গত ১২ই অক্টোবর বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যোগ করার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা।
এর পরদিন এ সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশে সই করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, যার ফলে সংশোধিত আইনটি কার্যকর হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যুর শাস্তি প্রসঙ্গে ৯(১) ধারায় এতদিন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দল বেধে ধর্ষণের ঘটনায় নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা আহত হলে, সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সেই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা করে অর্থ দণ্ডের বিধানও রয়েছে।
সেই আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও থাকছে।
এর ফলে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেয়া সপ্তম দেশ হলো বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ছাড়া আর যেসব দেশে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড
ভারত
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে পাস করা এক নির্বাহী আদেশে ভারতে ১২ বছরের কম বয়সী মেয়ে শিশু ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়। ওই সময়ে ভারতজুড়ে চলতে থাকা ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ভারতের ফৌজদারি আইন অনুযায়ী, ধর্ষণের কারণে যদি ভুক্তভোগী মারা যান অথবা এমনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তিনি কোনো ধরণের নাড়াচাড়া করতে অক্ষম, সেই ক্ষেত্রেও অপরাধীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ধর্ষণ প্রমাণিত হলে ন্যুনতম দশ বছর শাস্তির বিধান রয়েছে ভারতের আইনে।
পাকিস্তান
পাকিস্তানের ফৌজদারি আইন অনুযায়ী ধর্ষণ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। ভারতের মত পাকিস্তানের আইনেও ধর্ষণ প্রমাণিত হলে সর্বনিম্ন ১০ বছর কারাদণ্ডের শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া দুই বা অধিক ব্যক্তি একই উদ্দেশ্য নিয়ে ধর্ষণের মত অপরাধ সংঘটন করলে বা সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করলে, প্রত্যেকের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে পাকিস্তানের পেনাল কোডে।
গত মাসে একটি হাইওয়েতে হওয়া এক ধর্ষণের ঘটনায় পাকিস্তানে তোলপাড় তৈরি হওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ধর্ষকদের জনসম্মুখে হত্যা কিংবা রাসায়নিক প্রয়োগ করে খোজা করার পক্ষে তার মতামত প্রকাশ করেছিলেন।
ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখার পাশাপাশি ধর্ষণের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশ করা হলেও তিন বছর পর্য্ত কারাদণ্ডের শাস্তির বিধান রয়েছে পাকিস্তানে।
সৌদি আরব
সৌদি আরবের শরিয়া আইনে ধর্ষণ একটি ফৌজদারী অপরাধ এবং এর শাস্তি হিসেবে দোররা মারা থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সৌদি আরবে ১৫০টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, যার মধ্যে আটটি ছিল ধর্ষণ অপরাধের জন্য।
ইরান
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ইরানে মোট ২৫০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে ধর্ষণের দায়ে।
অ্যামনেস্টি বলছে, চীনের পর পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়ে থাকে ইরানে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
সংযুক্ত আরব আমিরাতের আইন অনুযায়ী, কোন নারীর সঙ্গে জবরদস্তিমূলক যৌনমিলনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
তবে দেশটির আইনে অপরাধ সংঘটনেরর সময় ভুক্তভোগীর বয়স ১৪ বছরের নিচে হলেই কেবল সেটিকে জোরপূর্বক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে মৃত্যদণ্ড কার্যকর করা না হলেও অন্তত ১৮ জনকে হত্যা, ধর্ষণ ও সশস্ত্র ডাকাতির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দিয়েছে।
চীন
চীনে কোন নারীকে ধর্ষণ কিংবা ১৪ বছরের কম বয়সী কোন মেয়ের সঙ্গে যৌনমিলনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে যদি ঘটনার শিকার মারা যান অথবা মারাত্মকভাবে আহত হন।
সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের ক্ষেত্রে, ধর্ষণের পর ভুক্তভোগী মারা গেলে বা মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলে, অথবা পাবলিক প্লেসে ধর্ষণ হলে বয়স বিবেচনা ছাড়া মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে দেশটিতে। এছাড়া, অপরাধী একাধিক ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায়।
সাধারণ ক্ষেত্রে ধর্ষণ প্রমাণিত হলে ন্যূনতম তিন বছর থেকে ১০ বছর কারাদণ্ডের শাস্তি রয়েছে চীনের আইনে।
মৃত্যুদণ্ড বিধানের সমালোচনা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের
বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান কার্যকর করার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বিবৃতি প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারা মন্তব্য করেছে 'চরম শাস্তি সহিংসতাকে অব্যাহত রাখে, তা প্রতিরোধ করে না।'
সংগঠনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়ার বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিশোধের দিকে মনোনিবেশ না করে যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া ভুক্তভোগীর সুবিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধর্ষণ মহামারি নির্মূলে এবং এর পুনরাবৃত্তি রোধে দীর্ঘমেয়াদে সংস্কার করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
একই সাথে অপরাধীদের শাস্তি যেন নিশ্চিত হয় এবং শাস্তি থেকে দায়মুক্তির সংস্কৃতি যেন বন্ধ হয়, সেদিকেও নজর দেয়ার তাগিদ দিয়েছে অ্যামনেস্টি।
যে কারণে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিরোধিতা করছে অ্যামনেস্টি
অ্যামনেস্টি'র সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, "পৃথিবীর কোনো বিচার ব্যবস্থাই ত্রুটিমুক্ত নয়। যার ফলে বিচার ব্যবস্থার ত্রুটিতে একজন মানুষের প্রাণ নিয়ে নেয়ার পর যদি জানা যায় যে ঐ ব্যক্তি নির্দোষ, তখন আসলে কিছু করার থাকে না।"
আর বাংলাদেশে বর্তমানে ধর্ষণ এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলোর সাথে শাস্তির মাত্রা বাড়ানো বা কমানোর সম্পর্ক খুব সামান্য বলে মনে করেন তারা।
"আমাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের সমস্যাটা পদ্ধতিগত। অর্থাৎ, আমাদের এখানে আইনে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় কিছু সমস্যা আছে। আর এই বিচার প্রক্রিয়া সংশোধন করা না হলে শাস্তি বাড়িয়ে-কমিয়ে আসল পরিস্থিতির উন্নয়ন করা সম্ভব না", বলেন মি. জাকারিয়া।
তিনি বলেন, সরকারের নিজের হিসেবেই নারী নির্যাতনের মামলার একটা বড় অংশেরই শাস্তি হয় না। শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারার অন্যতম প্রধান একটি কারণ আইনের ফাঁক-ফোকর এবং সামাজিক চাপের কারণে ভুক্তভোগীদের আইনের সহায়তা না চাওয়া।
"সরকারের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী ভুক্তভোগীরা ২৬ ভাগ ঘটনায় আইনের সহায়তা নেয়, যার মধ্যে শাস্তি দেয়া হয় ০.৩৭ ভাগের।"
সুতরাং সুলতান জাকারিয়া মনে করেন যে শাস্তির মাত্রা বাড়ালেই যে এই চিত্র পরিবর্তন হবে, সে রকম মনে করার কোনো কারণ নেই।
No comments: