১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুরো বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণ করতে একটি রিসোর্ট বসেছিলেন তিন জন মানুষ।
নাৎসি জার্মানির অবস্থা সঙ্গিন। সোভিয়েত বাহিনী বার্লিনের কাছে, অন্যদিকে মিত্র বাহিনী জার্মানির পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করেছে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী অগ্রসরমান জাপানের দিকে।
নিজেদের সেনাবাহিনী যখন জয়ের সুবাতাস পাচ্ছে তখন কথিত বিগ থ্রি মানে তিন পরাশক্তি- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন - কৃষ্ণসাগরের তীরে সোভিয়েত রিসোর্ট -ইয়াল্টায় বৈঠকে বসতে সম্মত হন।
৭৫ বছর আগে রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধের পর এ ধরণের কর্মকাণ্ড যাতে আর না হয় সেটিই তারা চেয়েছিলেন।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া সহযোগিতা করতে চেয়েছে নিজেদের শর্তানুযায়ী।
ইয়াল্টা চুক্তি সত্ত্বেও কয়েক মাসের মধ্যেই তৈরি হয়েছিলো স্নায়ু যুদ্ধের পটভূমি।
যে যুদ্ধ পরবর্তী কয়েক দশক বিশ্বকে বিভক্ত করে রেখেছিলো।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অ্যান্ড্রু বেসভিক বিবিসিকে বলছেন, "ইয়াল্টা বৈঠকের উদ্দেশ্য যদি হয় যুদ্ধের পর শান্তি আনা, তাহলে বলতেই হয় সেটি ব্যর্থ হয়েছে"।
কী হয়েছিলো ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে
ততদিনে নাৎসি জার্মানি যুদ্ধে প্রায় পরাজিত। দেশটি তখনো প্রতিরোধের চেষ্টা করে যাচ্ছিলো কিন্তু যুদ্ধের ফল নিয়ে তখন আর কারও কোনো সন্দেহ ছিলোনা।
পূর্ব ইউরোপে জার্মান বাহিনীর অবস্থা করুণ।
কিন্তু যখন সোভিয়েত বাহিনী জয়ের পথে ততদিনে ইস্টার্ন ফ্রন্টে জার্মান বাহিনীর তিন ভাগই নিহত বা আহত।
ধারণা করা হয় প্রতি সাতজনের একজন সোভিয়েত নাগরিক যার মোট সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি - যাদের দুই তৃতীয়াংশই বেসামরিক তারা নিহত হয়েছিলো।
দেশটির শহর ও ধনী এলাকাগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিলো।
শিল্প, কৃষি, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট এমনকি মানচিত্রেই আর দেখা যাচ্ছিলোনা।
নেতাদের লক্ষ্য কী ছিলো
জোসেফ স্ট্যালিন তার দেশকে নিজের পায়ে দাড় করাতে চেয়েছিলেন।
তিনি জার্মানিকে ভাগ করতে চেয়েছিলেন যাতে করে দেশটি আর কখনো হুমকি হতে না পারে। এবং একই সাথে তিনি ব্যাপক ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন- নিজের দেশকে পুনর্গঠনের জন্য।
তিনি জানতেন এসব পেতে হলে তাকে পশ্চিমা শক্তিগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে।
উইনস্টন চার্চিল জানতেন যে স্ট্যালিন কী চান। তারা ১৯৪৪ সালের অক্টোবরেও মস্কোতে সাক্ষাত করেছিলেন।
তিনি জানতেন লাখ লাখ সোভিয়েত সৈন্য যারা জার্মানিকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ থেকে বের করে দিয়েছে এবং এখন সোভিয়েত তার সৈন্য সেসব জায়গায় রেখে দিতে চাইলে যুক্তরাজ্যের কিছু করার নেই।
যুক্তরাজ্য যুদ্ধের সূচনা করেছিলো ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে কারণ তার মিত্র পোল্যান্ড দখল করে নিয়েছিলো জার্মানি।
তবে জয়ের জন্য যুক্তরাজ্যকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। চার্চিল আশা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সমর্থন দিবে ও স্ট্যালিনের পাশে দাঁড়াবে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের ছিলো নিজের কিছু অগ্রাধিকার।
তিনি চেয়েছিলেন যুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক শান্তিরক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিসংঘে স্বাক্ষর করুক স্ট্যালিন।
তিনি এও চেয়েছিলেন যে সোভিয়েতরা জাপানের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করুক।
যদিও নাটকীয়ভাবে সবকিছুই জাপানের প্রতিকূলে যাচ্ছিলো, তারপরেও তাদের বাহিনী প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলো।
যুক্তরাষ্ট্র তখন জাপানি দ্বীপে রক্তক্ষয়ী আগ্রাসন চালানোর কথাও ভেবেছিলো।
ইয়াল্টায় কী হয়েছিলো
রুজভেল্ট ভূমধ্যসাগরীয় কোনো এলাকায় বসতে চেয়েছিলেন আর স্ট্যালিনের ছিলো বিমানভীতি।
তিনিই ইয়াল্টা বৈঠকের প্রস্তাব দেন।
কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছিলো ৪ঠা থেকে ১১ই ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের আবাসস্থল লিভাদিয়া প্রাসাদে যেটি রাশিয়ার শেষ জার নিকোলাস-২ এর গ্রীষ্মকালীন বাসভবন ছিলো।
এর আগেও ১৯৪৩ সালে ইরানে সাক্ষাত হয়েছিলো তিন নেতার। চার্চিলের চেয়ে রুজভেল্ট বেশি বিশ্বাস করতেন স্ট্যালিনকে।
চার্চিল স্ট্যালিনকে ক্রমবর্ধমান হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতেন।
এক সপ্তাহের আলোচনার পর বিগ থ্রি তাদের সিদ্ধান্ত জানালেন বিশ্বকে।
নি:শর্ত আত্মসমর্পণের পর জার্মানি দু ভাগে ভাগ হবে।
এ ঘোষণায় বলা হয়েছিল জার্মানি ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করবে এবং সেজন্য একটি কমিশন হবে মস্কোতে।
এই নেতারা আরও একমত হলেন যে পোল্যান্ড সহ ইউরোপ জুড়ে মুক্ত এলাকাগেুলোতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন হবে ও নতুন সরকার হবে।
সোভিয়েতরা ওয়ারশ'তে যে প্রভিশনাল কমিউনিস্ট সরকার আছে সেটিও সম্প্রসারিত হবে।
কিন্তু গণতন্ত্র বিষয়টার অর্থ স্ট্যালিনের কাছে ছিলো ভিন্ন।
প্রকাশ্যে মুক্ত ইউরোপের জন্য অবাধ নির্বাচনে তিনি সম্মত হলেও তার বাহিনী ইতোমধ্যেই মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা গুলো দখল করে নিয়েছিলো।
আবার স্ট্যালিনের অনুরোধ নেতারা সম্মত হন যে পোল্যান্ডের সীমানা কিছু সরে আসবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভূমি দিয়ে।
আর এই বাল্টিক রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দিবে।
ইতিহাসবিদ আন্নে অ্যাপলবম তার বইয়ে লিখেছেন যে নেতারা ইউরোপের ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন মারাত্মক অদূরদর্শিতা নিয়ে।
রুজভেল্ট বেশি আগ্রহী ছিলেন তার জাতিসংঘ পরিকল্পনা নিয়ে এবং তিনি সফল হয়েছেন, কারণ তিন দেশই একমত হয়েছিলো ২৫শে এপ্রিল ১৯৪৫ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে প্রতিনিধি পাঠাতে।
এর বাইরে স্ট্যালিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন মাস পর জাপানে আগ্রাসন চালাবেন তিনি।
তবে চুক্তি সত্ত্বেও শীর্ষ বৈঠকের পর পূর্ব ইউরোপের পরিস্থিতি কেমন হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন চার্চিল।
তিনি তার বাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ শেষ হবার আগে দূরপ্রাচ্যের দিকে দ্রুত সরে আসতে বললেন।
পরে কী হলো
কয়েক মাসের মধ্যে রাজনৈতিক অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন হলো।
রুজভেল্ট মৃত্যুবরণ করেন এপ্রিলে ও ক্ষমতায় আসলেন হ্যারি ট্রুম্যান।
মে মাসে জার্মানি নি:শর্ত আত্মসমর্পণ করলো এবং ১৬ই জুলাই পরমাণু বোমার সফল পরীক্ষা চালালো।
পরীক্ষার পরদিনই প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান উইনস্টন চার্চিল ও জোসেফ স্ট্যালিনের সাথে বার্লিনের বাইরে পোটসড্যাম সম্মেলনে যোগ দিলেন।
ট্রুম্যান স্ট্যালিনকে তেমন একটা জানতেননা। চার্চিল ক্ষমতায় ছিলেন মে, ১৯৪০ পর্যন্ত। তার পরিবর্তে ১৯৪৫ এর নির্বাচনের পর আসলেন ক্লিমেন্ট অ্যাটলি।
তখন সম্মেলনের মুডটাই ছিলো ভিন্ন।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা ছিলেন আত্মবিশ্বাসী কারণ তারা পরমাণু বোমার অধিকারী।
ট্রুম্যান স্ট্যালিনের বিষয়ে আরও সন্দিহান ছিলেন।
তিনি ও তার উপদেষ্টারা বিশ্বাস করতেন যে সোভিয়েত ইয়াল্টা চুক্তির বিষয়ে অনড় থাকবে না।
দু বছরের মধ্যে এলো ট্রুম্যান ডকট্রিন—অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশ টেনের ধরার ঘোষণা দিলো—শুরু হলো স্নায়ু যুদ্ধ।
পরে চার্চিল ও রুজভেল্ট দুজনের সমালোচনা হলো স্ট্যালিনকে বেশি সুযোগ দেয়ার জন্য।
কিন্তু বাস্তবতা হলো তাদের তেমন কিছু করার ছিলো না, কারণ স্ট্যালিনের বাহিনী তখন পুরো মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে।
ইয়াল্টার পর চার্চিল সোভিয়েত স্বার্থে আঘাতের পরিকল্পনা করলেও ব্রিটিশ সমরবিদদের কাছে তা ছিলো অবাস্তব।
No comments: