রাজধানীর পলাশী মোড়ে ব্যানবেইস ভবন। ভবনের নিচতলায় অবস্থিত পৃথক দুটি অফিস। একটির নাম 'বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড।' অন্যটি 'বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট।' বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসরে গেলে এ দুই অফিস থেকে তাদের অবসর ভাতা ও কল্যাণ সুবিধার অর্থ তুলতে হয়। করোনার এমন মহামারির দিনেও স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন শত শত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আসছেন সেখানে। হন্যে হয়ে ঘুরছেন তাদের ভাতা পাস করাতে। তবে অবসরে যাওয়া এই শিক্ষক-কর্মচারীদের সবাইকে একসঙ্গে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না সেখানে। ব্যানবেইস কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুসারে, মাত্র পাঁচজন করে শিক্ষককে একসঙ্গে ভবনে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। বাকিরা অপেক্ষায় থাকছেন। যারা ভেতরে প্রবেশ করছেন, কাজ না হলে তাদের অনেক দেরি হচ্ছে বেরিয়ে আসতে। এতে বাইরে থাকা বাকিদের প্রতীক্ষার প্রহরও দীর্ঘ হচ্ছে। সম্প্রতি ব্যানবেইস ভবনে গিয়ে দেখা গেল এমনই দৃশ্য। সারাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক-কর্মচারীরা আধোঘুম আধোজাগরণে নাইট কোচে এসে দিনভর এ ভবনের সামনে অবস্থান করছেন। প্রাপ্য কল্যাণ আর অবসর ভাতার জন্য তাদের এ এক অন্তহীন প্রতীক্ষা। কিন্তু ভাতা কি আর এত সহজে মেলে! কারণ প্রতিষ্ঠান দুটিতে চলছে তীব্র আর্থিক সংকট- বর্তমানে প্রতি মাসে ঘাটতি পড়ছে ২৪ কোটি টাকা। ফলে অবসরে যাওয়ার পর বছরের পর বছর শিক্ষক-কর্মচারীদের ভাতা পেতে দুই থেকে আড়াই বছর লেগে যাচ্ছে। ভাতা পাওয়ার আগেই অনেক শিক্ষক মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছেন। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবন কাটাচ্ছেন। তবু ভাতা মিলছে না। এ জীবনে আদৌ মিলবে কি-না সেটাও জানেন না তারা। ব্যানবেইস ভবনের সামনেই কথা হলো পটুয়াখালী থেকে আসা অবসরপ্রাপ্ত প্রদর্শক একেএম জাকির হোসেনের সঙ্গে। সমকালকে জানালেন, তিনি পটুয়াখালীর বাউফল কলেজের রসায়ন বিষয়ের প্রদর্শক ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হয়ে যাওয়ায় এর বর্তমান নাম বাউফল সরকারি কলেজ। এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি অবসরে গেছেন। এসেছেন নিজের কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসরের টাকার আবেদনের খোঁজ নিতে। জাকির হোসেন জানান, তিন কন্যাসহ তার পরিবারের সদস্য মোট পাঁচজন। চাকরিতে থাকতে মাসে মাসে বেতন-ভাতা পেতেন। এখন অবসর জীবনে এই টাকা দ্রুত পেলে তার বড় উপকার হতো। শেষ বয়সে এসে তিনি পবিত্র হজব্রত পালন করারও ইচ্ছা পোষণ করেন। যশোরের বাঘারপাড়া কলেজ থেকে আসা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নাদিরুল ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালের জুলাইয়ে অবসরে গেছেন তিনি। প্রায় দেড় বছরের এই অবসর জীবনে তিনি সবচেয়ে কষ্টে পড়েছেন করোনা সংক্রমণ শুরুর পর। তিনিসহ পরিবারের তিন সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। চিকিৎসায় বেরিয়ে গেছে অনেক টাকা। নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়েছেন তারপর। অবসর ও কল্যাণের প্রাপ্য টাকার আশায় তাই ব্যানবেইস ভবনে এসে ঘুরছেন। প্রতিদিন সারাদেশ থেকে আসা শত শত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের অফিসে এসে ফিরে যাচ্ছেন। করোনার ঝক্কি সয়ে বৃদ্ধ বয়সে দুর্বল, অসুস্থ শরীর নিয়ে অনেক শিক্ষক কষ্ট করে সারাদিন বসে থাকছেন ব্যানবেইস ভবনের সামনে। অনেকে নিচতলায়ও ঢুকতে পারছেন না। ক্যান্সার আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী সিলেটের কানাইঘাটের দরগাহ উল উলুম দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক আবদুল হাফেজের পরিবারের সদস্যরা অবসরের টাকার জন্য কয়েক দিন ধরে বোর্ডে ধরনা দিচ্ছেন। আলাপকালে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। এ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী সমকালকে বলেন, ভবনে ঢোকার বিষয়ে শিক্ষকদের ভোগান্তির বিষয়টি তারও নজরে এসেছে। তিনি স্টাফদের নির্দেশ দিয়েছেন, সারাদেশ থেকে কষ্ট করে আসা শিক্ষকদের সবাইকে ঢুকতে দিতে হবে। তাদের কথা শুনতে হবে। সচিব জানান, অর্থ সংকটের কারণে এই ভাতা পেতে আবেদনের পরও দুই-আড়াই বছর লেগে যাচ্ছে। তবে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সমস্যার সমাধান করতে। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে ছয় শতাংশ হারে অবসরের চাঁদা বাবদ অবসর বোর্ডের প্রতি মাসের আয় প্রায় ৬০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রতি মাসে আবেদনকারীদের সবাইকে অবসর ভাতা দিতে লাগে অন্তত ৮০ কোটি টাকা। তার মানে ২০ কোটি টাকার ঘাটতি পড়ছে প্রতি মাসে। তিনি বলেন, বর্তমানে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আবেদনকারীদের চেক প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন বোর্ডের মোট ঘাটতির পরিমাণ ৮৯ কোটি টাকা। তিনি বলেন, আর্থিক সংকট কাটাতে সরকার থেকে বোর্ডকে নতুন অর্থ বরাদ্দও দিতে হবে। আর্থিক সংকট রয়েছে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টেও। এই ট্রাস্টের সচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে চার শতাংশ হারে ট্রাস্টের চাঁদা বাবদ প্রতি মাসের আয় প্রায় ৪০ কোটি টাকা। আর প্রতি মাসে বিতরণ করা হচ্ছে ৪৩ থেকে ৪৪ কোটি টাকা। নিট ঘাটতি থাকছে তিন থেকে চার কোটি টাকা। বর্তমানে তারা ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের করা আবেদনগুলোর নিষ্পত্তি করছেন। তিনি জানান, পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিতে গিয়ে ট্রাস্টের ব্যয় বেড়েছে। অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের সঙ্গে পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট যোগ করে সর্বশেষ স্কেল অনুযায়ী ১৯৯০ সাল থেকে হিসাব করে অর্থ দেওয়া হয়। এতে শিক্ষকপ্রতি এক থেকে দেড় লাখ টাকা ব্যয় বেড়েছে। এটিও ট্রাস্টের অর্থ ঘাটতির পরিমাণ বাড়িয়ে তুলেছে। সারাদেশের এমপিওভুক্ত প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর ভাতা দেওয়ার কাজ করে এ দুটি প্রতিষ্ঠান। এই বোর্ড ও ট্রাস্ট পরিচালিত হয় ২১ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিচালনা বোর্ডের মাধ্যমে। শিক্ষা সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ডিজি, বোর্ডের সচিব ছাড়াও বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনগুলোর ১০ জন শিক্ষক প্রতিনিধি ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাঁচজন কর্মকর্তা এবং তিনজন কর্মচারী নিয়ে এই বোর্ড গঠিত হয়। এ দুটি প্রতিষ্ঠানেরই ভাইস চেয়ারম্যান মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, প্রতিষ্ঠান দুটির আর্থিক সংকট কাটিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ভোগান্তি কমাতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। সংকট উত্তরণের উপায় : বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের এক সময়ের সদস্য সচিব ছিলেন প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ। গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট- এ প্রতিষ্ঠান দুটির দ্রুত নিজস্ব আয় বাড়ানোর কার্যক্রম হাতে না নিলে অদূরভবিষ্যতে আর্থিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। কারণ শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিনে দিনে বাড়বে। আর প্রতিষ্ঠান দুটির আয় আরও কমবে। সংস্থা দুটির পরিচালনার সঙ্গে জড়িতদের গালি দিয়ে কোনো লাভ হবে না। কারণ আয় না থাকলে তারা কোথা থেকে দেবেন। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি সদস্য সচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য সরকারের কাছে ১০০ কোটি টাকা চেয়েছিলাম। বর্তমানেও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে সরকারের পাঁচ বছরে প্রতি বছর ৫০ কোটি টাকা করে সিড মানি নেওয়া যেতে পারে। এ টাকা লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। তিনি পরামর্শ দিয়ে আরও বলেন, বর্তমানে যেভাবে কেবলমাত্র শিক্ষকদের প্রদেয় চাঁদা ও ব্যাংক ঋণের সুদের ওপরে প্রতিষ্ঠান দুটি নির্ভরশীল, তা থেকে বেরিয়ে নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। আয় বাড়ানোর একটি উপায় হতে পারে প্রতিষ্ঠান দুটির টাকায় প্রতিটি জেলায় একটি করে বড় কমিউনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা। সেখানে শিক্ষকদের ছেলেমেয়েদের বিয়ের অনুষ্ঠান, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান হবে। শিক্ষক সংগঠনগুলোর নানা অনুষ্ঠানও সেখানে হতে পারে। এতে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া বাবদ ভালোই আয় হবে। এ ছাড়া, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে 'শিক্ষা ব্যাংক' প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ ব্যাংকের আয় থেকেও অবসর ও কল্যাণ সুবিধা শিক্ষকরা পেতে পারেন। শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরাই এ ব্যাংকে চাকরি পাবেন। অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট জমিতে বিনিয়োগের মাধ্যমেও তাদের আয় বাড়াতে পারে। অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, আমেরিকায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরকালীন সুবিধা দিতে বিভিন্ন বিনিয়োগ স্কিম নেওয়া হয়। সেসব অভিজ্ঞতা থেকে এ দেশেও তা চালু করা যেতে পারে। 'বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড' ও 'বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট'-এ দুটি প্রতিষ্ঠানেরই চেয়ারম্যান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি সমকালকে বলেন, কেবল আর্থিক সংকটের কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধা পেতে আবেদনের পর এক থেকে দেড় বছর লেগে যাচ্ছে। এটি মোটেও ভালো অভিজ্ঞতা নয়। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সংস্থা দুটির সঙ্গে দুটি মিটিং করেছি। সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলা কোনো স্থায়ী সমাধান নয় বলে আমার মনে হয়। আমি বলেছি, নিজস্ব আয় কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের তহবিল কীভাবে পরিচালনা করা হয়, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে একটি প্রস্তাব দিতে বলেছি। ওইসব দেশের উদাহরণ নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এই তহবিল সংকটের সমাধান করব। সচিব বলেন, অতীতে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা ছিল সাময়িক। তা এ প্রতিষ্ঠান দুটির সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারেনি। এখানে তাই পলিসি বদলাতে হবে। শিক্ষকদের চাঁদা ছাড়াও আয় বাড়ানোর অন্যান্য উপায় খুঁজে দেখতে হবে। উপযুক্ত স্থানে ভালো বিনিয়োগের মাধ্যমে যেন শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারেন, সেসব উপায় খতিয়ে দেখতে প্রতিষ্ঠান দুটিকে বলা হয়েছে।
Slider
বিশ্ব
জাতীয়
মেহেরপুর জেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
মেহেরপুর সদর উপজেলা
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Home
»
Advertisement
»
politics
» ব্যানবেইসের দুয়ারে মাথা ঠুকছেন ৪৩ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসর ভাতার জন্য অন্তহীন অপেক্ষা
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News
No comments: