সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানামুখী বিচার-বিশ্নেষণ চলছে
আগামী ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটির মেয়র, ৩৩টি সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ১১টি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এই নগরীর তিন লাখ ৯৩ হাজার ৯৯৪ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। আগামীকাল মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচার শেষ হচ্ছে।
উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন জনপদ রংপুর সিটির এই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানামুখী বিচার-বিশ্নেষণ চলছে। এই এলাকার জাতীয় রাজনীতিও সরগরম হয়ে উঠছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো জাতীয় নেতা রংপুর ঘুরে যাচ্ছেন। নির্বাচনী আচরণবিধির ফাঁক-ফোকর এড়িয়ে তারা নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য ফল কী হতে পারে তা নিয়ে বিশ্নেষণের শেষ নেই। অনেকেরই ধারণা, আওয়ামী লীগের উন্নয়নের পক্ষে যেমন ভোটারদের জোরালো অবস্থান রয়েছে, তেমনি জাপা প্রার্থী মোস্তফার ব্যক্তি ইমেজকেও মূল্যায়ন করছেন ভোটাররা।
কতটা সংহত এরশাদের দুর্গ?
অতীত নির্বাচন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে রংপুর জেলার ৬টি আসনের সবক'টিতে বিজয়ী হয়েছিল লাঙ্গল। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই পাল্টে গেছে। জাতীয় রাজনীতিতে একাধিকবার ডিগবাজি খাওয়া এরশাদের একচ্ছত্র আধিপত্য এখন আর নেই। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে এই জেলায় মাত্র তিনটি আসন পায় জাপা। সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিকট অতীতের নির্বাচনগুলোতেই জাপার সেই রমারমা অবস্থায় ভাটির টান পড়েছে। সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হলেও তাতে ভালো ফল করতে পারেনি লাঙ্গল। কোথাও আওয়ামী লীগ আবার কোথাও জামায়াতের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। কয়েকটি ইউপিতে বিএনপি প্রার্থীরাও জয়লাভ করেছেন। কিন্তু অনেক ইউপিতে জাপা প্রার্থীও দিতে পারেনি।
এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদের সবক'টিতে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী থাকলেও সব ওয়ার্ডে জাপার প্রার্থী নেই। মাত্র সাতটি ওয়ার্ডে জাপার প্রার্থী। আর ১২টিতে বিএনপির প্রার্থী রয়েছেন।
রংপুরের রাজনীতির পালাবদল সম্পর্কে জানতে চাইলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ২০০৮ সালের পর রংপুর শহরে সরাসরি নৌকা, লাঙ্গল আর ধানের শীষ প্রতীকের মধ্যে লড়াই এবারই প্রথম হচ্ছে। এই ১০ বছরে নতুন যারা ভোটার হয়েছেন তাদের অনুভূতি আর পুরনো ভোটারদের চাহিদার মধ্যে পার্থাক্য রয়েছে। এরশাদ বা লাঙ্গল প্রতীকের ভোট শহরের আশপাশে যে কমছে, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এক সময় লাঙ্গল থাকলেই পাস নিশ্চিত ছিল এ শহরে। তবে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজের কারণে শহরে লাঙ্গল প্রতীকের প্রকৃত ভোট এবার হয়তো দৃশ্যমান হবে না। মোস্তফা ছাড়া জাপা অন্য কোনো প্রার্থী দিলে ভোটের হিসাব পুরোপুরি পাল্টে যেতে পারত বলেও মনে করেন তিনি।
রংপুরের উন্নয়ন কতটা দৃশ্যমান?
আওয়ামী লীগ প্রার্থী সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টুর দাবি, তার ৫ বছরের দায়িত্ব পালনকালে এ শহরে ২৯৩ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আরও দেড়শ' কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। শহরে পয়ঃনিস্কাশনে আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও সড়ক প্রশস্থের কাজও হয়েছে। নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পাবলিক টয়লেট ও সড়ক বাতি উন্নয়নও করা হয়েছে। শ্যামা সুন্দরী খালের ওপর ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
তবে রংপুর সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি আফতাব হোসেনের মতে, গাজীপুরের পর দেশের সবচেয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম সিটি করপোরেশন এই রংপুর। ৫৫ বর্গকিলোমিটারের পৌরসভাকে ২০৩ বর্গকিলোমিটারের সিটিতে উন্নীত করা হলেও সে তুলনায় প্রকল্পের সংখ্যা খুবই সীমিত। বিগত পাঁচ বছরে এত বড় এলাকায় দৃশ্যমান উন্নয়ন অনেক কষ্টসাধ্য কাজ।
এদিকে প্রচার মাঠে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা উন্নয়নের বিষয়টি জোরালোভাবে ভোটারদের কাছে তুলে ধরছেন। পাশাপাশি নৌকা প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজ নিয়ে তাদের অস্বস্তিও অনেক ক্ষেত্রে চাপা রাখতে পারছেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিউর রহমান বলেন, প্রার্থী নয়, আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মী নৌকা প্রতীকের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজের বিষয়ে জানতে চাইলে সাফিউর রহমান বলেন, প্রার্থীর ইমেজ ভালো, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।
এদিকে প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদেই আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক নেতা প্রার্থী হয়েছেন। তারা নিজেদের নির্বাচনে মনোযোগী হওয়ায় মেয়র প্রার্থীর প্রচারে কিছুটা কম তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে তাদের দাবি, রাস্তায় প্রচারের তুলনায় বাড়ি বাড়ি প্রচারে তারা কাউন্সিলর ভোটের সঙ্গে মেয়র পদেও ভোট চাইছেন।
ভালোভাবেই মাঠে রয়েছে বিএনপি
মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা নৌকা ও লাঙ্গলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে- এটা অনেকটা নিশ্চিত ধরে নিয়েই নির্বাচনী মাঠে মরিয়া হয়ে লড়াই চালাচ্ছে বিএনপি। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির অতীত নির্বাচনে রংপুর জেলায় সাফল্য নেই বললেই চলে। নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে আজ সোমবার রংপুর আসছেন দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল স্থানীয় জেলা বিএনপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও জয়নুল আবদিন ফারুকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তারা নির্বাচনের শেষ দিন পর্যন্ত মাঠে থাকার কথাও জানান। এ ছাড়াও গত শনিবার জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে দীর্ঘ কয়েক বছর পর বড় ধরনের শো-ডাউন করা হয়েছে।
এই নির্বাচনে বিএনপির প্রাপ্য কী হতে পারে জানতে চাইলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. তুহিন ওয়াদুদ মনে করেন, রংপুরের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে লাঙ্গলের বিকল্প হতে পারে ধানের শীষ। কারণ রংপুর শহরের চারপাশে অর্থাৎ মিঠাপুকুর, তারাগঞ্জ, পীরগাছা, বদরগঞ্জ ও গঙ্গাচড়ায় এক সময় জামায়াতের জোরালো তৎপরতা ছিল। জামায়াত নির্বাচনের সুযোগ না পাওয়ায় বিএনপি এ ভোটারদের ভোট পাওয়ার আশা করছে। তাই তার মতে, এ নির্বাচনে বিএনপি মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না আসতে পারলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
No comments: