মার্কিন মুল্লুকে ব্যাংক ধস বিশ্ববাসীকে কী বার্তা দিচ্ছে?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই বিপদগ্রস্ত ছিল সিলিকন ভ্যালি। এর মধ্যে টেক দুনিয়ার এই বৃহৎ তাঁবুতে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের (এসভিবি) দেউলিয়া হয়ে যাওয়া রীতিমতো বিপর্যয়।
৪৮ বছর ধরে তিল তিল করে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করেছে এসভিবি, যা ধসে যেতে সময় নিয়েছে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা। সিলিকন ভ্যালির নব্য ব্যবসায়ীদের আশ্রয়স্থল এসভিবির দেউলিয়া হয়ে যাওয়া যেমনি উদ্যোক্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও যোগ করেছে দুশ্চিন্তার মাত্রা।
পর পর দুটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কী তাহলে বিপদের মুখে? ব্যাংক দেউলিয়া হওয়া দুশ্চিন্তার কারণ হলেও মার্কিন অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে সামান্য। তবে যে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের কারণে ক্যালিফোর্নিয়ার এসভিবি ও নিউইয়র্কের সিগন্যাচার দেউলিয়া হলো সেই চর্চা চলমান থাকলে ভবিষ্যতে বিপদের মুখে পড়তে পারে মার্কিন অর্থনীতি এমনটা আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদদের।
সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালের ব্যাংক বিপর্যয়ের পর ১৫ বছরে এত বড় ব্যাংকিং বিপর্যয়ের মুখে পড়ল যুক্তরাষ্ট্র। মূলত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের সময়ে ডড-ফ্যাঙ্ক ব্যাংকনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর ফল এসভিবির দেউলিয়া হয়ে যাওয়া।
আরও পড়ুন: যেভাবে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক
যুক্তরাষ্ট্রের ডড-ফ্রাঙ্ক ব্যাংকনীতিতে বলা আছে, একটি ব্যাংককে ঝুঁকিমুক্ত থাকতে হলে কম করে হলেও ৫০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ সম্পত্তি থাকতে হবে। ২০১৫ সালে এসভিবির প্রধান নির্বাহী গ্রেগ বেকার কংগ্রেসে এ নিয়মের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ৫০ বিলিয়ন অর্থমূল্যের মালিক হওয়ার নীতি অমূলক। মূলত সে সময়ে এসভিবির মূলধন ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার। তখন ডড-ফ্রাঙ্কের এ নীতিকে বিধ্বংসী বলেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তবে সে সময়ের অনিয়মের ফল ভোগ করতে হলো এসভিবিকে।
ব্যাংক বন্ধের দুদিন আগে এসভিবি জানিয়েছিল, তাদের ব্যালেন্স শিটের ১৮০ কোটি ডলার ক্ষতি পোষাতে ২২৫ কোটি ডলারের শেয়ার বিক্রি করবেন তারা। ব্যাংক শেয়ার বিক্রি করে সংকট সামাল দিচ্ছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে সিলিকন ভ্যালির আমানত ও বিনিয়োগকারীরা তড়িঘড়ি করে ব্যাংক থেকে তাদের মূলধন তুলে নিতে শুরু করে। এতে করে তাসেরঘরের মতো ভেঙে পড়ে এসভিবি। মার্চের ১০ তারিখ ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল প্রটেকশন অ্যান্ড ইনোভেশন ব্যাংকটিকে বন্ধ ঘোষণা করে। অন্যদিকে ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি) ব্যাংকের সম্পত্তি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
যে কারণে ধসে পড়ল এসভিবি
এসভিবি ধসে পড়ার কারণ হিসেবে সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান ব্যাংকনীতি না মানা থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে ব্যাংকটির রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের গাফলতিকে দায়ী করা হয়েছে সর্বাগ্রে।
ফেডারেল রিজার্ভের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির রিস্ক ম্যানেজমেন্টের প্রধান কর্মকর্তা লরা ইজুরিতা ২০২১ সালের অক্টোবরে চাকরির মেয়াদ শেষ করলেও একই পদে ছিলেন ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। এদিকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নতুন একজন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট প্রধান নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও ইজুরিতার পদ আঁকড়ে থাকার কারণে বড় কোন কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেনি তিনি।
এসভিবির একজন বিনিয়োগকারী রিড ক্যাথরিন গার্ডিয়ানকে জানান, ব্যাংক ধসের বেশ কয়েক মাস আগে থেকে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট দফায় দফায় মিটিং করে আসছিল। তখনই বিনিয়োগকারীরা খারাপ কিছুর সন্দেহ করছিল। তারা এমন কিছু করছিল যা গোপন ও সুবিধাজনক না।
আরও পড়ুন: দেউলিয়াত্বের শঙ্কায় আরও এক মার্কিন ব্যাংক
২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা ড্যানি মোজেস বলেন, একটি বাজে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ যেকোনো ব্যাংককে খাদের কিনারায় নিয়ে যেতে পারে। এসভিবির দশাও হয়ছে তেমন। নিজেদের ভুলগুলোর মাশুল দিতে হলো পুরো ব্যাংককে ডুবিয়ে।
এদিকে ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডেসান্তিস ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, একটি ব্যাংকের উচিত অর্থনৈতিক কার্যাবলির দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেয়া। কিন্তু এসভিবি অর্থনৈতিক দিকে যতটা না মনোযোগ দিয়েছে তার থেকেও দেশের রাজনীতি, চলমান জলবায়ু সংকট এ ধরনের সামাজিক কার্যাবলিতে বেশি জড়িয়ে পড়েছিল। একটি ব্যাংকের অর্থনীতি যখন গৌণ হয়ে পরে ও সামাজিক কার্যাকলাপ যখন মুখ্য হয়ে ওঠে তখন সেই ব্যাংক যে মুখ থুবড়ে পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একদিকে এসভিপির ছিল অভ্যন্তরীণ সমস্যা, অন্যদিকে বৈশ্বিক ও দেশের দোদুল্যমান অর্থনীতি ব্যাংকটির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রভাবক হিসেবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সুদ হার ছিল শূন্যের কাছাকাছি, সেখানে যুদ্ধের পর সেই সুদ হার ধাপে ধাপে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫ শতাংশ। এ অবস্থায় আগের কেনা দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বন্ডগুলো আমানতকারীদের চাপে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছিল এসভিবি। বন্ড বিক্রির খবর ছড়িয়ে পড়লে টেক খাতের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দেয় অস্থিরতা। নিজেরা হৈ-হুল্লোড় করে অর্থ তুলে নিলে ধসে পড়ে এসভিবি।
সুদের হার বৃদ্ধিতে অন্যদিকে চলমান মূল্যস্ফীতির প্রভাবে এমনিতেই মার্কিন অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর মধ্যে সংকট সামাল দিতে ব্যাংক তার সম্পত্তি বিক্রি করছে এমন খবর যেন সলতের আগুন আরেকটু উসকে দেয়ার মতো করে পুড়িয়ে দিয়েছে সিলিকন ভ্যালির এই পুরনো ব্যাংকটিকে।
ব্যাংক দেউলিয়ায় বিশ্ববাজারে প্রভাব কী?
যেভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপে হলেও এর প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে, একইভাবে মার্কিন ব্যাংক দেউলিয়ার প্রভাবও পোহাতে হবে বিশ্ববাসীকে। যদিও অনেকেই বলছিলেন দুই ব্যাংকের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার প্রভাব হবে সামান্য, তবে গত কয়েকদিনের শেয়ার বাজারের দরপতন আবারও প্রমাণ করলো নগর পড়লে দেবালয় এড়ায় না।
১০ মার্চ ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পর দুদিনে শেয়ার বাজারে পতন হয়েছে ৮৪ শতাংশ। ক্রেডিট সুসির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে পতনের মুখে।
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা দ্য ইকনোমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে বড় ঋণদাতা ব্যাংক এসভিপি। বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তাদের আশ্রয়স্থল বলা হতো এ ব্যাংককে। ভারতের যেসব হোয়াট কলার প্রবাসী সিলিকন ভ্যালিতে নিজেদের ব্যবসা শুরু কথা ভাবছিলেন, কিংবা ঋণ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাদের কাছে এসভিবি ধসে যাওয়া অনেক বড় একটি দুঃসংবাদ।
আরও পড়ুন: দেউলিয়া ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’ কিনবেন মাস্ক!
এ ব্যাপারে ভেঞ্জার ক্যাপিটালিস্ট আশু গার্গ বলেন, ‘আশা করছি খুব দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে। তবে এ কথা হলফ করে বলা যায় ভারতীয় টেক ব্যবসায়ীদের কাছে এসভিবি দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এক রকমের দুঃস্বপ্নের মতো। কেননা বেশিরভাগ ভারতীয় টেক ব্যবসায়ী এসভিবির ওপরে নির্ভরশীল ছিল। খুব কম ব্যাংকই ভারতীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে। এসভিবি ছিল তন্মধ্যে একটি।
এদিকে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট সুসি একটি টালমাটাল সপ্তাহ পার করেছে ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার ধাক্কায়। অন্যদিকে আরেক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাচ জানিয়েছে, যেভাবে ব্যাংকগুলো সংকটের মুখে পড়ছে ও ঋণ দেয়া কমিয়ে দিচ্ছে এতে করে আগামী বছর অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
গত সপ্তাহে ব্লুমবার্গকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে রিপাবলিকান দলের অর্থনৈতিক সার্ভিসের চেয়ারম্যান পেটরিক ম্যাকহেনরি বলেন, সাধারণ মানুষকে শান্ত থাকতে হবে। যেকোনো ধরনের অস্থিরতা বড় রকমের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। মানুষ যখন তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যাবে তখনই বড় রকমের ঝামেলা বাধবে। আগামী কয়েক সপ্তাহ ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো ধরনের গুজব এড়িয়ে স্বাভাবিকভাবে চলতে পারলে সংকট সামাল দেয়া সম্ভব।
No comments: