ইসরাইলের একটি কোম্পানির বিশ্বের দেশে দেশে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার খবর কয়েক সপ্তাহ আগেই ফাঁস হয়েছে। এরপর গত সপ্তাহেই অধিকৃত পশ্চিম তীরে কয়েকটি ফিলিস্তিনি গ্রামে তাণ্ডব চালিয়ে অসংখ্য বাড়িঘর ও গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইলি সেটেলাররা।
ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় আফ্রিকান ইউনিয়নের সম্মেলনে নেতারা। ছবি: আল জাজিরা
মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন। যত ধরনের অন্যায় আছে ফিলিস্তিনিদের প্রতি তার সবই করে যাচ্ছে ইসরাইল। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য নিয়মিত নিন্দাও কুড়াচ্ছে দেশটি। তবে ফিলিস্তিনিদের ওপর যে মাত্রায় নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানো হচ্ছে, সেই তুলনায় এ নিন্দা খুব সামান্যই।
কিন্তু ইসরাইল ও তার সমর্থক পশ্চিমা বিশ্বের জন্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসটা বলতে গেলে একটু ব্যতিক্রমই ছিল। গত মাসের শুরুর দিকে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় বসে আফ্রিকার দেশগুলোর শীর্ষ রাজনৈতিক সংগঠন আফ্রিকান ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলন। সম্মেলনের শুরুতেই এক বিরল সেই সঙ্গে বিষ্ময়কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় ইহুদিবাদী দেশটি।
ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত ও ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা বিষয়ক বিভাগের পরিচালক শ্যারন বার-লির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশ নেয়। কিন্তু সম্মেলনের শুরুতেই সম্মেলন স্থল থেকে ইসরাইলি প্রতিনিধি দলটিকে বের করে দেয়া হয়।
আরও পড়ুন: বিচার ব্যবস্থা সংস্কার পরিকল্পনা /ইসরাইলে নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে ফের বিক্ষোভ
এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা বিষয়ক উপ-মহাপরিচালক শ্যারন বার-লি সম্মেলনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করছেন। এরপর তাকে সাথে করে সম্মেলন স্থলের বাইরে বের করে দিয়ে আসেন আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারপারসন মুসা ফাকি।
অবশ্য এর আগে তিনি স্পষ্ট করেন, দুই দশক আগে ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক দেশ হতে ইসরাইল যে আবেদন জানিয়েছিল, তা আসলে বাতিল করা হয়েছে এবং যে কারণে ‘ইসরাইলকে এ বছর ইসরাইলকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি’।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আফ্রিকান ইউনিয়নের সম্মেলনে ইসরাইলকে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নে সংস্থায় ব্যাপক তর্ক বিতর্ক হয়। সে সময় প্রচণ্ড রকমের মতবিরোধ এড়াতে ৫৫ জাতির এ জোটে ভোটাভুটি স্থগিত করা হয়েছিল।
সে সময় ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শতাইয়া সেসময় আফ্রিকার নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর যে বর্বরতা চালাচ্ছে ইহুদিবাদী ইসরাইল তাতে বর্ণবাদী সরকারকে কোনোমতেই আফ্রিকান ইউনিয়নে প্রবেশাধিকার দিয়ে পুরস্কৃত করা উচিত হবে না।
আরও পড়ুন: ফিলিস্তিনে ইসরাইলি সেটেলারদের তাণ্ডব, বহু বাড়ি-গাড়ি পুড়ে ছাই
আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো বৈশ্বিক মঞ্চে ইসরাইলের জন্য তখনও আরও বাজে কিছু অপেক্ষা করছিল। সম্মেলনে ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি বিষয়ে ‘আ ড্রাফট ডিক্লারেশন অন দ্য সিচুয়েশন ইন প্যালেস্টাইন অ্যান্ড দ্য মিডল ইস্ট’ শীর্ষক একটি যৌথ ঘোষণা গৃহীত হয়। যা সম্মেলন শেষে সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধি ও উপস্থিত সাংবাদিকদের হাতে হাতে পৌঁছে দেয়া হয়।
ওই যৌথ ঘোষণা আফ্রিকান ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইসরাইলি দখলদারির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ সংগ্রামে সম্পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করছে ইউনিয়ন। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নিরবচ্ছিন্ন অবৈধ বসতি স্থাপণের নিন্দা জানাচ্ছে।
যে বিষয়টি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সেটা হচ্ছে, এ ঘোষণায় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোকে ইসরাইলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের বাণিজ্য, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ইতি টানার আহ্বান জানানো হয়েছে। যৌথ ঘোষণার এ বিষয়টির সঙ্গে বিশ্বব্যাপী চলমান ‘বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট, স্যাঙ্কশন্স’, সংক্ষেপে বিডিএস আন্দোলনের দাবিগুলোর বেশ মিল রয়েছে।
আরও পড়ুন: দেশে দেশে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ ইসরাইলি প্রতিষ্ঠানের, বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য
আফ্রিকান ইউনিয়নের এই পরামর্শ যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে এর মধ্যদিয়ে শুধু আফ্রিকায় নয়, পুরো বিশ্বে ইসরাইলের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাসের ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আসতে পারে। অবশ্য আফ্রিকার জন্য এমন বৈশ্বিক আন্দোলন পরিচালনা নতুন কিছু নয়।
১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার নিপীড়ক, নৃতাত্ত্বিক-শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও বর্ণবাদী সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে নেতৃত্ব দিয়েছিল সে। খসড়া যৌথ ঘোষণায় প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এবার ইসরাইলের উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদী ব্যবস্থা ভেঙে ও উৎখাতের আহ্বান জানানো হয়েছে। আফ্রিকান দেশগুলো তখন যেভাবে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হয়েছিল, আজ ইসরাইলকে একঘরে করার আন্দোলনেও সফল হতে পারবে।
আল জাজিরায় প্রকাশিত লেখক ও পুরস্কারজয়ী কার্টুনিস্ট প্যাট্রিক গাথারার প্রবন্ধ থেকে সংক্ষেপে অনূদীত
No comments: