগ করে আসছেন সরকারের ওপর। সম্প্রতি সংসদে সরকারি দলের এমপিরা ভ্যাট আইনের প্রবল বিরোধিতা করলে চাপ আরও ঘনীভূত হয়। দলের ভেতর থেকেই এখন এ আইন কার্যকর না করার চাপ বাড়ছে। মূলত নির্বাচনী ভাবনায় ভোট হারানোর ভয়ে ঝুঁকি নিতে চায় না সরকার। এ জন্য আইনটি বাস্তবায়ন থেকে সরকার সরে আসতে পারে।
আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। ১৯৯১ সালের পর এটি বাংলাদেশের রাজস্ব বিভাগে বড় ধরনের সংস্কার। আমি মনে করি, এ সংস্কার করতে হলে সরকারকে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সমর্থন খুবই জরুরি। তিনি আরও বলেন, '৯১ সালে যখন প্রথমবারের মতো ভ্যাট প্রবর্তন করা হয়, তখনও বিরোধিতা এসেছিল। ঘেরাও করা হয় এনবিআর। তখনকার সরকার বর্তমান সরকারের চেয়ে আরও দুর্বল ছিল। তাই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এখনও সময় আছে, সমস্যা চিহ্নিত করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা উচিত।
