· · মেহেরপুরের সাহিত্য:মুন্সী সাখাওয়াৎ হোসেন (১ জানুয়ারি ১৯৩৮ -১৪ অক্টোবর ১৯৯৫) লেখক,ভাষাসৈনিক,শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক ও সমাজসেবক -মুন্সী সাখাওয়াৎ হোসেন
ইস্ট-বেঙ্গল মেইল হু হু করে ছুটে আসতে আসতে সম্মুখে রানাঘাট স্টেশনে থেকে গেল। বিভিন্ন রকম শব্দে তৃতীয় শ্রেণীর বগীখানা পূর্ণ। একজন ঢাকার মুসলিম ভারতীয় নোট ভাঙ্গিয়ে নিচ্ছে। পাশ থেকে মধ্য বয়সী ভদ্র-লোকটি জিজ্ঞাসা করলো,‘কি মিঞা, টাকা ভাঙ্গাবেন?’ লোকটি কথা না বলে মাথা নাড়লো মাত্র। আরেকবার লোকটি ‘মিঞার’ উপর অকারণে জোর দিয়ে বললো,‘নিন না মিঞা, আমার কাছে অনেক বেশি আছে।’ ঢাকার লোকটা টাকা নিচ্ছে। ফস করে চেংড়া গোছের এক ছোকরা অকারণে বলে উঠলো‘টাকা বলতে হিন্দুস্থানের, কি বলেন?’ অমনি কামরা ভর্তি নর-নারীর মুখ চক্চক করে উঠলো , হাঁ হাঁ করে উটলো ডজন খানিক লোক। ঢাকার মানুষ, তায় আবার অশিক্ষত, ভিতরে ভিতরে বেশ তেতে উঠেছে। যতদূর সম্ভব মোলায়েম করে বলে উঠলো- ‘কিন্তু মশায়, নয়া পায়সা হালায়......।’ আর বলা হয় না, চতুর্দিক হতে মার মার কাট কাট শব্দ। শেষে মিটিয়ে দিলেন মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক, যাচ্ছেন ফরিদপুর, সঙ্গে স্ত্রী আর তান কন্যা। ‘পাকিস্থানে তো যাচ্ছ বাবা তবে কেন এতো!’ ইত্যাদি বলতে লাগলেন। ওষুধ ধরছে, সমবেত নর-নারী কটমট করে ঢাকার লোকটির দিকে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। গাড়িটা হ্যাঁচকা টানে পুনরায় চলতে শুরু করেছে। ফরিদপুরের লোকটা চেয়ে দেখলেন,রানাঘাট থেকে গাড়িটা ছেড়েছে। ঢাকার লোকটির চকিতে সহযাত্রীর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বাংকে উঠে গেল। কামরার সবাই যেন তার শত্রু। পাশের একটি তরুণ ফরিদপুরের সেই ভদ্রলোকের পাশে নড়ে চড়ে বসে জিজ্ঞাসা করলো-‘তা হলে আপনি হিন্দু?’ ‘হ্যা।’ ভদ্রলোকটি বেশ আলাপী ধরনের কথার জের টেনে বললেন-‘যাচ্ছি একটু ফরিদপুর। বাপ দাদার ভিটে বহুদিন ছেড়ে যেতে হয়েছে কিন্তু ভুলতে পারিনি আজও।’ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চুয়ে। আর কিছু বলতে হয় না। তরুণ অনর্গল বকে চলেছে। আগামী মাসে তার বিয়ে। নাম অরুণ। কি আর করবো, বিয়ের একমাস পিছিয়ে গেল ভিসার গন্ডগোলে। বলতে কি তার মার পছন্দ হয় না এসব বাজে জিনিস। আড় চোখে বাংকারের দিকে চেয়ে নিয়ে বল্লে-‘বুঝলেন তো পাকিস্তানের যা বাজার দর।’ ভদ্রলোকটি সামান্য ঠোঁট ফাঁক করে নেড়ে চড়ে বসবার সময় প্রশান্ত দৃষ্টিতে কন্যার প্রতি চাইলেন। পরে কি উত্তর দিলেন বোঝা গেল না। তরুণ বলে চলে-‘টাকার বাটা নিয়ে কি ঝামেলাই না সহ্য করতে হয়েছে আমাকে। পাকিস্তানের টাকার যা বাটা চাইল তাতে এক রকম ডাকাতি করার সমান, কি বলেন?’ ভদ্রলোকটি কোন উত্তর না দিযে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন-‘জল-টল খাবে নাকি? স্ত্রী মাথা নেড়ে বল্লেন-‘দর্শনায় খেলেই চলবে।’ পার্শ্বে দাঁড়ায় একটি ছেলে।দরজার ফাঁক দিয়ে মাথাটা গলিয়ে দিয়েছে বাইরে। মাথা সমেত দেহের অর্ধেকটা গাড়ির বাইরে, অর্ধেক ভিতরে। হাতে একটা ‘রূপাঞ্জলি।’ তরুণ ছেলেটার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞাসা করলো-‘কি দাদা কোন ক্লাসে পড়েন?’ ‘নাইনে।’ ‘নাইনে।’‘গীতাঞ্জলি প‘ড়ে বোঝেন? তরুণ রূপাঞ্জলিকে গীতাঞ্জলি বলে ভুল করেছিস। বাতাসে ওড়া চুলগুলোতে চকিতে হাত বুলিয়ে চোখে একটু টিপ্পনী দিয়ে উত্তর দিল ছোকরা-‘না বোঝার যে কি জ্বালারে দাদা তা যদি একবার বুঝতেন!’ আর কিছুই নয়। দেহের উর্ধাংশ আবার বেরিয়ে গেল জানালা দিয়ে। তাতে অনুনাসিক ‘দিল কে হাল শুনে দিল ওয়ালা’ গানের টান। অরুণ পাশের ভদ্রলোকের প্রতি মনোনিবেশ করে বলতে লাগলো তাদের অবস্থা। পাবনায় তাদের বাড়ি, কলেজে পড়ে। বাবা দিল্লীতে চাকরি করেন। তিনি আসবেন কয়েকদিনের মধ্যে। ওর মা পাকিস্তানের বাড়ি ছেড়ে যেতে চান না। বাবা মেসে থাকেন। মা যখন যান ওখানে এক বন্ধুর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেন। মন দিয়ে শুনছে তরুণী আর তার মা। মায়ের কোন পুত্র-সন্তান নেই। এই মেয়েটিই তাঁর একমাত্র সম্বল। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার মনের মধ্যে। অরুণ বলে চলে-‘মা বলেছেন, বাবাকে চাকরি ছেড়ে পাকিস্তানে চলে আসতে। আমরা না থাকলে জমিজমা সব হারিয়ে যেত। এখন আবার সেটেলমেন্ট হচ্ছে কি না।’ বাবা হিন্দুস্থানে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, মা দু‘দিন ভাত খান নি। মা বলেন-‘হিন্দুস্থানের মেয়েরা নির্লজ্জ।’ তাদের বেহায়া চালচলন তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না। মায়ের বাপ-মায়ের বাড়ি এবং স্বামীর বাড়ি দুটোই তো মুসলমান গ্রামে, তাই মা এখনো পর্দা মানেন। দিল্লী যেতে যে সময় লাগে তাতেই নাকি মা বুঝে ফেলেছেন হিন্দুস্থানের মেয়ে নিয়ে তাঁর চলবে না। ছেলে তো একটাই।’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে দেখে সে। তিনি মৌন। তবুও মুখে ফুটে উঠেছে স্নিগ্ধ একটি আভা। কথা শেষ করে তরুণটি নড়ে চড়ে বসে। ‘মা’র কিন্তু হিন্দুস্থানে বাজার করবার ভারী সখ। সস্তা।’ তরুণ বলে চলে। পাশের একটা লোক মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অমনি বলে ওঠে-‘তা কি বলতে মশাই। এই ধরুন চাকেশ্বরীর এক জোড়া বাজে ধুতি কিনতে যা লাগে তাতে হিন্দুস্থানের দুটো ‘ফাশ কেলাস’ ধুতি হয়।’ ‘ফাশ কেলাস’ কথাটি শুনে তরুণটি মুখ টিপে হাসে। বানপুর বর্ডার আউটপোষ্ট। গাড়িতে সাড়া পড়ে যায়। কারণ পুলিশ আর কাষ্টমের চেক হবে এখানে। কার ভাগ্যে কি ফলবে কে জানে! চারিদিকে নতুন কাপড় জামা পরার হিড়িক। এক বৃদ্ধ মেয়ের জন্য লাল সায়া আনছেন, সঙ্গে তার ননদ, সংকোচের সাথে তিনি নিজে পরে নিলেন সায়াখানা। নতুন পাতলা কাপড়ের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে লাল রঙ। পাশ থেকে বৃদ্ধার ননদ মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলো,- ‘আ মরণ।’ ননদের মেয়ের স্বাস্থ্য ভাল। কিন্তু তিনি নিজেই পরে নিলেন। কোন এক মুসলমান ধুতি পরছে। ধুতিপরা কোন দিন অভ্যাস নেই তার। সঙ্গী হিন্দু যাত্রী সাহায্য করছে তাকে কাপড় পরায়। মুসলমানটি আবার তার কয়েকটি কাপড়ের হেফাজত দিয়েছে কিনা। অনভ্যাসে আর গাড়ির দুলুনিতে তার ‘বস্ত্র-পরিধান-পর্বের’ দিকে কেই তাকাতে পারছে না লজ্জায়। কথা বন্ধ করে বিব্রত হয়ে পড়েছে অরুণ। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। তার সঙ্গে রয়েছে বিয়ের মূল্যবান শাড়ি, গহনা। অথচ সে নারী বর্জিত হয়ে একাই চলেছে। অন্যরা ইতিমধ্যেই উদ্বৃত্ত জিনিসপত্র বিলি ব্যবস্থা করে নিয়েছে। রানাঘাটের গুমোট ভাবটা কেটে গিয়ে একটা আত্মীয়তার পরিবেশ গড়ে উঠেছে। সম্মুখে আসন্ন সংকট। অরুণের সম্মুখে ফরিদপুরের সেই ভদ্রলোক ছাড়া আর কেউ নেই যার কাছে সে সাহায্য চাইতে পারে। অন্য কোন উপায়ও তার জানা নেই যাতে করে এতগুলো জিনিস সে বর্ডার দিয়ে পাস করিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এত বাজার করে নিশ্চিয়ই বোকামীর পরিচয় দিয়েছে সে। বাধ্য হয়ে অরুণ সেই ফরিদপুরের ভদ্রলোকের নিকট সাহয্য চাইলো । তিনি ‘না করতে পারলেন না। কেবল স্ত্রীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার চাইলেন। স্ত্রী মাথা নেড়ে সায় দিলেন। অরুণ আশ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু দেখা গেল বাজার করায় ছেলেটি দরাজ দিল। দুনিয়ার কাপড় কিনেছে যত। অরুণ সংকোচে প্রকাশ করে-‘বাবা দিল্লী থেকে কলকাতায় পিসীমার কাছে টাকা পাঠিয়েছিলেন কিনা তাই।’ ডিগ্রীর ক্লাসে পার হতে চললেও হিন্দুস্থান থেকে বাজার করে পাকিস্তানে আনা যে কি ঝামেলা, অরুণ তা আন্দাজ করতে পারি নি। তার ওপর বাজারটা আবার বিয়ের। ইতিমধ্যে তরুণী আর তার মা নতুন ট্রাঙ্ক খুলে ফেলেন। অরুণও বসে নেই। বিভিন্ন কায়দায় সাজানো হচ্ছে তার জিনিসগুলো; কিন্তু তবুও বিয়ের কয়েকটি শাড়ি আর চুড়ির ব্যবস্থা করা গেল না। বিব্রত হয়ে অরুণ স্বামী স্ত্রীর দিকে চাইল। অরুণ সংকোচে বলে উঠলো-‘আপনার মেয়েটি যদি পরে নিতেন! এই তো বানপুর আর দর্শনা।’ স্ত্রীর মুখখানা সাদা হয়ে গেল।’ স্বামীর মখেও ফুটে উঠেছে বিষন্নতা। কেন তা বোঝা গেল না। মেয়ের প্রতি চেয়ে ভদ্রলোক কেবল বললেন-‘ছেলে মানুষ, ওকে বাঁচাতে হবে তো!’ স্ত্রী চাইলেন অরুণের প্রতি। ছল ছল করছে যেন অরুণের চোখ দুটো। তিনি সব ভুলে গেলেন যেন। গয়না ক‘টা আর শাড়িখানা মেয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে এক রকম জোর করে নিয়ে চললেন পায়খানার দিকে। মেয়েটি নীরবে অনুসরণ করলো তার মাকে। কতক্ষণ পরে ঝাঁকি দিয়ে গাড়িখানা থেমে গেল বানপুর ষ্টেশনে। পাসপোর্ট নিয়ে গেল পুলিসে। মা মেয়ের নাম ধরে ডাকলেন ‘আয়মা, দীপা।’ হঠাৎ দরজা খুলে লজ্জারুণ মুখে দীপা বেরিয়ে এলো। কেন যেন মায়ের অন্তর ছ্যাঁৎ করে উঠলো, তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। পিতা নির্বিকার। অরুণ বার দুই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললো-‘পচাত্তর টাকা দিয়ে কেনা শাড়ি, কি চমৎকার দেখুন! তবুও মা বলেন কিনা-আমি কাপড় চিনি না। দীপা ঘামছে। গৌরবর্ণা তরুণীর মুখে লাল আভা দেখা দিয়েছে। লজ্জায় জড়সড় হয়ে সে বসে পড়লো নিজের জায়গায়। জর্জেটের ব্লাউজখানা ভিজে যাচ্ছে ঘামে। কাপড়খানা ঘাড়ের কাছ থেকে বার বার পিছলে পড়ে যাচ্ছে। নড়তে নড়তে খস্ খস্ করে উঠছে কাপড়টা। হাতের চুড়িগুলোও যেন বাধছে। কি বিশ্রী! কাষ্টম উঠে সবকিছু খুলে দেখছেন। অরুণকে জিজ্ঞাসা করলেন তার জিনিসের জন্য। অরুণ উত্তর দিল-‘বিয়ের বাজার, বুঝতেই তো পাচ্ছেন । কি করি বলুন।’ ‘থাক থাক বিয়ে ক‘রে ফিরছেন তো?’ ত্রস্তে সরে গেছেন তিনি ননদের পুঁটলির কাছে। দীপা নিশ্চল। কে যেন তার বুকের মধ্যে চেপে ধরছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন তার। গাড়ি থেকে নেমে যেতে যেতে অফিসারটি বললেন-‘তা দিদিমা যখন সখ করে বাহারী ডবল ব্লাউজ ডবল সায়া পরেছেন তখন এক পোঁচ সিঁদুরেই বা কি দোষ।’ মনে মনে বৃদ্ধা বলে উঠলেন, রাম রাম! ঘাটে পড়া।’ গাড়ি চেক হয়ে গেল। অকারণে দেরি করছে গাড়িখানা। মধ্যে স্তদ্ধতার ছাপ। দীপা আড় চোখে চেয়ে দেখলো অরুণকে। অরুণ ব্যস্ততার সঙ্গে এদিক ওদিক চেয়ে দেখছে। কে জানে আবার কোন নতুন বিপদ এসে পড়ে কি না! মনে মনে সকলে ইষ্ট দেবতা আর আল্লা খোদা নাম জপ করছে। সতর্ক দৃষ্টিতে কেউ কেউ লুকানো জিনিসের দিকে চেয়ে দেখছে বার বার ; হাতও দিয়ে দেখছে কেউ। গাড়ি ছেড়েছে ষ্টেশন থেকে। বানপুর বর্ডার আউট পোষ্ট ছেড়ে চলছে পাকিস্তানের দিকে। হঠাৎ বাংক থেকে ঢাকার লোকটা ঝুপ করে লাফিয়ে পড়লো গাড়ির মেঝেতে। পরনের লুঙ্গীখানা সামলাতে পারেনি, তাই হাঁটুর অনেক উপর পর্যন্ত উঠে গেল। মুখ ফিরিয়ে নিল সকলে। কি করবে তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীতো। লোকটা ধুতি ছেড়ে লুঙ্গী পরেছে বাংকের উপর বসে, কেউ জানে না। সে কেবল দীপার বাবাকে সম্মান জানালো। কারণ, তিনিই রানাঘাটে তার মুখ রক্ষা করেছেন। লোকটি চৌরঙ্গী থেকে কেনা একটা বিড়ি বের করলো পকেট থেকে। রানাঘাট ষ্টেশনে ভারতীয় নোটের প্রশংসাকারীর ঠিক সামনে গিয়ে বসলো। সকলের দিকে চেয়ে দেখলো লোকটি, যেন সকলে তাকে শ্রদ্ধা করছে। বিড়ির সম্মুখ ভাগ মুখে পুরে একটা জোরে ফুঁ দিলো। উড়ে বেরিয়ে গেল কতক ধুলো। ম্যাচটা ঠুকে বিড়ি ধরিয়ে একগাল ধোঁয়া ছাড়লো সম্মুখে। সামনে বসা ছেলেটা আর পাশের মেয়েগুলো মুখ ঘুরিয়ে নিলো বিরক্তির সাথে। দর্শনা। আবার সকলে স্তব্ধ। পাসপোর্টের ঝামেলা চুকলো। কিন্তু লেডী কাষ্টম-চেকারটি এদিকে দীপাকে নিয়ে পড়েছে। লেডী কাষ্টমের ছোট চুলে লম্বা ট্রাসেল ঝুলানো, কোমরের অনেক নীচে নেমে এসেছে। ঘাড়ে মুখে তীব্র প্রসাধনী। আসল রং ধরা যায় না। চলনে-বলনে অফিসারী ভঙ্গী। বড় অন্যায় করে ফেলেছে অরুণ। কত অনুনয় বিনয় করছে সে। কিন্তু কিছুতে গ্রাহ্য নেই লেডীর। ইংরিজির বুকুনি দিয়ে সমানে বলে চলছে সম্ভাব্য শাস্তির কথা। একজন পুরুষ কাষ্টম এসে গেল দরজার কাছে। ঢাকার লোকটা তাকে মোগলাই সালাম জানালো। মুসলমান জাত ভাই তায় আবার রাজধানীর লোক। অফিসাররা গ্রহ্য করে না এগুলো। সোজা গাড়িতে উঠে গেল লেডি চেকারের কাছে। তার গায়ে হেলান দিয়ে ট্রাঙ্কের জিনিস দেখে নিল। সকলে সন্ত্রস্ত। অরুণ প্রাণপণে অফিসারকে বোঝাতে চেষ্টা করলো। অফিসারটি চোখের ইশারায় তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলো। কিছু পরে প্রসন্নচিত্তে অরুণ নিজের স্থানে ফিরে এলো।অফিসারটি সঙ্গে সঙ্গে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে লেডী চেকাররের নাম ধ‘রে ডাকলো, অনুরোধ জানালো তাকে নেমে আসতে। কিছুতেই ছাড়বে না লেডী অরুণকে। অফিসার প্লাটফরম থেকে মৃদু হেসে বললো, ‘কি দুষ্টমি কর, জানো না ছেলেটি বিয়ে করে আসছে বৌ নিয়ে। তুমি কিছুই বুঝবে না?’ চকিতে মহিলা-চেকার আড়চোখে চাইলো অফিসারের দিকে। অফিসারটি হা বড় ক‘রে হাসছে। নেমে গেল মহিলা-চেকার কপাল রাঙা ক‘রে, লজ্জায় নয়, প্রসাধনের গুণে। ঘোমটার আড়ালে দীপা ঘামছে। দর দর করে বেরিয়ে আসছে রক্ত জল হয়ে। দর্শনা থেকে গাড়ি ছাড়লো। কারো মুখে কথা নেই। সকলে বোবা হয়ে গেছে যেন। দীপার যেন নেশা ধরেছে। সে অনেক দিন পূর্বের স্মৃতি, সেদিন সে এমনি রাঙা কাপড়ে শশুর বাড়ি গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল দেবতার মতো স্বামী। ভগবান বাধ সাধলেন তাতে। কৈশোরের সে স্মৃতি আর মনেই হতে চায় না। আজ কেমন যেন একটা তীব্র অনুভূতি জাগে তার সারা দেহ-মনে। জর্জেটের ব্লাউজখানা এঁটে ধরেছে তার শরীর। বার বার সে শিউরে উঠছে। বেঞ্চের উপর পা‘দুটা জোর করে ধরে সে হেলান দিয়েছে। মুখখানা নীচু হয়ে আছে। ঘন দীর্ঘ অথচ চাপা নিশ্বাসের শব্দ বেরিয়ে আসছে গাড়ির দুলুনির সাথে সাথে। অরুণ পোড়াদহে এসে কাপড়, জিনিসপত্র গোছাতে লাগলো। দীপার মায়ের খেয়াল হলো সব। মেয়ের হাতের চুড়ি খুলে দিলেন তিনি। কাপড় গুছিয়ে নিল অরুণ। বার বার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সে নেমে গেল ইশ্বরদির ট্রেন ধরতে। আবার নিরাভরণ হলো দীপা। বার দুই চাইলো সে অরুণের প্রতি। অবহেলা আর হতাশায় ভরা সে চাহনি। বহুদিন পরে তার দেহ-মন রাঙিয়ে নেবার অধিকার সে পেয়েছিল। ভগবানকে সে দায়ী করেছিল,একদিন তাকে বিধবা করার জন্য। আর দায়ী করেছিল তার ভাগ্যকে। দীপার সর্ব শরীরে ক্লান্তি নেমে এসেছে। তিক্ত একটা স্বাদে মুখটা ভরে উঠেছে যেন। কুষ্টিয়া মেইন ষ্টেশন। দীপার চিবুক তুলে ধরে মা বললেন-‘একটু জলটল মুখে দে মা।’ দীপার চোখে সীমাহীন দৃষ্টি। চিক্ চিক করছে তার দুই চোখের কোণ। ( গল্পটি ১৯৫৭ সালে কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘সংকেত’ –এ প্রকাশিত হয়েছে) মুন্সী সাখাওয়াৎ হোসেন (১ জানুয়ারি ১৯৩৮ -১৪ অক্টোবর ১৯৯৫) লেখক,ভাষাসৈনিক,শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক ও সমাজসেবক।তিনি মেহেরপুর থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক সীমান্ত পত্রিকা প্রধানতম লেখক ছিলেন। এই পত্রিকা তিনি মেহেরপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ গল্প ও নিবন্ধ রচনা করতেন। তিনি ১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি মেহেরপুরের মুজিবনগরের বাগোয়ানে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম আলো (০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) পত্রিকায় বিশিষ্ট ভাষা আন্দোলনের গবেষক আহমদ রফিক ‘মেহেরপুরের উত্তাল দিনগুলি’ শীর্ষক লেখায় লিখেছেন,মুন্সী সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে আওলাদ হোসেন, কাওসার আলী, ইসমাইল হোসেনসহ মেহেরপুর স্কুলের ছেলেরা পোস্টারিং, পিকেটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৫ সালের ১৪ অক্টোবর ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুন্সী সাখাওয়াৎ হোসেন মৃত্যুবরণ করেন।মরহুম মুন্সী সাখাওয়াৎ হোসেন দীর্ঘদিন মেহেরপুর জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং দীর্ঘকাল মেহেরপুর কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দাযিত্ব পালন করেছেন। একজন সমাজসেবক এলাকায় তিনি ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিলেন।Slider
বিশ্ব
জাতীয়
মেহেরপুর জেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
মেহেরপুর সদর উপজেলা
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Home
»
Education
»
Featured
»
others
»
pedia
»
politics
» · · মেহেরপুরের সাহিত্য:মুন্সী সাখাওয়াৎ হোসেন
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News
No comments: