বিশ্বের উচ্চতর শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান, চিন্তার প্লেটোবাদী স্কুল ও একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা প্লেটো ছিলেন প্রাচীন >গ্রিসে ধ্রুপদী সময়কালের একজন এথেনীয় ভাববাদী ">দার্শনিক। তিনি সক্রেটিসের শিষ্য ছিলেন। সক্রেটিসের নিজের কোনো রচনার কথা জানা যায় না। কিন্তু প্লেটো সক্রেটিসকে নায়ক করে বিপুল সংখ্যক সংলাপমূলক দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেন। এই সমস্ত গ্রন্থের মধ্যে রিপাবলিক লজ, এ্যাপোলজি, ক্রিটো, ফিডো, পারমিনাইডিস, থিটিটাস প্রভৃতি সংলাপের নাম বিশেষ বিখ্যাত।
প্লেটোর পূর্ববর্তী প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের দর্শন ছিল প্র্রধানত প্রকৃতিবাদী। সে দর্শনে বস্তুর সত্যতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করা হয় নি। কিন্তু প্লেটো তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে সমালোচনা করে ভাববাদী তত্ত্ব তৈরি করেন। তাঁর মতে দৃশ্য জগতের বস্তু সত্য নয়। দৃশ্য জগতের বস্তু হচ্ছে খন্ড সত্য। সমস্ত সৃষ্টির পিছনে এক সত্তা আছে যার চরিত্র বস্তুগত নয়। মূল সেই সত্তা হচ্ছে অ-বস্তু ও ভাব। দৃশ্য বস্তু হচ্ছে সেই ভাবের প্রকাশ। ভাব হচ্ছে অবিনশ্বর এবং অতিন্দ্রিয়। মূল সত্তা রূপ ভাবের কোনো সৃষ্টি কিংবা ক্ষয় নেই। স্থান এবং সময়ের উপরও সে নির্ভর করে না। এই ভাবকে প্লেটো আবার বিশ্বের আত্মা বলেও অভিহিত করেছেন। এই বিশ্ব আত্মার খন্ড প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির আত্মার মধ্যে। আমাদের জ্ঞানের সঠিকতা নির্ভর করে ব্যক্তির আত্মার পক্ষে বিশ্ব আত্মাকে আপন স্মৃতিকে ভাস্বর করে তোলার মধ্যে।
জ্ঞানের মধ্যে প্লেটো একটা দ্বান্ধিক পদ্ধতির কথাও উল্লেখ করেছেন। এই দ্বান্ধিক পদ্ধতির দুটি দিক। একদিকে আমরা ক্রমাধিক সাধারণীকরণের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সাধারণ সত্যে আরোহণ করি। অপরদিকে সর্বোচ্চ সাধারণ সত্য থেকে ক্রমান্বয়ে অল্প থেকে অল্পতর সাধারণ সত্যের মাধ্যমে আমরা দৈনন্দিন বিশেষ সত্য বা ভাবে আরোহণ করি।
গ্রিসের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল দাসের এবং অপরাপর শ্রমজীবি মানুষের শোষণ। প্লেটো নিজে ছিলেন অভিজাত শাসক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। ‘লজ’ বা বিধান এবং ‘রিপাবলিক’ নামক সংলাপে তিনি যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন তার ভিত্তিও তাই দাসের শ্রম। রাষ্ট্রের শাসক হবে তাই দার্শনিক সম্প্রদায়। তার রক্ষক হবে সেনাবাহিনী। দার্শনিক এবং সামরিকবাহিনী এরাই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সত্তার অধিকার ভোগকারী স্বাধীন নাগরিক। এদের নিচে অবস্থান হচ্ছে দাস এবং শ্রমজীবি কারিগরের। তারা শ্রম করে শাসন দার্শনিক এবং রক্ষক সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন করবে। শাসক দার্শনিকদের জীবিকার জন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না। তাদের কোনো ব্যক্তিগত পরিবার বা সম্পত্তি থাকবে না। কিন্তু তাই বলে তাদের কোনো কিছুর অভাবও থাকবে না। অভাবহীন অবকাশে তারা শাসনের কৌশল আয়ত্ত করবে এবং এইভাবে শাসন বিশেষজ্ঞ হয়ে শাসনক্ষমতার একমাত্র অধিকারী হবে। শিশুকাল হতে শাসকসম্প্রদায়ের সন্তানকে এক সার্বিক শিক্ষার মাধ্যমে শাসক হওয়ার উপযুক্ত গুণে সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে।
প্লেটো যেভাবে রাষ্ট্রের শাসন, রক্ষণ এবং উৎপাদনমূলক কাজকে পৃথক করে এক এক সম্প্রদায়ের উপর নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন তার মধ্যে শ্রমবিভাগের গুরুত্ব যে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু প্লেটোর শ্রমবিভাগ এবং আধুনিককালের শ্রমবিভাগ অবশ্যই পৃথক। প্লেটো্ তাঁর এই বিভাগকে কার্যত অনড় শ্রেণিবিভাগে যেমন পরিণত করেছিলেন, তেমনি এই বিভাগকে একটিকে অপর একটি থেকে উত্তম এবং অধম বলেও নির্দিষ্ট করেছিলেন। শাসনের কাজ হচ্ছে সর্বোত্তম কাজ। আর শ্রম দিয়ে উৎপাদন রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও মূল্যায়নের দিক থেকে অধম কাজ। প্লেটোর ভাবগত দর্শন আর সমাজগত তত্ত্ব উভয়ই পরবর্তীকালের ভাববাদী চিন্তার বিকাশে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে।তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৩১১-৩১২।
No comments: