আমরা জানি যে, উনবিংশ শতাব্দীর ষষ্ঠ-সপ্তম দশকে ইংরেজরা ফারাজী ও ওহাবী প্রভৃতি ধর্মীয়-রাজনৈতিক আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করে। এর পরের বিশ থেকে পঁচিশ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনও নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ইংরেজ রাজত্ব শুরু হবার পরে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত হিন্দু সমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে যে বিষ সংক্রমিত হয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মুসলমানের মধ্যেও তা অনুপ্রবিষ্ট হতে থাকে। এ সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় কিছু মুসলমান খ্রীস্টান হতে থাকে। অশিক্ষা, নিজ ধর্মের প্রতি শিথিল বিশ্বাস এবং আর্থিক ও সাংসারিক মোহই স্বধর্ম ত্যাগ করে তদানীন্তন রাজধর্ম গ্রহণে সেদিন মুসলমানদেরও প্রেরণা যুগিয়েছিল। হিন্দু সমাজকে শতাব্দীর শুরুতে এ ধরনের খ্রীস্টানধর্ম-মুখিতা থেকে বাঁচিয়েছিলেন রামমোহন। শতাব্দী শেষে মুসলমানদের মধ্যে আন্দোলন আরম্ভ করেন যশোর নিবাসী বাগ্মীপ্রবর মুন্সী মেহেরুল্লাহ এবং তাঁরই হাতে দীক্ষিত ধর্মান্তর গ্রহণকারী মুন্সী মোহাম্মদ জমিরুদ্দীন। এঁদের প্রধান অবলম্বন ছিল ওয়াজ। গ্রামে গ্রামে জেলায় জেলায় বক্তৃতা করে মুন্সী মেহেরুল্লাহ আশাতীত ফল লাভ করেছিলেন। বাঙালী মুসলিম সমাজকে রক্ষা করার ব্যাপারে মুন্সী মেহেরুল্লাহর দান অবশ্য অশেষ, কিন্তু তিনি কিংবা তাঁর অনুগামী জমিরুদ্দীন সংঘবদ্ধভাবে মুসলিম সমাজের মধ্যে চেতনা সৃষ্টি সেদিন করতে পারেননি। এঁদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এ যুগের বাঙালী মুসলমানকে ইসলামমুখী করে তুলেছিল একটি বিশেষ দল। সে দলটিকে ‘সুধাকর দল’ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন খুলনা জেলার সাতক্ষীরার অন্তর্গত বাঁশদহের অধিবাসী এবং কলকাতা ডভটন ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের আরবী ও ফারসীর অধ্যাপক মৌলবী মেয়রাজউদ্দীন আহম্মদ, ময়মনসিংহের টাঙ্গাইলের অন্তর্গত চাড়ানের অধিবাসী এবং কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার বাংলা ও সংস্কৃতের অধ্যাপক পণ্ডিত রেয়াজউদ্দীন আহমদ মাশহাদী, বসিরহাটের মোহাম্মদপুর নিবাসী মুন্সী শেখ আবদুর রহিম এবং ত্রিপুরা জেলার রূপসার অধিবাসী মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ। আর্থিক ও সাংসারিক প্রলোভনে পড়ে কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাঙালী মুসলমানেরা যে সেদিন খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল, তা থেকে তাদের বাঁচানোর একমাত্র পথ ছিল তাদেরকে ইসলামী ঐতিহ্য এবং মুসলমানের জাতীয় ইতিহাস সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা। এতে সিদ্ধি লাভ করার জন্যে মাতৃভাষায় জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টি করে সর্বসাধারণের মধ্যে পরিবেশন করা এবং সংবাদপত্রাদির মাধ্যমে ধর্ম ও কৃষ্টিমূলক বিষয়বস্তুর আলোচনা করে মুসলিম জনসাধারণের দৃষ্টি ফুটিয়ে তোলাই ছিল প্রশস্ত পথ। উল্লিখিত মনীষীবৃন্দ এ সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কলকাতায় একটা দল বাঁধলেন এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রথমত মুসলিম কৃষ্টি এবং ইসলামের তত্ত্ব-কথা সংক্রান্ত কতকগুলো বই-এর অনুবাদ করে খণ্ড খণ্ড আকারে প্রকাশ করতে লাগলেন। ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে সুপণ্ডিত এবং অভিজ্ঞ মনীষী জালালুদ্দীন আফগানী কর্তৃক ফারসী ভাষায় রচিত ‘নেচার এবং নেচারিয়া’ নামক গ্রন্থের অনুবাদ করে ‘এসলাম তত্ত্ব’ নাম দিয়ে প্রথম খণ্ড প্রকাশ করলেন। এর অল্পদিন পরেই মাওলানা আবদুল হক হাক্কানীকৃত ‘তফসিরে হাক্কানী’র উপক্রমণিকাভাগ থেকে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদক বিষয়সমূহ অনুবাদ করে এঁরাই ‘এসলাম তত্ত্ব’ দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করলেন। ‘এসলাম তত্ত্ব’ (বা মুসলমান ধর্মের সার সংগ্রহ) এর প্রথম খণ্ড ১২৯৪ সাল, আশ্বিন মাসে অর্থাৎ ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দে এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১২৯৫ সাল-১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ‘এসলাম তত্ত্ব’ খণ্ডাকারে ধারবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো বলে অনেকেই একে মাসিক পত্রিকা মনে করতেন। এসলাম তত্ত্ব খুব বেশি দিন চলেনি। তবু এর বিক্রয়লব্ধ অর্থে এবং ময়মনসিংহ করটিয়ার জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলী খান এবং বর্ধমানের কুসুমগ্রামের জমিদার মুন্সী মোহাম্মদ এবরাহিমের অর্থানুকূল্যে শেখ আবদুর রহিম এবং মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ ‘সুধাকর’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১২৯৬ সালের (১৮৮৯) আশ্বিন মাসে প্রথম সংখ্যা ‘সুধাকর’ প্রকাশিত হলো। ‘সুধাকর’ পত্রিকা নানা বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে বেশ কিছুদিন চলেছিল। এ পত্রিকার মাধ্যমেই বাংলা ভাষায় বাঙালী মুসলমানেরা তাদের ধর্মের মহিমা, তত্ত্ব, তথ্য, জাতীয় ঐতিহ্য ও গৌরব সম্বন্ধে কিছুটা সচেতন হয়েছিল। সেকালে বঙ্কিম প্রমুখ মুসলিম- বিরোধী লেখক মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে সব লেখা লিখতেন, ‘সুধাকরে’ তার প্রতিবাদ বের হতো। ‘সুধাকর’ দল সাহিত্য ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবার পূর্বে আধুনিক বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি পথে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে কেউ যে অগ্রসর হয় নি, তা নয়। এ দলের বহু আগে থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে মীর মশারফ হোসেন বাংলা সাহিত্য সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁর আগে শামসুদ্দীন মুহম্মদ সিদ্দিকীকে দেখা যায়। তাঁর ‘ভাবলাভ’ এবং ‘উচিত শ্রবণ’ ১৮৬৫ সালের আগেই রচিত ও প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাংলায় মুসলিম জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির নেশায় এঁরা যেমন করে মেতেছিলেন এবং প্রাণঢালা সাধনা করেছিলেন, এঁদের আগে তেমন আর কাউকে দেখা যায় না। তাছাড়া এমন সচেতন জাতীয়তাবোধও তাঁদের আগের কোনও মুসলমান-রচিত সাহিত্যে এমনভাবে ফুটে ওঠেনি। এঁরা আরবি ফারসী সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেছেন, হযরত মহাম্মদের (সাঃ) এবং অন্যান্য পীরপয়গম্বরের, খলিফাদের এবং তাঁর সাহাবীরা এবং ওলি আল্লাদের জীবনী লিখেছেন, ইসলাম ধর্মের গৌরবগাথা রচনা করেছেন, তার মহিমা ব্যাখ্যা করেছেন। একটি জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা তার মনোজীবনের স্পন্দন এবং অন্তর ও বহির্জীবনের প্রকাশে যে তার জাতীয় বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক এঁদের এ বোধ ছিল প্রখর। বাঙালী মুসলমান জাতির ঘোর দুর্দিনে এঁরাই সে জাতিকে ঘরমুখো করেছিলেন এবং নিজেদের চিনতে সহায়তা করেছিলেন। এক কথায় এ ‘সুধাকর’ দলই যেভাবে মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্যের ভিত্তি রচনা করেছিলেন সে পথেই অর্ধ শতাব্দীব্যাপী সাধনায় বাঙালী মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য বিকশিত হয়েছে। অন্য কথায় মুসলিম জাতি এবং এ জাতির সাংস্কৃতিক জীবনের ধারা এঁদেরই হাতে লালিত ও বর্ধিত হয়েছে। মুসলিম বাংলা সাহিত্যে ‘সুধাকর’ দলের ভূমিকা এ দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই বিচার করতে হবে। পরবর্তী মুসলিম সাহিত্যিকদের জন্যে এঁরা পথ তৈরি করে দিয়ে গেছেন এবং সে কারণেই আমাদের জাতীয় জীবনেও নবীন অধ্যায়ের সংযোজন করেছেন এবং বাঙালী মুসলমানের মনে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করে নব গৌরবের সূচনা করেছেন। এঁদের রচিত সাহিত্যের মূল্য যেমনই হোক না কেন, স্থান কাল পাত্র বিচারে বাংলা সাহিত্যে এঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁদের কৃতিত্ব বিচারের পর সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত তাঁদের প্রদর্শিত পথে যে সাহিত্য বাংলায় রচিত হয়েছে, এর পরে তার ধারাবাহিক আলোচনা লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। মোটামুটিভাবে এ শাখার নাম ইসলামী সাহিত্য শাখা রাখা যেতে পারে। এ শাখায় মৌলিক গ্রন্থ, অনুবাদ, জীবনী সাহিত্য, দর্শন ও তত্ত্বালোচনা এবং হাদীস ও কোরআনের অনুবাদ, সংকলন ও আলোচনা পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছে। একই উদ্দেশ্যের পরিপোষক বলে বিভিন্ন পরিচ্ছেদে বিভক্ত না করে ‘ইসলামী সাহিত্য’ শীর্ষক একই পরিচ্ছেদে এর সবটুকুরই আলোচনা করা যেতে পারে। মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ(১৮৬১-১৯০৭): এ শাখার শুরুতে পাচ্ছি, মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহকে। তিনি যশোহর জেলার অধিবাসী ছিলেন। সংঘর্ষ মানুষের শক্তি বৃদ্ধির কারণ। মুন্সী মেহেরুল্লাহ ছিলেন সাধারণ মোল্লা মানুষ। অথচ খ্রীস্টান ধর্মের সঙ্গে প্রবল সংঘর্ষের ফলেই তাঁর সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত হয়েছিল। পাদ্রী জমিরুদ্দীনের সঙ্গে ধর্ম বিষয়ে তাঁর বাদানুবাদ হয়। ১৮৯২ খ্রীস্টাব্দে ‘খ্রীস্টীয় বান্ধব পত্রিকায়’ জন জমিরুদ্দীন ‘আসল কোরআন কোথায়?’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। উক্ত সালের ২০শে ও ২৭শে চৈত্র এবং পরবর্তী বৎসরের ২রা বৈশাখ ও ২৭শে জ্যৈষ্ঠ (১৩০০ সাল) ‘সুধাকর’ পত্রিকায় মুন্সী মেহেরুল্লাহ ‘ঈষায়ী বা খ্রীস্টানী ধোঁকা ভঞ্জন’ নামক একটি গবেষণামূলক সুদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এ প্রবন্ধটি পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এতে মুন্সী মেহেরুল্লা অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে জমিরুদ্দীন কর্তৃক উত্থাপিত ছয়টি প্রশ্নের উত্তর দেন। ধর্ম সংক্রান্ত বাদানুবাদে পরাজিত হয়ে জন জমিরুদ্দীন মুন্সী মেহেরুল্লাহ্র কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং মুন্সী জমিরুদ্দীন নাম নিয়ে ইসলাম প্রচার ও রক্ষায় তাঁর সহকর্মী হয়ে ওঠেন। মুন্সী মেহেরুল্লাহর অন্যান্য বই: ১. খ্রীস্টীয় ধর্মের অসারতা (১৮৮৬) ২. মেহেরুল ইসলাম (১৮৯৭) ৩. বিধবা গঞ্জনা ও বিষাদ-ভাণ্ডার (৩য় সংস্করণ ১৯০০) ৪. পান্দেনামা (২য় সংস্করণ ১৯০৮) ৫. হিন্দু ধর্ম-রহস্য ও দেবলীলা (১৮৯৬)। ৬. খ্রীস্টান-মুসলমান তর্কযুদ্ধ। ৭. রদ্দে খ্রীস্টীয়ান ও দলিলোল এসলাম (১৮৯৫)। ৮. বাবু ঈশানচন্দ্র মণ্ডল এবং চার্লস্ ফ্রেঞ্চের ‘এসলাম গ্রহণ’ (সংগৃহীত)। ৯. শ্লোকমালা। মুসলিম সমাজের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ‘মেহেরুল ইসলাম’ বাংলা পুঁথির ধরনে লিখিত। এই পুস্তকের গোড়াতে হযরত রসূলে করিমের ‘নাত’ বা স্ততি বন্দনা আছে। আজও বহু বক্তা বা ওয়ায়েজ দরুদশরীফের মতো এগুলো আবৃত্তি করে থাকে। উক্ত গজলের শুরুতে এবং শেষে এ রকমের ধুয়া আছে: গাওরে মোসলেমগণ, নবীগুণ গাওরে। পরান ভরিয়া সবে সল্লেআলা গাওরে। ‘মেহেরুল ইসলাম’ পুস্তকখানির একটা অসাধারণ বিশেষত্ব ছিল। এর ভাষা অত্যন্ত সরল এবং সর্বসাধারণের বোধগম্য অথচ রচনায় লালিত্য ও মাধুর্যের অভাব নেই। তাঁর বিখ্যাত ‘রদ্দে খ্রীস্টীয়ান ও দলিলোল এসলাম’ নামক পুস্তকটি খ্রীস্টান পাদ্রীগণের আক্রমণের পাল্টা জবাবস্বরূপ খ্রীস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে লিখিত হয়েছিল। এ পুস্তকটিতে মুন্সী মেহেরুল্লাহর প্রগাঢ় ধর্মজ্ঞান ও বাস্তববুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। সমাজ সেবা এবং খ্রীস্টান ধর্মের কবল থেকে ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের রক্ষা করাই ছিল তাঁর সাহিত্য কর্মের মূল প্রেরণা। মুন্সী মোহাম্মদ জমিরুদ্দীন(১৮৭০-১৯৩০): মুন্সী মোহাম্মদ জমিরুদ্দীন ইসলাম ধর্ম প্রচারে মুন্সী মেহেরুল্লাহর সহচর ছিলেন। নদীয়ার মেহেরপুর মহকুমার গাঁড়োডোবা গ্রামে তিনি ১৮৭০ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মুসলমান ছিলেন, কিন্তু সেকালের খ্রীস্টান মিশনারীদের সংস্পর্শে এসে ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দে ২৫শে ডিসেম্বর খ্রীস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। মুন্সী মেহেরুল্লাহর সঙ্গে ধর্ম সংক্রান্ত বাদানুবাদে লিপ্ত হয়ে আবার ইসলাম ধর্মের আশ্রয়ে ফিরে আসেন এবং তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধর্ম প্রচার ও রক্ষা কার্যে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাঁর ‘রদ্দে খ্রীস্টান’ সম্পর্কিত পুস্তিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘ইসলামের সত্যতা সম্বন্ধে পরধর্মাবলম্বীদিগের মন্তব্য’ (সংকলিত), পৃঃ ৫৯, প্রথম প্রকাশ ১৩৩৭ (১৯০০ খৃঃ)। হিন্দু ও খ্রীস্টানেরা ইসলামের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে যেখানে যা কিছু লিখেছেন তার কিছু অংশ গ্রহণ করে তিনি পরধর্মাবিলম্বীদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলবার জন্য এ বইটি বের করেছিলেন। এ বইটির চতুর্থ সংস্করণ ১৩২২ সালে এবং পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশিত হয় নদীয়া গাঁড়াডোবা থেকে ১লা শ্রাবণ, ১৩৩৩ সালে। তিনি এ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন নদীয়া-চাঁপা-তলা নিবাসী ইসলামধর্মপ্রাণ মুন্সী মোহাম্মদ ফজলে করিম ওরফে মোহাম্মদ ফুলবাস সাহেবকে। তাঁর দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য বই ‘ইসলামী বক্তৃতা’। এটি অনুবাদ সংকলন। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৮। ১৩২২ সালে তৃতীয় সংস্করণ বের হয়। তৃতীয় বই ‘শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) ও পাদ্রীর ধোঁকা ভঞ্জন’ প্রকাশিত হয় ১৩২৩ সালে। এটিই মুন্সী জমিরুদ্দীনের শ্রেষ্ঠ রচনা। এ বইটিতে একদিকে হযরত মহাম্মদের জীবনী আলোচনা ও মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করেছেন, অন্যদিকে তিনি খ্রীস্টান পাদ্রীরা কিভাবে মুসলমানদের ধোঁকায় ফেলে খ্রীস্টান করতো তার রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। তাঁর কবিতার বই ‘শোকানল’ (পৃঃ ২৪)-এর ৩য় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩২৩ সালে। এ ছাড়া ‘আসল বাঙ্গালা গজল’ নাম দিয়ে দরূদ শরিফ ও মোনাজাত (পৃঃ ৪৮, ১৩১৫ সাল) সংকলন করেন। ‘বিশুদ্ধ খতনামা’ (পৃঃ ৩৬) নামেও তাঁর একটি পুস্তিকা ছিল। মুন্সী মেহেরুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে জমিরুদ্দীন একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাঁর ‘মেহের চরিত’ (১৯০৭ খ্রিঃ) নামক পুস্তিকায় এ প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়। এছাড়া তিনি ধর্মপ্রচারমূলক আরও কয়েকটি পুস্তিকা প্রণয়ন করেছিলেন। তাঁর নামের শেষে ‘বিদ্যাবিনোদ ও কাব্যনিধি’ উপাধি ব্যবহার করা হতো। শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯-১৯৩১): ঊনবিংশ শতাব্দীর মুসলিম বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগের আলো এবং সুধাকর দলের সুধী প্রধান ছিলেন শেখ আবদুর রহিম। জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির জন্য ঐকান্তিক অনুরাগ, নিষ্ঠা এবং সাধনা তাঁর মতো আর কারুর ছিল না। সাহিত্য সাধনা ছিল তার জীবনের মহান ব্রত। মুসলমানের জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির নেশা যে শুধু তাকে পেয়ে বসেছিল, তা নয়, বাঙালী মুসলমান যে এক বিরাট ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী এবং মানব সভ্যতায় ইসলাম যে সুমহান দান রেখে গেছে, সে সম্বন্ধে বাঙালী মুসলমানকে অবহিত করতে হলে তার নিজ মাতৃভাষায় তার নিজস্ব সাহিত্য তাকে রচনা করতে হবে এ সত্যও তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন। সেজন্যই জাতির সেবায় তিনি নিজেকে এমনভাবে নিয়োজিত করেছিলেন। ‘Literature, in a word, was with him not so much an end in itself but as a means to a further end, which was national not individual.’ আবদুর রহিমের পক্ষে এ কথা যে কত সত্য, সেকালের বাঙালী মুসলমান সমাজ ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে তাঁরাই তার মর্মানুধাবন করতে পারেন। শেখ আবদুর রহিম রচিত গ্রন্থাদিঃ ১. হজরত মোহাম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি (ফাল্গুন ১২৯৪ সাল, ১৮৮৭ খ্রীঃ) পৃঃ ৯৫৮। ২৮ বছর বয়সে লিখিত শেখ আবদুর রহিমের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ, ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দে। প্রায় সহস্র পৃষ্ঠাব্যাপী এ বৃহৎ গ্রন্থখানির নাম থেকেই এ গ্রন্থের বিষয়বস্তুর এবং গ্রন্থকারের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। হযরতের জীবনী এবং ইসলামধর্মের মূলনীতি এ গ্রন্থে সুবিন্যস্ত এবং পুংখানুপুংখভাবে আলোচিত হয়েছে। এছাড়া স্থান ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম কিভাবে বিস্তার লাভ করেছিল তারও বিশ্লেষণ তিনি এ গ্রন্থে করেছেন। এটিই শেখ আবদুর রহিম রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ২. ‘ইসলাম ইতিবৃত্ত’ (History of the Moslem World)। ‘ইসলাম ইতিবৃত্ত’ (অর্থাৎ খোলাফায়ে রাশেদিনের সময় হইতে মুসলমান ধর্ম ও সাম্রাজ্য বিস্তারের ধারাবাহিক ইতিহাস) প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯১০ খ্রীস্টাব্দে। ‘হজরত মুহম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’ এবং ‘ইসলামের ইতিবৃত্ত’ একত্রে মিলিয়ে শেখ আবদুর রহিম মুসলিম জগতের পূর্ণ ইতিহাস রচনা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর কথায় ‘হজরত মুহম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’ ইসলামের ইতিবৃত্তের প্রথম খণ্ডরূপে গ্রহণ করিতে পারেন। তৎপর খলিফাগণের ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ডরূপে গৃহীত হইবে।’ এ ইতিবৃত্ত খেলাফায়ে রাশেদীন থেকে আরম্ভ করে বনি ওস্মিয়া, বনি আব্বাসিয়া, বনি ফাতেমিয়া এবং স্পেনের বনি ওস্মিয়া প্রভৃতি প্রাচীন বংশের ইতিবৃত্ত এবং প্রত্যেক বংশের শাসনকালে তাদের রাজনীতি, সমাজ নীতি, শিক্ষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিল্পবিজ্ঞান ও ধর্ম-বিস্তৃতি প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হবার কথা ছিল। এছাড়া ভারতবর্ষ, চীন, ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ ও আফ্রিকার অন্যান্য স্থানে ইসলাম বিস্তৃতি ও মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্তও ধারাবাহিকরূপে লিপিবদ্ধ হতো। এ সুবৃহৎ পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যে প্রতি মাসে খণ্ডাকারে ইসলামের ইতিবৃত্ত বের করার ব্যবস্থা করা হয়। ১৩১৭ সাল অর্থাৎ ১৯১০ খ্রীস্টাব্দে প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড বের হবার পর, আমাদের দুর্ভাগ্য যে এর প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। ৩. ইসলাম-নীতি, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড (১৯২৫, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ)। কোরআন ও হাদীসের উপদেশাবলী (১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ)। ৪. নামাজ তত্ত্ব বা নামাজ বিষয়ক যুক্তিমালা (পৃঃ ২০০) ১৩০৩ সাল, ১৮৯৮ খ্রীস্টাব্দ)। ৫. হজবিধি-১ম খণ্ড, পৃঃ ১৯০ (১৩১০ সাল, ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দ)। ৬. রোজাতত্ত্ব (পৃঃ ১৩০), (১৩৩৪ সাল, ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দ): এতে রোজার আবশ্যকতা, মাহাত্ম্য, সৌন্দর্য ও উপকারিতা প্রভৃতি বিষয় কোরআন ও হাদীস শরীফ থেকে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং রোজার বিরুদ্ধবাদীদের আপত্তিসমূহ যুক্তি ও তর্ক দিয়ে খণ্ডন করা হয়েছে। ৭. খোৎবা (অর্থাৎ জুম্ম্ম, ঈদুল ফেতর, ঈদুজ্জোহা ও বিবাহের খোৎবা) রচনা ১৩৩২ এর পূর্বে, প্রকাশ ১৩৩৯ সাল অর্থাৎ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে (পৃঃ ৬৪)। ৯. এসলাম তত্ত্ব। এছাড়া পণ্ডিত রিয়াজউদ্দীন মাশহাদী রচিত ‘সুরিয়া বিজয়’ তিনি প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থটি ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ‘সুরিয়া বিজয়’ হয়ত আবুবকর সিদ্দিক কর্তৃক সিরিয়া বিজয়ের কাহিনী। ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের সম্পর্কে এ বইগুলো ছাড়াও তিনি ‘ওয়াশিংটন আরভিং’-এর ‘টেলস্ অব্ আল্ হামারা’র ‘পিলগ্রিজ্ অব লাভ’ নামক গল্পটির অনুবাদ করে ‘প্রণয়-যাত্রী’ নাম দিয়ে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিলেন। পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদে এর আলোচনা করা হয়েছে। শেখ আবদুর রহিম কত বড়ো সাহিত্যব্রতী ছিলেন এসব পত্রপত্রিকার সম্পাদনা থেকে তার আরও সুষ্ঠু পরিচয় পাওয়া যায়: ১. সুধাকর (সাপ্তাহিক)। ২. মিহির (মাসিক)। ৩. মিহির ও সুধাকর (সাপ্তাহিক)। ৪. হাফেজ (মাসিক)। ৫. মোসলেম প্রতিভা (মাসিক)। ৬. মোসলেম হিতৈষী (সাপ্তাহিক)। ৭. ইসলাম দর্শন (মাসিক)। শেখ আবদুর রহিম ১৩৩৬ সালের (১৯২৯ খ্রীঃ) মাসিক ‘মোহাম্মদী’তে ভাদ্র থেকে পৌষ পর্যন্ত পাঁচ সংখ্যায় বঙ্গ ভাষা ও মুসলমান সমাজ সম্বন্ধে একটি সুচিন্তিত ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখেন। এ প্রবন্ধটিতে সেকালের মুসলিম বাংলা সাহিত্যের এবং সাহিত্যসেবীদের সম্বন্ধে একটা স্বচ্ছ আলোচনার প্রয়াস তিনি পেয়েছেন। শেখ আবদুর রহিমের সমগ্র সাহিত্য সাধনা ও সাহিত্য কীর্তির পথে তাঁকে প্রেরণা যুগিয়েছে জাতির জন্যে ঐকান্তিক দরদ এবং বাংলা সাহিত্য সাধনায় বাঙালী মুসলমানের উদাসীনতার জন্য তীব্র বেদনাবোধ। এমন স্বজাতি স্বধর্ম ও স্বসাহিত্যপ্রাণ বাংলা সাহিত্যসেবী মুসলমান খুব কমই দেখা গেছে। তাঁর চিন্তায় পরিচ্ছন্নতা ছিল, সে জন্য তাঁর বলার ভঙ্গীও ছিল সুস্পষ্ট এবং জোরালো, তার ভাষার বাঁধন শিথিল নয়, গুরুগম্ভীর সংস্কৃতানুসারী এবং ছন্দোময়, প্রকাশভঙ্গী সাবলীল এবং তীক্ষ্ম। বাংলা ভাষায় তাঁর যে অসাধারণ অধিকার ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মওলানা মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০); মওলানা মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী ১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার অন্তর্গত আড়ালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি রংপুর জেলার একটি সিনিয়ার মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হন। এখানে অবস্থানকালেই তিনি ইসলাম প্রচার ও শিক্ষা বিস্তারে প্রবৃত্ত হন এবং কর্মবহুল জীবনযাপন করার পর ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দে ২৪শে অক্টোবর তারিখে পরলোকগমন করেন। চট্টগ্রামের অপর নাম ‘ইসলামাবাদ’। কর্মজীবনে তাই ‘ইসলামাবাদী’ খেতাব দিয়েই তিনি সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন একাধারে রাজনৈতিক কর্মী, সমাজ সেবক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বক্তা। ১৯২০ খ্রীস্টাব্দে তিনি খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি কংগ্রেসের সভ্য হিসেবে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণও করেছিলেন এবং কৃষক প্রজা আন্দোলনের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। অবিভক্ত ভারতে ‘জমিওতে ওলামায়ে হিন্দের’ বাংলা শাখার তিনিই ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। সমাজ সেবক মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদীর শ্রেষ্ঠকীর্তি চট্টগ্রামের ‘কদম মোবারক’ মসজিদ-সংলগ্ন এতিমখানার স্থাপনা। মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রধানত ইতিহাসমূলক রচনার জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এ শাখায় তার স্থান দেওয়ার কারণ তার সমগ্র সাহিত্যিক জীবনই তিনি ইসলাম ও বিশেষত তদানীন্তন ভারতীয় মুসলমানের সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন। তার রচিত বাংলা সাহিত্যে ইসলামমুখিতার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর রচিত পুস্তকগুলির নাম: (১) ভারতে মুসলমান সভ্যতা (১৯১৪) (২) নেজামুদ্দিন আউলিয়া (১৯১৬) (৩) তুরস্কের সুলতান (১৯১৮) (৪) ভারতে ইসলাম প্রচার (৫) মুসলমানের অভ্যুত্থান (৬) সমাজ সংস্কার (৭) খগোলশাস্ত্রে মুসলমান (৮) ভূগোলশাস্ত্রে মুসলমান (৯) কনস্টানটিনোপোল (১০) আওরঙ্গজেব (১১) মোসলেম বীরাঙ্গনা (১২) কোরআনে স্বাধীনতার বাণী (১৯৩৯) (১৩) ইসলামের উপদেশ (১৪) ইসলামের পুণ্য কথা প্রভৃতি। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি বই বিভিন্ন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল; স্বতন্ত্র বই আকারে এখনো প্রকাশিত হয় নি। তাঁর ‘নেজামুদ্দিন আওলিয়া’ গ্রন্থের ভূমিকায় নিম্নোক্ত গ্রন্থাবলীর উল্লেখ পাওয়া যায়: ‘শিল্পক্ষেত্রে মুসলমান’, ‘মুসলমান আমলে হিন্দুর অধিকার’ প্রভৃতি। এছাড়া ‘নিম্নশিক্ষা ও শিক্ষাকর’ (প্রথম সংস্করণ ১৯৪০) প্রভৃতি পুস্তিকার ও অসংখ্য ভাষণ এখনও লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে। ‘ভারতে মুসলমান সভ্যতা’ তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি। বইটির মোট অধ্যায় সংখ্যা দশ। মুসলমান শাসনকালে ভারতে কি কি জনহিতকর প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল মুনীরুজ্জামান তার যথাযথ উল্লেখ করেছেন এ বইটিতে। মুসলমান সভ্যতা ভারতকে নানা দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে। স্থাপত্য বিদ্যা, শাসন-ব্যবস্থা, বিদ্যাশিক্ষার বহুল বিস্তার এবং সাহিত্য সাধনার পথ সুগম করে মুসলমান রাজা-বাদশারা বিশ্বের দরবারে ভারতকে কিভাবে সমুন্নত করে তুলেছিলেন, গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গীর সাহায্যে যথেষ্ট শ্রম স্বীকার করে মুনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী তার বিশ্লেষণ করেছেন। ‘ভারতে মুসলমান সভ্যতা’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের তিনি বড়ো আশা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সে আশা সফল হয় নি। কবি গোলাম মোস্তফা পরিচালিত ‘নও বাহার’ পত্রিকায় গ্রন্থটির কয়েক অধ্যায় পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। মুনীরুজ্জামানের ভাষা অত্যন্ত প্রাঞ্জল এবং রচনারীতিও বলিষ্ঠ। ‘ভারতে মুসলমান সভ্যতা’ গ্রন্থটি থেকে তার কিছু নমুনা উদ্ধৃত করা হল: “অনেক পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ ও তাঁহাদের পদানুসরণকারী এতদ্দেশীয় লেখকগণ ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান জাতিকে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের পরম শত্রু এবং তাদের প্রতি নিতান্ত অনুদার বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহারা লিখিয়া গিয়াছেন মুসলমান শাসনাধীন ভিন্ন জাতীয় প্রজা সাধারণের প্রতি মুসলামন নরপতিগণ কঠোর ব্যবহার করিতেন। তাহাদিগকে তাহাদের প্রাপ্য অধিকার হইতে বঞ্চিত রাখিতেন।” “ইসলামধর্ম ও কার্যক্ষেত্রে মুসলমানদের ব্যবহার সম্পর্কে এ উক্তি সম্পূর্ণ বিপরীত। মুসলমানগণ ভিন্ন জাতীয় প্রজা সাধারণকে ধর্মে-কর্মে ও রাজ্যের ব্যাপারে যেরূপ স্বাধীনতা ও উচ্চাধিকার প্রদান করিয়াছিলেন জগতের ইতিহাসে তাহার দৃষ্টান্ত বিরল।” উর্দু ভাষায় প্রকৃত বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে একমাত্র মৌলানা শিবলী নোমানীই ইসলামের ইতিহাস রচনা করেছেন। বাংলা ভাষায় ইসলামের ইতিহাস রচনার ব্যাপারে মৌলানা শিবলী নোমানীই ছিলেন মুনীরুজ্জামানের আদর্শ। T.W. Arnold-এর Preaching of Islam গ্রন্থের আদর্শে ও অনুসরণে মৌলানা মুনীরুজ্জামান তাঁর ‘ভারতে ইসলাম প্রচার’ গ্রন্থটি রচনা করেন। ভারতে ইসলাম প্রচার সম্পর্কিত ব্যাপারে হিন্দুরা যেভাবে ইসলাম বিরোধী মনোভাব ও আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা পেয়েছে, মৌলানা মুনীরুজ্জামান এই বইটিতে তা খণ্ডন করবার যথাসাধ্য প্রয়াস পেয়েছেন। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে যে পার্থক্য ও বিরোধ তার মূর্ত ও জীবন্তরূপ আমরা দেখি শিবাজী ও আওরঙ্গজেবের মধ্যে। মুনীরুজ্জামান তাঁর ‘আওরঙ্গজেব’ গ্রন্থে এ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে হিন্দু মুসলমানের সম্পর্ক এবং আওরঙ্গজেবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিচার করেছেন। হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর সমসাময়িককালে এবং তার পরেও মুসলিম বীরাঙ্গনাগণ কিভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহে অংশগ্রহণ করেছেন এবং পুরুষদের সুখ-দুঃখের অংশভাগী হয়েছেন তার বর্ণনা করে বাঙালী মুসলিম মহিলারাও যাতে সেভাবে অনুপ্রাণিত হন, তার ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন তাঁর ‘মোসলেম বীরাঙ্গনা’ বইটিতে। মুসলমানের সর্বাঙ্গীন উন্নতি ও প্রতিষ্ঠা কামনাই ছিল তাঁর সাহিত্যিক জীবনের স্বপ্ন ও সাধ, কিন্তু তাদেরকে যথারীতি প্রতিষ্ঠা করার সাধ্য বোধ হয় তাঁর ছিল না। মৌলানা মুনীরুজ্জামান সুধাকর দলের মুখপাত্র মৌলবী মেয়রাজুদ্দীন ও পণ্ডিত রিয়াজউদ্দিন মাশহাদীর স্নেহের পাত্র ছিলেন। তাঁর সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক জীবনে এঁদের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। ১৯১১ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র গঠন ব্যাপারে তিনিই প্রধান উদ্যোগী ছিলেন এবং বাঙালী মুসলমানকে সচেতন করার জন্যে জীবনের ব্রত হিসেবে সাংবাদিকতা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি প্রথমে সাপ্তাহিক ‘সোলতান’ এবং পরে দৈনিক ‘সোলতান’ সম্পাদনা করেন। প্রথমে ‘মিহির ও সুধাকর’-এ লিখেই তিনি সাহিত্যিক খ্যাতি অর্জন করেন। পরে ‘আল্- ইসলাম’ (১৯১৫-২১) প্রভৃতি সেকালের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সমাজ সম্বন্ধে বহু মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেন। ১৯২৯ খ্রীস্টাব্দে তিনি দৈনিক ‘আমীর’ নামক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। মুনীরুজ্জামান ছিলেন প্যান ইসলামাবাদী। কি করলে মুসলিম জাতি আবার হৃত গৌরব ফিরে পাবে সে চিন্তাই তাঁর মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছিল। তাঁর সমগ্র সাহিত্য কীর্তির মধ্যে তাঁর চিন্তার এ বলিষ্ঠ ধারা সুস্পষ্ট হয়ে রয়েছে। দীন মোহাম্মদ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৫৩-১৯১৬): দীন মোহাম্মদ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন হিন্দু। তাঁর নাম ছিল মনোরঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়। এ কুলীন ব্রাহ্মণ সন্তান বরিশাল জেলার নথুল্লাবাদ গ্রামের বিখ্যাত গাঙ্গুলী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা জেলার আড়াই হাজার থানার অন্তর্গত নোয়াগাঁও গ্রামের মৌলানা ফৈজদ্দিন লস্করের নিকট ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং সেই গ্রামে বহু বৎসর বাস করেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর মৌলভী দীন মোহাম্মদ গঙ্গোপাধ্যায় নামে পরিচিত হন। দীন ইসলাম সম্পর্কে তিনি ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন। পাবনা জেলার সুজানগর থানার অন্তর্গত তাড়াবাড়িয়া গ্রামে ১৯১৬ সালে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। ‘ক্রুসেড ও জেহাদ’ (১ম খণ্ড) তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এটি ১৩১৫ সাল অর্থাৎ ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দে ৬নং কলেজ স্কোয়ার, কলিকাতা থেকে আবদুল লতিফ কর্তৃক সামযন্ত্রে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। ‘ক্রুসেড্ ও জেহাদ’ বইটি একটি ইতিহাসভিত্তিক রচনা। শেখ আবদুল জব্বার (১৮২৮-১৯১৮); ইসলামী ইতিহাস ও তমদ্দুনমূলক রচনা শাখায় ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার অন্তর্গত বনগ্রামনিবাসী শেখ আবদুল জব্বারের নাম উল্লেখ করবার মতো। ছাত্র অবস্থাতেই শেখ আবদুল জব্বারের প্রবন্ধাদি ‘মিহির ও সুধাকর’ এ প্রকাশিত হতো। এ পর্যায়ে তাঁর লেখা- ১. ‘মক্কা শরীফের ইতিহাস’ (১৩১৩ সাল-১৯০৬ খ্রীঃ) ২. ‘ইসলাম চিত্র ও সমাজ চিত্র’ (আশ্বিন, ১৩১৪ সাল-১৯০৭ খ্রীঃ) ৩. ‘মদিনা শরীফের ইতিহাস’ (১৩১৪ সাল) ৪. ‘ইসলাম সঙ্গীত’ (১৩১৫ সাল, ১৯০৮ খ্রীঃ) ৫. ‘আদর্শ রমণী’-১ম ভাগ (১৩১৬ সাল, ১৯০৯ খ্রীঃ) ৬. ‘জেরুজালেম বা বয়তুল মকাদ্দাসের ইতিহাস’ (১৩১৭ সাল, ১৯১০ খ্রীঃ) ৭. ‘আদর্শ রমণী’-দ্বিতীয় ভাগ (১৩১৯ সাল, ১৯১২ খ্রীঃ) ৮. ‘হজরতের জীবনী’ (১৩২০ সাল, ১৯১৩ খ্রীঃ) ৯. ‘নূরজাহান বেগম’ (১৯১৩ খ্রীঃ) ১০. ‘দেবী রাবেয়া’ (১৯১৩ খ্রীঃ) এবং ১১. ‘গাজী’ (১৩২৪ সাল, ১৯১৭ খ্রীঃ) প্রভৃতি অনেক কয়টি পুস্তকের সাক্ষাৎ পাই। অধ্যাপক মনসুরউদ্দীন তাঁর ‘বাংলা সাহিত্য মুসলিম সাধনা’ ২য় খণ্ডে ‘আদম- হাওয়া’ ও ‘স্বপ্ন বিচার’ নামক আরও দুটি বইয়ের নাম করেছেন এবং তৎপ্রণীত ‘হজরতের জীবনী’ ও ‘দেবী রাবেয়া’র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পাঠ্য তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ শেখ আব্দুল জব্বার সম্পর্কে বলেনঃ তিনি সাহিত্যের জন্য কি করিয়া গিয়াছেন, তাহা আমি না বলিলেও তাঁহার অবদানরাজি চিরকাল ঘোষণা করিবে। আমাদের সমাজে তিনি একজন অদ্ভুত লোক ছিলেন।” (সাধনা, চট্টগ্রাম) ‘দেবী রাবেয়া’র ভূমিকায় সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী লিখেছেনঃ “বঙ্গ সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত খ্যাতনামা গ্রন্থকার ও সুলেখক মৌলভী শেখ আব্দুল জব্বার সাহেব মনোহারিণী ভাষায় সরস বর্ণনায় মহাতপস্বিনী রাবিয়া দেবীর মধুর জীবন চরিত লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তাঁহার গ্রন্থ পাঠ করিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছি।” সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে ইসলামের খেদমত করা শেখ আবদুল জব্বারের ব্রত ছিল। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ও প্রকৃতি থেকে তা সহজেই হৃদয়ঙ্গম করা যায়। মুন্সী আবদুল লতিফ মুন্সী আবদুল লতিফ বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম থানার অধীন জামতাপাড়া গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তিনি উনিশ শতকের সাত কি আট দশকের দিকে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৩৬ সালের ৩১শে জানুয়ারি। বিভাগপূর্ব বাংলাদেশে তিনি একজন কংগ্রেসভক্ত জাতীয়তাবাদী মুসলমান ছিলেন। তা সত্ত্বেও সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানের সেবায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘জোলেখা’ ১৯১০-১১ সালে প্রকাশিত হয়। কোরআনের সূত্র ধরে তিনি এ গ্রন্থে ইউসুফ- জোলেখার অমর প্রেমের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কোরআনের উপাখ্যান’ প্রকাশিত হয় ১৯১৬-১৭ সালে। আবদুল লতিফের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি ‘ঐতিহাসিক চরিত্র জেন-নেসা বেগম’ বাংলা ১৩৩৫ সাল মোতাবেক ইংরেজি ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ হিন্দু লেখক আওরঙ্গজেব-দুহিতা জেবুন নিসার চরিত্রে যে দোষারোপ করেন, আবদুল লতিফ ঐতিহাসিক তথ্য ও যুক্তি তর্কের সাহায্যে তা খণ্ডন করেন। তাঁর এ বইটিতে গবেষকের শ্রমশীলতা ও নিষ্ঠার ছাপ রয়েছে। এছাড়া ‘আল এসলাম’ পত্রিকাতে তাঁর লেখা ‘মোস্তফা চরিতালোচনা’ বছর দেড়েক ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। আবদুল লতিফের ভাষা ছিল মার্জিত সরল এবং সাবলীল। কাজী আকরাম হোসেন (১৮৯৬-১৯৬২): বাংলা ভাষায় যাঁরা ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তাঁদের সঙ্গে খুলনার কাজী আকরাম হোসেনের নামও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯২৪ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর সুবিখ্যাত ‘ইসলামের ইতিহাস’ রচনারীতির দিক থেকে ক্লাসিকের মর্যাদা পাবার যোগ্য। আরব জগতে ইসলামের উদ্ভবকাল থেকে শুরু করে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে স্পেন ও ভারতে কিভাবে ইসলামের বিস্তার সম্ভব হয়েছে কাজী আকরাম হোসেন ঐতিহাসিকের সততা এবং সাহিত্যিকের মন নিয়ে তার বিশদ এবং মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন। ‘ইসলামের ইতিহাস’ তাঁর হাতে যথারীতি সাহিত্য হয়ে উঠেছে। এছাড়া ‘যুগবাণী’ নামক কাব্য গ্রন্থে তিনি ইকবালের কবিতার অনুবাদ করেন। মৌলানা জালালুদ্দীন রুমীর বিখ্যাত ‘মসনবী’ গ্রন্থের কিয়দংশের কাব্যানুবাদ (১৯৪৬) এবং শেখ সা’দীর ‘করীমা’ বা ‘পাদনামা’র কাব্যানুবাদ (১৯৪৬) বাংলা ভাষায় কাজী আকরাম হোসেনের উল্লেখযোগ্য দান। তিনি সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনে শিক্ষা বিভাগে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেন। সরকারী চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে খুলনা আর. কে. গার্লস কলেজে তিন বছর অধ্যক্ষের কাজ করেন। সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করে কাজী আকরাম হোসেন ঢাকায় হোসেনী দালান এলাকায় নিজ বাসভবনে ১৯৬২ সালে এন্তেকাল করেন। গিরিশচন্দ্র সেন(১৮৩৪-১৯১০): ব্রাহ্মধর্মের মধ্যে নববিধানের প্রবর্তনকারী ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন তাঁর কয়েকজন অনুবর্তীকে বিভিন্ন আলোচনায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এঁদের মধ্যে গিরিশচন্দ্র সেন এবং গৌরগোবিন্দ রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। গিরিশচন্দ্র ইসলামের সাধনা ও সংস্কৃতির আলোচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ঢাকা জেলার পাঁচদোনা গ্রামে ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে গিরিশচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন এবং পরিণত বয়সে ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে মারা যান। গিরিশচন্দ্রই সর্বপ্রথম কোরআন শরীফের সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ (১৮৮১-৮৬) এবং মিল্কাত শরীফের প্রায় অর্ধাংশের অনুবাদ প্রকাশ করেন। গিরিশচন্দ্র ইসলামী বিষয় সম্পর্কিত আলোচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন তাঁর গুরু কেশবচন্দ্র সেনের নির্দেশে ও অনুপ্রেরণায়। এ বিষয়ে কেশব সেনও ব্রাহ্মধর্মের আদি প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকবেন। ব্রাহ্মধর্ম হিন্দু, খ্রীষ্ট ও’ ইসলাম ধর্মের এক অপরূপ সমন্বয়। ভারতে এ ধর্ম সমন্বয়-সাধন-মানসে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দূরদর্শী ও মুক্তবুদ্ধি রামমোহন প্রাণপণ সংগ্রাম করেছিলেন এবং হিন্দু, খ্রীষ্টান ও ইসলাম ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কিত বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা করেছিলেন। হিন্দু ও খ্রীষ্টান শাস্ত্র সম্বন্ধে রাজা রামমোহন রায় যে-সব আলোচনা করেছিলেন তার অধিকাংশই এখনও রক্ষিত আছে। কিন্তু তাঁর মুসলিম শাস্ত্রাদি সম্পর্কিত আলোচনা আমাদের হস্তগত হয়নি। তবু তাঁর ‘তোহফাতুল মুয়াহেদীন’ গ্রন্থে এবং তাঁর রচনার নানাস্থানে ইসলাম ও মুসলমান সম্বন্ধে বিক্ষিপ্ত উক্তি ও আভাস-ইংগিত থেকে তাঁর চিত্তের উপরে মুসলিম সাধনার প্রভাবের স্বরূপ অনেকখানি বুঝতে পারা যায়। তাঁর সম্প্রদায়ের প্রতীক উপাসনার প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা এবং খ্রীষ্টান সমাজের ত্রিত্ববাদের প্রতিও তার বিরূপতার মূলে কোরআনের শিক্ষাই সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। ব্রাহ্মরা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক এবং স্রষ্টায় বিশ্বাসী। ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে মুসলমানদের সঙ্গেই ব্রাহ্মদের যথেষ্ট মিল রয়েছে। মুসলমান ভক্ত সাধকদের চরিত্রের সঙ্গে ব্রাহ্মরা তাদের জীবনের ঘনিষ্ঠ যোগ স্থাপন করতে এক সময়ে মোটেই কুণ্ঠিত ছিল না। মুসলমান ওলি-আল্লাদের তপোনিষ্ঠা, ত্যাগ স্বীকার, বৈরাগ্য, ভক্তি, প্রেমমত্ততা এবং আধ্যাত্মিক ভাব সাধনার তুলনা বড়ো বেশি পাওয়া যায় না। এঁরা মুসলমানদের গৌরবের আশ্রয় হলেও মানুষ মাত্রেরই ভক্তিভাজন। ভক্ত গিরিশচন্দ্র এঁদের জীবন- সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন এবং পুণ্যব্রতে অনুপ্রাণিত হয়েই মুসলমান তাপসদের জীবনী আলোচনা করেছেন। শারহোল কল্প’, ‘কল্ফোল আস্রার’, ‘মারফতোর রফস’ এই তিনটি গ্রন্থে মুসলমান ওলি-আল্লা ও সুফী দরবেশদের জীবনচরিত বিবৃত হয়েছে। এ সব গ্রন্থের সার সংকলন করে মওলানা ফরিদুদ্দিন আত্তার’তাযকেরাতুল আওলিয়া’ নামক ফারসী ভাষায় একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গিরিশচন্দ্র ‘তাযকেরাতুল আওলিয়া’ অবলম্বন করে ‘তাপসমালা’ লেখেন। তাঁর তাপসমালা ‘তাযকেরাতুল আওলিয়া’র আক্ষরিক অনুবাদ না হলেও মূলত অনুবাদই। কোন কোন স্থানে ভাবানুবাদ এবং কোন কোন স্থানে আক্ষরিক অনুবাদ। তাছাড়া বাহুল্য বোধে অনেক জায়গা তিনি বাদ দিয়েই অনুবাদ করেছেন। ‘তাপসমালা’য় ছয় খণ্ডে ছিয়ানব্বই জন ওলি-আল্লার জীবনী আলোচিত হয়েছে। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই গিরিশচন্দ্রের ‘তাপসমালা’-রচনার কাজ শেষ হয়। প্রতি খণ্ডেরই পাঁচের অধিক সংস্করণ হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় ‘তাপসমালা’ জনপ্রিয় হয়েছিল। বাংলা ভাষায় ‘তাপসমালা’ রচনা গিরিশচন্দ্রের অবিস্মরণীয় দান। তিনি বাংলা সাহিত্যের সূফী দরবেশের জীবনী আলোচনা করে এ শাখার গোড়াপত্তন করেন। তাঁর পর বহু মুসলমান লেখকই মুসলিম পীর দরবেশ ও তাপসের কাহিনী রচনা করেছেন। এছাড়া গিরিশচন্দ্র সেন দিওয়ান-ই-হাফিম্, গুলিস্তা, বুস্তা, মকতুবাত-ই-মখদুম শরফউদ্দিন মুনিরী, মম্নতী-ই-রুমী, মন্তিকুত্তয়র, কিমিয়া-ই সাদাত, গুলশন-ই আস্থার পুস্তকগুলোর আংশিক অনুবাদ করেন এবং ইসলাম সম্বন্ধে নিম্নলিখিত পুস্তকগুলো মৌলিকভাবে রচনা করেন ‘মহা-পুরুষ মোহাম্মদ ও তৎপ্রবর্তিত এসলাম ধর্ম’, ‘চারিজন ধর্মনেতা’ (পৃঃ ৮৮), ‘এমাম হাসান ও হোসায়নের জীবনী’, ‘মহাপুরুষ চরিত’ (১ম ভাগ), ‘মহাপুরুষ চরিত (২য় ভাগ) (হয়তের জীবনী) এবং ‘চারিটি সাধ্বী মুসলমান নারী।’ ভাই গিরিশচন্দ্রের ইসলাম সম্পর্কিত অনুবাদ ও মৌলিক গ্রন্থ সংখ্যা মোট একুশটি। ‘তত্ত্বরত্নমালা’ (বা তত্ত্বশাস্ত্র সম্বন্ধীয় রচনাবলী) ভাই গিরিশচন্দ্র কর্তৃক পারস্য পুস্তক ‘মস্তিকুত্তয়র’ ও ‘মসনবি মৌলবী রোম’ থেকে সংকলিত। সবটা অনুবাদ নয়, অনেকস্থানে মূলের ভাবমাত্র অবলম্বন করে ‘তত্ত্বরত্নমালা’ লিখিত হয়েছে। ১৯১৪ সনে এ বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ছোট ছোট গল্পের আকারে এ গ্রন্থে নানা নীতিকথা ও শিক্ষণীয় বিষয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং এতে নীরস তত্ত্ব ছাড়াও এমন অনেক বিষয় স্থান পেয়েছে, যা চিত্তকেও প্রফুল্ল করে। সুধাকর দলের সুধীবৃন্দ যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ইসলামী সাহিত্য রচনা শুরু করেছিলেন, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মধ্যেই তার উৎকৃষ্ট ফল ফলেছিল। কলকাতায় বসে এ গুণীগণ বাংলা ভাষায় ইসলাম ‘চার করবার এবং বাঙালী মুসলিম জনসাধারণকে হেদায়েত করে তাদের জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছিলেন। ১৮৮৭-৮৮ খ্রীষ্টাব্দে ‘এসলাম তত্ত্ব’ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় ‘মোহামেডান লিটারারী সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিছুদিন যেতে না যেতে এ লিটারারী সোসাইটির কার্যকলাপ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রসারিত করারও প্রয়াস হয়েছিল। এরই সমসূত্রে হজরত মখদুম শাহের আভাসভূমি রাজশাহীতে ‘আঞ্জুমানে হেমায়েতে এসলাম’ এবং ‘নূর-অল-ঈমান’ নামক সমাজ সংগঠনমূলক দুইটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ‘আঞ্জুন হেমায়েতে এসলামের’ প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে আর ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ৩” ‘নূর-অল্-ঈমা’ সমাজ। আরবের সেই বিখ্যাত ‘এখওয়ানোস ছাফা’ নামক সমাজের অনুকরণে এবং বিদ্যানুরাগী ইংরেজ রাজপুরুষদিগের স্থাপিত ‘এসিয়াটিক সোসাইটি’ সমাজের কিছু সাদৃশ্যে উত্তরবঙ্গে (রাজশাহীতে) ‘নূর-অল- ঈমান’ সমাজ স্থাপিত হয়েছিল। মীর্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর পুত্র মীর্জা মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী খুব সম্ভব ‘নূর-অল্-ঈমান’ সমাজের সম্পাদক ছিলেন। ‘নূর-অল-ঈমান’ মাসিক পত্রিকা ‘নূর-অল-ঈমান’ সমাজের ছিল মুখপত্র। বাংলা ১৩০৭ সালের আষাঢ় মাসে (১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে) এ মাসিক পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। মুসলমানদেরকে অন্ধকার থেকে আলোকের পথে নিয়ে আসাই ছিল ‘নূর-অল্-ঈমান’ সমাজ এবং তার মুখপত্র ‘নূর-অল্-ঈমান’ পত্রিকার প্রধান উদ্দেশ্য। পত্রিকাটি ‘নূর-অল্-ঈমান’ সমাজ কর্তৃক সম্পাদিত এবং মীর্জা ইউসুফ আলী কর্তৃক ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সজ্জীকৃত’ হয়। এ সমাজের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কাজ মুসলিম জগতের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মহাত্মা ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহ্র ‘কিমিয়া সাআদাৎ’ গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ। অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন মৌলভী মীর্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী স্বয়ং। দার্শনিক ইমাম গাজ্জালীর ‘কিমিয়া সাআদাৎ’ পাঁচ খণ্ডে রচিত। বাংলায় প্রথমত পাঁচ খন্ডের অনুবাদ সাত ভাগে প্রকাশিত হয়। পরে অবশ্য সাত ভাগকে প্রত্যেক খণ্ডের অনুগামী করে পাঁচ খন্ড করা হয়। ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দের আগেই এ অনুবাদের কাজ শেষ হয়েছিল। অনুবাদক মীর্জা ইউসুফ আলী ‘কিমিয়া সাআদাৎ’-এর উপযুক্ত বাংলা নাম দিয়েছেন ‘সৌভাগ্য স্পর্শমণি’। পাঁচ খণ্ডের অনুবাদ দেড় হাজার পৃষ্ঠায় শেষ হয়েছে। খণ্ডগুলোর নাম ‘দর্শন পুস্তক’, এবাদত পুস্তক’, ‘ব্যবহার পুস্তক’, ‘বিনাশন পুস্তক’ ও ‘পরিত্রাণ পুস্তক’। ইসলাম শুধু ধর্ম নয়-পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব লাভের এবং খোদার সঙ্গে একাত্ম হবার পথ বা ব্যবহার-বিধি। মানুষ জগতে কিভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হযরত মোহাম্মদ (সঃ)। সংসার পথে ধীরে ধীরে চিত্ত শান্ত ও আত্মদমন করে মনুষ্যত্ব কিভাবে বিকশিত হতে পারে, মুসলমানের ধর্ম জীবনে ইসলামের আনুষ্ঠানিক ব্যবহার-বিধিও মনুষ্যত্ব বিকাশের পথে কিভাবে সহায়ক হতে পারে, ‘সৌভাগ্য স্পর্শমণি’তে তার সুন্দর ব্যাখ্যা আছে। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ছোট থেকে বড়ো হয় কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব লাভ করে না; তার জন্য প্রয়োজন হয় সাধনার। ইসলাম প্রদর্শিত পথে সংযম, শালীনতা, চরিত্রোন্নতির পথ ধরে সোপানে সোপানে কিভাবে মানুষ তার চরম লক্ষ্য আল্লাহতে পৌছার ‘সৌভাগ্য’ লাভ করে, তারই অনুপম ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইমাম গাজ্জালী তাঁর ‘কিমিয়া সাআদাৎ’ গ্রন্থে। মীর্জা ইউসুফ আলী সুন্দর ও সাবলীল বাংলা গদ্যে ‘কিমিয়া সাআদতে’র অনুবাদ করে অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই ‘সৌভাগ্য স্পর্শমণি’ নাম দিয়েছেন। শুধু ইসলামী বিষয়বস্তু বলে নয়, বাংলা অনুবাদ সাহিত্যেও ‘সৌভাগ্য স্পর্শমণি’ এক মহত্তর অবদান। এছাড়া মুসলমান সমাজের উন্নতির জন্য কি কি উপায় অবলম্বন করা যায় তার ইঙ্গিত দিয়ে মীর্জা ইউসুফ আলী ‘দুগ্ধ সরোবর’ নামেও একখানি ‘কওমী পুস্তিকা’ প্রণয়ন ও প্রচার করেছিলেন। ১৩০৭ সালের (১৯০০ খৃঃ) ‘নূর-অল্-ঈমান’ পত্রিকায় এ বইটির সমালোচনা হয়েছিল। এ সময়েই (১৯০৩) যশোরের খড়কী নিবাসী মৌলভী মোহাম্মদ আবদুল করিম ‘তাসাওয়াফ’ সম্বন্ধে ‘এরশাদে খালেকিয়া বা খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্ব’ (পৃঃ ২৯৮) নামক একটি মৌলিক বই রচনা করেন। আবদুল করিম নিজের নক্শবন্দীয়া তরীকার একজন কামেল সূফী সাধক। মোহাম্মদ আবদুল করিমের ‘খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্বে’র মতো বাংলায় তাসাওয়াফ সম্পর্কিত সুলিখিত বই আর দ্বিতীয়টি দেখা যায় না। মোহাম্মদ আবদুল করিম ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে এন্তেকাল করেন-তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পরে ১৯৪৯ খৃষ্টাব্দে ‘খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্বের’ চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এ ধারার অর্থাৎ ‘মারিফাত’ বা সুফী সাধনা বিষয়ক অনেক গ্রন্থ বাঙলা ভাষায় লিখিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মুন্সী আজিমউদ্দিন রচিত ‘খোলাহাতুল মারিফাত’ (১৮৬৮)। মোহাম্মদ মল্লিক রচিত ‘আখবারুল মারিফাত’ (১৮৭৬)। মওলানা শামসুল হক রচিত ‘তালিমুদ্দীন’ (৫ম সংস্করণ ১৯৬৩) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে নদীয়া শান্তিপুর নিবাসী মোজাম্মেল হকের (১৮৬০-১৯৩৩) ‘তাপস কাহিনী’ (১৯০০ খ্রীঃ দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯১৪) এবং ‘মহর্ষি মনসুর’ (১ম সংস্করণ, ১৮৯৮ পৃঃ ৯০) স্মরণীয়। মোজাম্মেল হক তাঁর ‘তাপস কাহিনী’তে ‘হযরত আবদুল কাদির’, ‘নিজাম উদ্দীন আউলিয়া, ‘ইমাম জাফর সাদেক’, ‘ইব্রাহিম আদহাম বন্ধী’, ‘তপস্বী ফাজিল আয়াজ’, ‘তপস্বী বশর হাফী’ ও ‘দরবেশ আবু হেস্’ প্রমুখ সাতজন মহাতপা আউলিয়ার জীবন কাহিনী তাঁদের ধ্যান-ধারণা, অলৌকিক তপোনিষ্ঠা ও খোদাপ্রেমের বিষয় আলোচনা করেছেন। ‘মহর্ষি মনসুর’, ‘আনাল হক’ বা ‘অহম ব্রহ্মাম্মি’ এ মহাবাণী প্রচারক মহাতাপস মনসুরের জীবন কাহিনী। অলৌকিক এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় মানুষ কতবড়ো সিদ্ধি লাভ করতে পারে, মহর্ষি মনসুরের জীবন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর সম্বন্ধে যে সব অনৈতিহাসিক গল্প ও প্রবাদ প্রচলিত আছে সেগুলো এবং একখানি উর্দু পুস্তিকার মর্ম অবলম্বন করে স্বাধীনভাবে এ গ্রন্থখানি তিনি রচনা করেছেন। গ্রন্থখানি সুখপাঠ্য। মনসুরের ধর্মোন্মত্ততা এবং উপলব্ধ সত্যের জন্যে অবিচলিত আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিবশত মোজাম্মেল হক তাঁকে সূক্ষ্মদর্শী মহামানবরূপে অঙ্কিত করছেন। কেদারনাথ মিত্রের ‘মুসলমান ভক্তচরিত’ (মাঘ ১৩৩৫ ১৯২৮ খ্রীঃ) এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। মহর্ষি আবিস করণী, মহর্ষি ফাজিল আয়াজ, মহর্ষি আবু ওসমান হায়রী, মহর্ষি আবু হাফেজ, মহর্ষি ইব্রাহিম আদম, মহর্ষি হাসান বসোরী, মহর্ষি মালেক দিনার, মহর্ষি জুনিদ, মহর্ষি সরি সব্জী, মহর্ষি ইউসুফ হোসেন এবং তপস্বিনী রাবেয়া প্রমুখ এগারজন ওলি-আল্লার জীবনী ‘মুসলমান ভক্তচরিতে’ আলোচিত হয়েছে। কেদারনাথ মিত্র এঁদের সাধনায় ও চারিত্রিক আদর্শে মুগ্ধ হয়ে ভক্তের মতো এঁদের জীবনী লিখেছেন। চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের ‘রাবেয়া’ গ্রন্থও উল্লেখযোগ্য। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং মোহিতলাল মজুমদার মুসলমানী অধ্যাত্মমূলক কিছু কবিতা অনুবাদ করেন। মওলানা মুনীরুজ্জমান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০) লিখিত ‘নেজামুদ্দীন আওলিয়া’ (১৯১৬) গ্রন্থটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। খাজা নিজামুদ্দীন আওলিয়ার জীবন এবং তাঁর সাধন-কাহিনী এ গ্রন্থে মুনীরুজ্জামান লিপিবদ্ধ করেছেন। বাংলা সহিত্যে বহু অনুবাদ এবং মৌলিক গ্রন্থই এ শাখাকে সমৃদ্ধ করেছে। শেখ ফজলুল করিম ‘ছামীতত্ত্ব’ (পৃঃ ২৭) নাম দিয়ে ১৯০৩ সালে ‘আসবাত-উস্-হামী’র বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। নীতিভূষণ শেখ ফজলুল করিম তাঁর সমসাময়িক কালের বাঙালী মাত্রেরই নৈতিক জীবনের উন্নতি বিধান ও চিত্তশুদ্ধির জন্য বাংলা ভাষায় ইসলামের আদর্শ সাধক ও সুফীদের জীবনী রচনা করেছিলেন। ‘রাজর্ষি এব্রাহিম’, ‘বিবি রহিমা’ এবং ‘পথ ও পাথেয়’ প্রভৃতি অনেকগুলো বই তিনি এ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই লিখিছেন। অকৃত্রিম আন্তরিকতা এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণাবেগ তাঁর রচিত সাহিত্যকে ধর্মের পথে পরিচালিত করেছিল। একালের শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখকদের অন্যতম শেখ ফজলুল করিম সম্পর্কে অন্যত্র আমরা বিশদ আলোচনা করেছি। নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯): ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে ‘ঈদুল আজহা’ (পৃঃ ১৭৪) প্রকাশ করেন। ‘ঈদুল আজহা’র তত্ত্বকথাও তিনি এ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন। ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি তাঁর ‘মৌলুদ শরীফ’ (পৃঃ ১৭৯) প্রকাশ করেন। এতে হযরতের (সঃ) জন্ম থেকে দুগ্ধপান কাল পর্যন্ত বাল্য জীবনী বর্ণিত হয়েছে। পুস্তকটি সুলিখিত। সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার ধনবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার ১৯০৬ সনে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনিও জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯১১-১২ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গীয় আইন সভার সভ্য ছিলেন। পরে তিনি কেন্দ্রীয় আইন সভারও সভ্য এবং লর্ড রেনোল্ডসের মন্ত্রিসভারও সদস্য নিযুক্ত হন। মুসলমান সমাজের প্রতি নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর অকৃত্রিম দরদ ছিল। মুসলমানদের সাহিত্য ও জাতীয় সেবার সুবিধার জন্য জনৈক সাংবাদিককে তিনি একটি প্রেস কিনে দিয়েছিলেন। তাঁর কলিকাতাস্থ বাসভবনের পার্শ্বে প্রেসটি স্থাপন করা হয়েছিল। এ প্রেস থেকেই ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকা প্রকাশিত হতো। ছমিরুদ্দিন আহমদ ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর ‘মোহাম্মদীয় ধর্ম সোপান’ ১ম খণ্ড (কান্দেমা পৃঃ ১০০) এবং দ্বিতীয় খণ্ড (নামায, পৃঃ ১৩২) প্রকাশ করেন। অবিভক্ত বাংলার মুসলমান সরকারী পুলিশ কর্মচারীদের মধ্যে সাহিত্যিক সৈয়দ এমদাদ আলীর (১৮৭৬-১৯৫৬) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর ‘তাপসী রাবেয়া’ (৩য় সংস্করণ, ১৯৩১, পৃঃ ১০৬) এ বিভাগের একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ। এখানে এমদাদ আলী তাপসী রাবেয়ার শুধু বহির্জীবনের ঘটনা বর্ণনা করেন নি। তাঁর জন্ম-মৃত্যু ও বহির্জীবনের ইতিহাস যৎসামান্য উল্লেখ করে অধিকাংশ স্থান জুড়েই তিনি তাঁর সাধনকাহিনী বর্ণনা করেছেন। খোদাপ্রেমে মশগুল হলে মানুষ কি ভাবে তাঁর ‘তনুমনধন জীবনযৌবন’ খোদার রাহে লুটিয়ে দিতে পারে তাপসী রাবেয়ার অন্তর্জীবনের ধারাবাহিক উন্নতি বিচার প্রসঙ্গে এমদাদ আলী তার সুষ্ঠু নির্দেশ দিয়েছেন। এ বইটিকে মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ৬৪ পৃষ্ঠায় তাপসী রাবেয়ার জীবন স্বপ্ন ও সাধনার কথা, পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে সুফী মতবাদ এবং সুফী সাধনার তত্ত্ব বিশ্লেষিত হয়েছে। বর্ণনাভঙ্গী অত্যন্ত সাবলীল: চিন্তার স্বচ্ছতা থাকার জন্য দ্বিতীয় অংশে সুফী তত্ত্বের দুরূহ বিষয়বস্তুও বর্ণনায় সহজ গতি পেয়েছে। মুসলিম সমাজকে পটভূমি হিসেবে অবলম্বন করে তিনি ১৩৩৫ সালে (১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে) ‘হাফেজ’ নামক একটি পত্রোপন্যাসও রচনা করেছিলেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি ‘নবনূর’ পত্রিকার সম্পাদনা। এ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাঙালী মুসলিম সমাজকে নানাভাবে জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছেন।প্রসঙ্গক্রমে মৌলবী আযহার আলী প্রণীত এবং মোহাম্মদ কোরবান আলী সম্পাদিত ‘খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী’র জীবনী গ্রন্থের উল্লেখ করা যেতে পারে। এটি প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে এবং অষ্টম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে। শেখ হাবিবুর রহমান (সাহিত্যরত্ন)-এর ‘ইসলাম ধর্ম তত্ত্ব’ (৯২ পৃঃ) ১৯০৭ সালে প্রকাশিত হয়। ‘গুলিস্তান’ (১৯৩৩), ‘বোস্তান’ এবং আওরঙ্গজেবের জীবনেতিহাস ‘আলমগীর’ শেখ হাবিবুর রহমানের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য-কীর্তি। ইসলামী বিষয়বস্তু ছাড়াও তিনি ‘কর্মবীর মুন্সী মেহেরুল্লাহ’ (পৃঃ ১৫২, ১৯৩৪ খ্রীঃ) এবং ‘আমার সাহিত্য জীবন’ শীর্ষক আত্মজীবনী রচনা করেন। ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে গোলাম রসুল খোনকারের ‘মাজেজাত’ (পৃঃ ৫৯) লিখিত হয়। মাজেজাত অর্থ অলৌকিক ঘটনাবলী। প্রত্যেক নবীই কিছু কিছু মাজেজার অধিকারী ছিলেন। এ ধরনের কিছু, মাজেজার কথা এ ছোট্ট পুস্তিকাটিতে গোলাম রহুল উল্লেখ করেছেন। এ শাখায় কতগুলো উল্লেখযোগ্য বই; গোলাম মোহাম্মদের ‘ইসলাম সার সংগ্রহ’ (পৃঃ ৭৬, অনুবাদ ১৯১৩), মধুসূদন ঘোষালের ‘মোসলেম গৌরব’ (পৃঃ ৫৬, ১৯১৪), দেওয়ান শাহ্ আবদুর রশীদ চিশতীর ‘জ্ঞান সিন্ধু বা গহে তাওহিদ’ (পৃঃ ১৭৮, ১৯১৯) ছদরউদ্দীন আহমদের (?) ‘এল্মে তাছাওয়াফ্’ (পৃঃ ২৪০, ২য় সংস্করণ, ১৯২৪)। এল্মে তাছাওয়াফে’র লেখকের নাম নেই, ছদরউদ্দিন আহমদের নাম প্রকাশক হিসেবে স্থান পেয়েছে। মোহাম্মদ মোবারকের (প্রকাশক) ‘হযরতের রচনাবলী (পৃঃ ৩২, ২য় সংস্করণ, ১৯২৪) গ্রন্থটি সম্ভবত খান বাহাদুর আহসানুল্লাহ রচিত। ‘এসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্য’ (১ম খণ্ড, ২য় সংস্করণ, ১৯২৪) গ্রন্থকারের নাম নেই; প্রকাশক মোহাম্মদী বুক এজেন্সী, কলকাতা। বাংলার মুসলমানদের ধর্ম ও নৈতিক জীবনের কল্যাণ সাধনাই ছিল এ গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য। কবি গোলাম মোস্তফাকৃত ‘এখওয়ানুস সাফা’র অনুবাদ ‘জয়- পরাজয়’ এবং ‘মোসাদ্দাস-ই-হালি’র ক্যাবানুবাদও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। ‘মোস্তফা চরিতে’র লেখক মৌলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁর লেখা ‘সমস্যা ও সমাধান’ (১৯২৬?) এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করার মতো বই। তাঁর সমস্যা ও সমাধানে অবশ্য ইসলামের তত্ত্বকথার আলোচনা নেই, কিন্তু ইসলামী সমাজব্যবস্থায় ইসলাম ধর্মমতের পরিপ্রেক্ষিতে সুদ, ব্যাঙ্কিং, সঙ্গীত ইত্যাদি নানা সমস্যামূলক আলোচনা ও তার সুষ্ঠু সমাধানের ইঙ্গিত তিনি দিতে পেরেছেন। এ কালের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এদিক থেকে প্রবন্ধকার মৌলানা আকরাম খাঁর দান অবিস্মরণীয়। এ পর্যায়ে বহু ভাষাবিদ সাধক ও পণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভাষাতত্ত্ব ও সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি তিনি আজীবন ইসলাম ধর্মকে বুঝবার এবং তার সেবা করবার যথাযোগ্য প্রয়াস করে এসেছেন। সেই সাধনার বশবর্তী হয়ে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে তিনি বহু প্রবন্ধাদি রচনা করেছেন। তাঁর ‘ইসলাম ও বিশ্বসেবা’ ‘ইসলামে নারীর ধর্ম সম্বন্ধীয় অধিকার’, ‘ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপ’, ‘ইসলামী সমাজের রূপ’, ‘ইসলাম-মানবতার মুক্তিদূত’ প্রভৃতি বিভিন্ন সময়ে রচিত বিশটি প্রবন্ধের একটি মূল্যবান সংকলন ‘ইসলাম প্রসঙ্গ’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারী ১৯৬৩। রয়াল সাইজের ১২৬ পৃষ্ঠার বই। বাংলায় ইসলাম সম্পর্কে যত আলোচনা হয়েছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে এটি উল্লেখযোগ্য এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত বোখারী শরীফেরও তিনি অংশবিশেষ অনুবাদ করেন। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের (জন্ম ১৯০৬ সাল) ‘বঙ্গে সুফী প্রভাব’ (পৃঃ ২৬০, ১৯৩৩) এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। ‘বঙ্গে সুফী প্রভাব’ গবেষণামূলক গ্রন্থ। এতে সূফী মতবাদের নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা আছে। শরীয়তী ইসলাম এবং সূফী মতবাদের সামঞ্জস্য ও পার্থক্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশে সূফী মতবাদ কিভাবে বিস্তার লাভ করেছিল এবং এখনও বাঙালী মুসলমানের জীবনে সূফী মতবাদ কতটুকু প্রভাব বিস্তার করে আছে তার নির্দেশ এনামুল হক এ বইটিতে দিয়েছেন। এরই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য এনামুল হকের ‘পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম’ (পৃঃ ১৫০, ১৯৫৮) বইটি। এই বইটিতে তিনি বাংলাদেশে মুসলমানদের প্রথম আগমন থেকে শুরু করে এদেশে মুসলিম রাজত্বের সময়কার উল্লেখযোগ্য ঘটনা বর্ণনা করেছেন এবং বাংলাদেশে এত অধিক সংখ্যক মুসলমান কেন হলো তারও একটি মীমাংসায় পৌঁছবার চেষ্টা করেছেন। ইসলামী বিষয়বস্তু সম্বন্ধে অন্যান্য বই: আবদুল্লাহ্ সুহরওয়ার্দীর ‘Sayings of Muhammad’-এর উপরে ভিত্তি করে রচিত মোহাম্মদ ইয়াছিনের ‘ইসলামের বিশেষত্ব’ (৫৬ পৃঃ ১৯৩০?) ও এ. এ. রহমানী রচিত ‘সওগাতে মোসলেম’ (৩৪ পৃঃ ১৯৩৫)। মোহাম্মদ ইয়াছিনের ‘ইসলামের বিশেষত্ব’ এক মৌলবী সাহেব এবং এক শিষ্যের মধ্যে প্রশ্নোত্তর ছলে লিখিত। মৌলবী সাহেব তাঁর শিষ্যকে ইসলামের বিশেষত্ব কোথায় তা শেখাবার প্রয়াস পেয়েছেন। আর এ. এ. রহমানীর ‘সওগাতে মোসলেম’ আহমদীয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রচার পুস্তিকা। খুলাফা-ই-রাশেদীনের লেখক এ. জেড. নূর আহমদের ‘মোহাদ্দেস প্রসঙ্গ’ (৩২ পৃঃ ১৯৩৭), “বোখারী’, ‘নয়ি’, ‘আবু দাউদ’, ‘ইবনে মাজা,’ ‘মুসলিম ও তিরমিজি’ প্রভৃতি হাদিস বেত্তাদের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী সংকলন। এ প্রবন্ধটি ১৩৩৪ সনে ঢাকা থেকে প্রকাশিত মুসলিম সমাজের মুখপাত্র ‘শিখায়’ প্রকাশিত হয় এবং পরে পুস্তকাকারে বের হয়। এ. জেড. নূর আহমদের অন্যান্য বই: ‘হযরতের কথামৃত’ (নবী আকরামের বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত খোতবার অনুবাদ), ‘কুরআনের কথা,’ ‘নয়া যামানা’ এবং ‘রাষ্ট্রগুরু জামাল উদ্দীন আফগানী’ ইত্যাদি। মৌলানা রুমীর মসনবীর গদ্যানুবাদ করেন মৌলবী আযহার আলী বস্তিয়ারী। এ অনুবাদ গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৯৬। এর এগারটি সংস্করণ হয়েছিল। খোন্দকার আমীনউদ্দিন আহমদের ‘দাওয়াতে এসলাম’ প্রকাশিত হয় ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দে (প্রথম সংস্করণ, ২৩৫ পৃঃ)। ১৯০৯ সনে কলকাতা টাউন হলে ভারত ধর্ম মহামণ্ডলী (Parliament of religions)-এর এক অধিবেশন হয়। উক্ত অধিবেশনে ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে প্রবন্ধ পড়ার ভার পড়ে খাজা কামালুদ্দীন, সালাহুদ্দীন খোদাবশ্, মীর্জা আবুল ফজল এবং খোন্দকার আমীনউদ্দিন আহমদের ওপর। খোন্দকার আমীনউদ্দিন আহমদ ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে উক্ত অধিবেশনে যে প্রবন্ধটি পড়েছিলেন, তারই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত রূপ তাঁর ‘দাওয়াতে এসলাম’। প্রাচীনকাল থেকে দুনিয়াতে যত ধর্ম প্রচারিত হয়েছে সেগুলোরই স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে তিনি হযরত মোহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক প্রচারিত ইসলামের ব্যাখ্যা করেছেন। যে যুগে প্রাচীন ধর্মগুলো পৃথিবীতে এসেছিল, তার প্রত্যেকটি জন্ম নিয়েছিল যুগের প্রয়োজনে। কালক্রমে মানুষের হাতে পড়ে সে সব ধর্মের বিকৃতি ঘটে। ইসলাম কোনযুগের ধর্ম নয়, মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধির, দ্বার মুক্ত করে দিয়ে যুগাতীত কালের ধর্ম হিসেবে ইসলাম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা করে আমীনউদ্দীন ইসলামের স্বাভাবিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিই অমুসলমানদের সহানুভূতিসম্পন্ন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাঁর ‘দাওয়াতে এসলাম’-এ। ঢাকার আমিনাবাদ নিবাসী মোহাম্মদ মোজাফফার হোসেন একজন প্রবন্ধকার। তাঁর ‘ইসলামের পার্থিব উন্নতি’ (জানুয়ারী ১৯৪২), ‘পর্দাতত্ত্ব’ (২য় সংস্করণ, অক্টোবর ১৯৪২) এবং ‘পরিবার নহে কারাগার’ মূলত সমাজতত্ত্বমূলক রচনা। আলহাজ কাজী মৌলানা মোঃ গোলাম রহমানের ‘মকছদোল মো’মেনীন বা বেহেস্তের কুঞ্জী’র (১ম ও ২য় খণ্ডের) চৌদ্দটি সংস্করণ হয়। এই বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৩২। কোরআন হাদীসের নানা উদ্ধৃতির সাহায্যে ইসলামের ব্যাখ্যা করার প্রয়াস এবং ইসলামের ‘আরাকান’ সম্বন্ধে সাধারণের শিক্ষাপোযোগী আলোচনা আছে এ বইটিতে। আযহার আলী প্রণীত ‘খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী’র সম্পাদক মোহাম্মদ কোরবান আলীর ‘উমদাতুল ইসলাম’ (পৃঃ ৩৪৩)-এর চতুর্থ সংস্করণ বের হয় ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে। ইসলামের ব্যবহার-বিধি, নামায, রোজা, হজ, যাকাত এবং ইসলামের নিয়মকানুন শিক্ষা দেবার মহৎ উদ্দেশ্যে এ বইটি রচিত। ‘কোরআনের আলো’ প্রকাশের কিছুদিন পরে মুহম্মদ আযহারুদ্দীন ১৯৩২ খ্রীস্টাব্দে ‘তাঁর ‘হাদীসের আলো’ গ্রন্থ (পৃঃ ৩০৪) প্রকাশ করেন। ‘হাদীসের আলো বা হাদীস শরীফের বঙ্গানুবাদ’ সিয়া সেত্তাহ্, মিশকাতুল মাসাবিহ্, জামায়েস্ সাগীর প্রভৃতি হাদীসের বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য গ্রন্থগুলো থেকে মোট এক হাজার পঁচিশটি সহি হাদিসের সুন্দর ও সরল বঙ্গানুবাদ। মহাপুরুষের উদার বাণী মানবজাতির সাধারণ সম্পত্তি। তাতে মানবমাত্রেরই সমান অধিকার। এ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আযহারুদ্দীন হযরতের সহস্রাধিক মূল্যবান বাণীকে আরবী থেকে বাংলায় নিয়ে এসে বাংলা ভাষাভাষীরই কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। এছাড়া ‘আরবের আলো’ নামেও তাঁর আর একটা গ্রন্থ পাওয়া যায়। ‘আরবের আলো’ হযরতের জীবনী। ‘কোরআনের আলো’ ‘হাদীসের আলো’ ও ‘আরবের আলো’ গ্রন্থত্রয়ীর সাহায্যে মুহম্মদ আযহারুদ্দীন ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সংস্কৃতি সম্বন্ধে একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতে চেয়েছেন, তা পরিস্কার বোঝা যায়। এ পর্যায়ে সৈয়দ আবদুর রহমান নামক আর একজন লেখকের নাম পাওয়া যায়। তিনি জামালপুর জেলার জোকারপড়া গ্রামের অধিবাসী। এ পর্যায়ে তাঁর দৃষ্টি গ্রন্থের পরিচয় পাই-‘এনায়েত রহমান’ এবং ‘উমদাতল মসায়েল’। এগুলো জনসাধারণকে ইসলামী শরা-শরীয়ত শেখানোর উদ্দেশ্যে রচিত। ‘উমদাতল মসায়েল’ প্রথম ভাগ কলকাতা ১৫৯নং কড়েয়া রোডস্থিত রেয়াজুল ইসলাম প্রেসে মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ কর্তৃক ১৩১৯ সালে (১৯০৬ খ্রীঃ) মুদ্রিত হয়। পবিত্র কোরআনের অনুবাদ ও মর্মবাণী সংকলন; ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় কোরআন শরীফের অনুবাদ প্রকাশে কোনো মনীষীরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়নি। এ গুরুকর্তব্যভার বহন করার জন্যে সর্বপ্রথমে এগিয়ে এসেছিলেন-ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ গিরিশচন্দ্রের কোরআনের অনুবাদের চতুর্থ সংস্করণের গোড়াতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘গিরিশচন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে।’ পবিত্র কোরআনের ও অন্যান্য ইসলামী ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশের গুরুদায়িত্ব গিরিশচন্দ্রের ওপর ন্যস্ত করার সময় কেশবচন্দ্র প্রার্থনা করেছিলেন-‘তোমার জীবন মহাপুরুষ মোহাম্মদের স্পিরিটে মহিমান্বিত ও অনুপ্রাণিত হউক।’ তাঁর ধর্মজীবনের সব সাধনা ও সিদ্ধির মধ্যে এ প্রার্থনাটি সার্থক হয়ে আছে। ১৮৮১-১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে গিরিশচন্দ্রের কোরআনের সঠিক বাংলা অনুবাদ মুদ্রিত হয় এবং সম্পূর্ণ অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে। এ অনুবাদ গ্রন্থ মূল আরবী ছাড়া প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্করণের সমস্ত মুদ্রণ ব্যাপারেই গিরিশচন্দ্র তত্ত্বাবধান করেন। তাঁর অনূদিত কোরআনের চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর বহু পরে, ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে। কোরআন অনুবাদ করে বাংলায় চার কোটি মুসলমান জনসাধারণকে তাদের আল্লাহর রসূলের ও কোরআনের সঙ্গে পরিচিত করেছেন-সর্ব প্রথম ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই। এ মহান পুণ্য ব্রত-সাধনায় তিনি ছিলেন অগ্রদূত। পাদ্রী উইলিয়াম গোল্ডস্যাকও কোরআন শরীফের পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদ করেন। গিরিশচন্দ্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার বহু পরে কোরআনের আংশিক অনুবাদ করেন মৌলবী মুহম্মদ নঈমুদ্দীন। নঈমুদ্দীন ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত করটিয়া সবুজগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯২৬ খৃষ্টাব্দে ইহধাম ত্যাগ করেন। আরবী, ফারসী, বাংলা এবং উর্দু প্রভৃতি ভাষায় তাঁর দখল ছিল। তিনি মুর্শিদাবাদ, এলাহাবাদ, জোনপুর, গাজীপুর দিল্লী, আগ্রা প্রভৃতি অঞ্চল ভ্রমণ করে সেখানকার আলেম ও মোহাদ্দেসের সংস্পর্শে এসে ইসলামী শরা-শরিয়াত ও শাস্ত্রাদি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হন। ভাই গিরিশচন্দ্রের পরে মুসলমানদের মধ্যে তিনিই বোধহয় কোরআন শরীফের প্রথম সার্থক অনুবাদক। তিনি প্রথম থেকে তেইশ পারার অনুবাদ করার পর ইেেন্তকাল করেন। তাঁর এ অনুবাদ জলপাইগুড়ি জেলার খানবাহাদুর রহিম বক্স সাহেবের চেষ্টায় মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। কোরআনের প্রথম তেইশ পারার অনুবাদের পূর্বেই তিনি আমপারার অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর কোরআনের অনুবাদ সঠিক হওয়া সত্ত্বেও সুখপাঠ্য। জানা যায় তিনি বোখারী শরীফেরও অনুবাদ করেছিলেন। ‘জব্দাতুল মসায়েল’ রচনা মৌলবী নঈমুদ্দীনের অন্যতম মহৎ কীর্তি। ‘জব্দাতুল মসায়েল’ (১ম ও ২য় খণ্ড) প্রথম সংস্করণ ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতাস্থ বি.পি.এম. প্রেসে মুদ্রিত হয়। ময়মনসিংহ জেলার জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলীর অর্থানুকূল্যে ‘জব্দাতুল মসায়েল’ গ্রন্থের প্রকাশ সম্ভব হয়। ‘জব্দাতুল মসায়েল’ একটি সুবৃহৎ গ্রন্থ। প্রথম খণ্ডের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৮৭ এবং দ্বিতীয় খণ্ডের ৩৫৫। এটির প্রথম খণ্ড দশম সংস্করণ এবং দ্বিতীয় খণ্ড তৃতীয় সংস্করণ ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ‘জব্দাতুল মসায়েল’ অর্থাৎ মুসলমানী ব্যবস্থাসমূহের সার সংগ্রহ প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে লিখিত। এটি নির্দিষ্ট কোনো একটি পুস্তকের অনুবাদ নয়, শরে বেকায়া, হেদায়া, কাজীখান, জামেয়র রমুজ, কামুজ ফতোয়াই আলমগীরী, দায়রোল মোখতার প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থের সংকলন। বাংলা ভাষায় ইসলামী শরা-শরীয়ত তথা বিধিবিধান সম্পর্কিত এটি একটি অমূল্য পুস্তক। ‘এনসাফ্’ ‘আদেল্লায় হানিফীয়া’, ‘কালেমাতুল কোফর’, ‘সেরাতুল মোস্তাকিম’, ‘এছবাতে আখেরজ্জোহর’, ‘রফা-এদায়েন’, ‘ফতোয়ায়ে আলমগীরী’ (১ম-৪র্থ খণ্ড) প্রভৃতি গ্রন্থও মৌলবী নঈমুদ্দীন রচনা করেছিলেন। হাফেজ মাহমুদ আলী তাঁকে করটিয়ার মাহমুদিয়া প্রেস নামে একটি প্রেস দান করেছিলেন। এ প্রেস থেকে তিনি আখবারে ইসলামিয়া নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করে প্রকাশ করতেন। এটি ছিল ‘শরীয়ত’ বিষয়ক পত্রিকা। মীর মোশররফ হোসেনের ‘গোজীবন’ পুস্তিকাটির কঠোর সমালোচনা করে ‘আখবারে ইসলামিয়া’ পত্রিকায় ফতোয়া প্রকাশ হয়েছিল। এরপরে সম্পূর্ণ কোরআন শরীফের সঠিক অনুবাদ করেন জেলা চব্বিশ পরগণার অধিবাসী মৌলবী আব্বাস আলী। মৌলবী আব্বাস আলীর কোরআনের অনুবাদ প্রকাশিত হবার কিছু পরে ‘প্রিয় পয়গম্বরের প্রিয় কথা’ এবং ‘সাহাবিয়া’ গ্রন্থদ্বয়ের লেখক রংপুরের খান বাহাদুর তসলিমুদ্দীন আহমদ (১৮৫২-১৯২৭ খ্রীঃ) প্রতি দশ পারা করে তিন খণ্ডে সম্পূর্ণ কোরআনের অনুবাদ করেন। তাঁর অনুবাদে মূল আরবী নেই। কিন্তু প্রত্যেক পৃষ্ঠার মাথায় সূরা, রুকু এবং আয়াতের সংখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং অনুবাদেও আয়াতের সংখ্যা লেখা হয়েছে। খান বাহাদুর তসলিমুদ্দীন ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে কোরআন শরীফের অনুবাদ শুরু করেন এবং ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে শেষ করেন। তিনি কোরআন শরীফের একটি সূচীপত্র বা Co-cordance রচনায় হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু তা শেষ করে যেতে পারেননি। তাঁর খণ্ড কোরআন-অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯২২, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯২৩ এবং তৃতীয় খণ্ড ১৯২৫ সালে। তসলিমুদ্দীন আইন ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে রংপুরে তিনি ওকালতী শুরু করেছিলেন। টাঙ্গাইল নিবাসী মৌলবী আবুল ফজল আবদুল করিমও সম্পূর্ণ কোরআনের অনুবাদ করেছিলেন। আবদুল করিমের অনুবাদে মুল আরবীও আছে। ইনি প্রথমে হাই স্কুলের হেড মৌলবী ছিলেন, পরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ফারসী ছাপার প্রুফ রীডার হন। ১৯৩৮ সালে মৌলবী মোহাম্মদ আবদুল হাকিম ও মোহাম্মদ আলী হাসান মিলিতভাবে কোরআন শরীফের মূল আরবীসহ বিশুদ্ধ বঙ্গানুবাদ ও বিস্তৃত তফসির বের করেন এটিই এ যাবৎ প্রকাশিত কোরআন শরীফের বাংলা অনুবাদগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। অনুবাদের বিশুদ্ধতা ও মৌলিক সৌন্দর্য তফসীরের গবেষণা ও প্রাচুর্য এবং ভাষায় মূলানুসারী অপূর্ব ব্যঞ্জনার জন্য এ অনুবাদ সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হয়েছে। মূল কোরআনের আয়াতমালার পাশে নম্বরসহ বিশুদ্ধ বঙ্গানুবাদ এবং নিম্নে বিস্তৃত তফসীর রয়েছে। অনুবাদের সঙ্গে সেল, রওয়েল, পামার, স্যার সৈয়দ আহমদ ও মৌলবী মোহাম্মদ আলী প্রভৃতি আধুনিক অনুবাদক ও তফসীরকারের যুক্তিপূর্ণ সমালোচনাও আছে। খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁর সমগ্র কোরআনের অনুবাদ মূল আরবীসহ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে। তাঁর অনুবাদের ভাষা সহজ ও সরল; স্থানে স্থানে টীকাও আছে। উল্লিখিত পূর্ণ কিংষা প্রায়-পূর্ণ অনুবাদগুলো ছাড়া অনেকেই কোরআন শরীফের আংশিক অনুবাদ করেছেন এবং কেউ কেউ কোরআনের উৎকৃষ্ট আয়াত এবং অংশসমূহের বাংলা সংকলন বেরু করেছেন। এদের মধ্যে ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দে কিরণ গোপাল সিংহ কোরআনের সার সংকলন করে প্রকাশ করেন। এটি ধারাবাহিক অনুবাদ নয়, বিভিন্ন স্থান থেকে নীতিমূলক বিষয়বস্তুর সংকলন।মৌলানা রহুল আমীন অনুবাদ করেন ‘আমপারা’র এবং শুরু থেকে আরও তিন সিপারার। মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ‘আমপারা’ এবং শুরু থেকে সূরা আল্ এমরান পর্যন্ত কোরআনের অনুবাদ করেন। আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে ১৯২২ সালে মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ‘আমপারা’র অনুবাদ করেছিলেন। ‘উন্মুল কেতাব’ নাম দিয়ে মৌলানা সাহেব সূরা ফাতেহার অনুবাদও স্বতন্ত্র পুস্তিকাকারে প্রকাশ করেছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে মৌলানা সাহেব কোরআনের অনুবাদে লিপ্ত থেকে পাঁচ খণ্ডে সম্পূর্ণ কোরআনের অনুবাদ প্রকাশ করেন। মৌলবী এয়ার আহমদও আমপারার অনুবাদ করেন। ডক্টর মুহম্মদ কুদরত-ই-খুদা ‘পবিত্র কোরআনের পূত কথা’ (মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বাণীর বাংলা বিবরণ, প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ) যথাক্রমে ১৯৪৫ এবং ১৯৪৭ সালে বের করেন। এ দুইভাগের পাঁচ সিপারা পর্যন্ত কোরআনের মহাবাণীর অন্তনির্হিত মর্ম যুগের পরিপ্রেক্ষিতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বুঝবার প্রয়াস আছে। কাজী নজরুল ইসলাম কবিতায় আমপারার অনুবাদ করেন। বরিশালের মীর ফজলে আলী কোরআনের কতগুলো অংশ কবিতানুবাদ ক’রে ‘কোরআন কণিকা’ নাম দিয়ে ছেপে বের করেন। তাঁর কবিতানুবাদ সুন্দর হয়েছিল। এ প্রসংগে মুহম্মদ আযহারুদ্দীনের ‘কোরআনের আলো’র কথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। ‘পয়গম্বর কাহিনী’ এবং ‘এসরাইল বংশীয় নবীগণ’-এর লেখক ফজলুর রহিম চৌধুরীর ‘কোরআনের সুবর্ণ কুঞ্জিকা’ও বিশেষ স্মরণীয়। এটি কোরআন শরীফের উৎকৃষ্ট অংশ বিশেষের একটি চয়নিকা। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সূরা ফাতেহার অনুবাদ ও তফসীর এবং ‘আলমতারা’ পর্যন্ত অন্যান্য দশটি সুরার অনুবাদ ‘মহাবাণী’ নাম দিয়ে প্রকাশ করেন ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে। তিনি কোরআনে বর্ণিত বিভিন্ন বিষয়ে বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। সেগুলো ‘কোরআন প্রসঙ্গ’ নামে স্বতন্ত্র গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সিরাজুল ইসলামের ‘হযরতের অমৃতবাণী’ এবং মৌলবী নকীবুদ্দীনের ‘কোরআন তত্ত্ব’ (১-৫ খণ্ড) এ বিভাগের উল্লেখ করার মতো বই। মৌলবী মুহম্মদ তৈমুরেরও কোরআন শরীফের একটি সার সংকলন পাওয়া যায়। বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যক্তিগত গবেষণা এবং চেষ্টায় কুরআন শরীফের বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এবং এ ধরনের অনুবাদ ভবিষ্যতেও প্রকাশিত হতে থাকবে, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে একটি প্রমাণিক এবং নির্ভরযোগ্য অনুবাদের অপেক্ষায় আমরা ছিলাম। পাকিস্তান আমলে বর্তমান ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, ইসলামিক একাডেমী নামে পরিচিত ছিল। উক্ত ইসলামিক একাডেমী দেশের প্রখ্যাত উলামা ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিকদের সমন্বয়ে গঠিত এ একটি উচ্চ পর্যায়ের বোর্ডের মাধ্যমে বাংলা ১৩৭৪ সালে কোরআন শরীফের বাংলা তরজমার প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। অল্প দিনের মধ্যেই সমগ্র অনুবাদটি প্রকাশিত হয়। অনুবাদটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে এবং বর্তমানে এর সপ্তদশ মুদ্রণ বাজারে চলছে। এই অনুবাদটি কেন প্রকাশ করা হল সে সম্পর্কে প্রথম সংস্করণের প্রকাশকের কথায় বলা হযছে: ‘বাঙলা ভাষায় অনেক কয়েকটি তফসীর এবং তরজমা থাকা সত্ত্বেও ইসলামিক একাডেমী আরেকখানি তরজমা প্রকাশের দায়িত্ব কেন গ্রহণ করিল, সে সম্পর্কে দুটি কথা শুরুতেই বলা প্রয়োজন। প্রথমত কুরআনুল করীমের ভাষায় যে গতি-স্বাচ্ছন্দ্য, ধ্বনি-গাম্ভীর্য ও ব্যঞ্জনা রহিয়াছে বাংলা তাফসীর ও তরজমাগুলিতে তাহা পাওয়া যায় না; মূলের ভাবোদ্দীপনা তরজামায় রক্ষিত না হওয়ায় কুরআনুল করীমের অন্যান্য মাহাত্ম্য সম্পর্কে পাঠক পাঠিকাদের কোন ধারণাই জন্ম না। দ্বিতীয়ত মামুলী রচনারীতি তথা ভাষার দুর্বলতা ও আড়ষ্টতায় দরুন বহু ক্ষেত্রেই কুরআনুর করীমের আয়াতসমূহের নিগূঢ় তাৎপর্য ও অর্থ ঢাকা পড়িয়া গিয়েছে। তৃতীয়ত বাংলা ভাষায় এখনো মূলানুগ অথচ সুখপাঠ্য একখানি সার্থক তরজমার অভাব রহিয়াছে, এ কথা বলাই বাহুল্য।’ এই অনুবাদ ও সম্পাদনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন শামসুল উলামা বেলায়েত হোসেন, মাওলানা আবদুর রহমান কাশগরী, মুহাম্মদ মাহমুদ মুস্তফা শা’বান, শামসুল উলমা মুহম্মদ আমীন আব্বাসী, ডক্টর সিরাজুল হক, ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ, মাওলানা ফজলুল করীম, এ. এফ এম আবদুল হক ফরিদী, আহমদ হুসাইন, মাওলানা আলাউদ্দিন আল-আজহারী, অধ্যক্ষ এ এইচ, এম আবদুল কুদ্দুস, মাওলানা মীর আবদুস সালাম, অধ্যাপক শাহেদ আলী, মাওলানা মুহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ্, হাফেজ মইনুল ইসলাম এবং আবুল হাশিম।” আমি নিম্নে এই অনুবাদ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। উদ্ধৃতিটি সূরা আল ইমরানের সপ্তম থেকে নবম আয়াত পর্যন্ত: “তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করিয়াছেন যাহার কতক আয়াত সুস্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন; এইগুলি কিতাবের মূল অংশ; আর অন্যগুলি রূপক; যাহাদের অন্তরে সত্য লঙ্ঘন প্রবণতা রহিয়াছে শুধু তাহারাই ফিতনা এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে যাহা রূপক তাহার অনুসরণ করে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেহ ইহার ব্যাখ্যা জানে না। আর যাহারা জানে সুগভীর তাহারা বলে আমরা ইহা বিশ্বাস করি, সমস্তই আমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে আগত; এবং বোধশক্তি- সম্পন্ন ব্যতীত অপর কেহ শিক্ষা গ্রহণ করে না। হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শকের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্য-লঙ্ঘনপ্রবণ করিও না এবং তোমার নিকট হইতে আমাদিগকে করুণা দাও, তুমিই মহাদাতা। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি মানব জাতিকে একদিন সমাবেশ করিবে ইহাতে কোন সন্দেহ নাই; আল্লাহ নির্ধারিত সময়ের ব্যতিক্রম করেন না।” ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত কুরআন শরীফের অনুবাদ গ্রন্থের নাম: ‘আল-কুরআনুল করীম’। কুরআন শরীফের আর একটি সুন্দর বাংলা অনুবাদ করেছেন মাওলানা মহিউদ্দিন খান। এ অনুবাদটি লাহোরের বিশিষ্ট আলেম মুক্তি মুহম্মদ শফীর উর্দু অনুবাদের বাংলা অনুবাদ। কিন্তু উর্দু অনুবাদের বাংলা অনুবাদ হলেও এ অনুবাদটি অত্যন্ত সুন্দর এবং তাৎপর্যবহ হয়েছে। মাওলানা মুহিউদ্দিনের ভাষা সুন্দর এবং সুশঙ্খল। সাধারণত আলেম সম্প্রদায়ের বাংলা রচনা যেমন দুর্বল হয়ে থাকে তেমন নয়। অনুবাদের সংগে কিছুটা তাফসীর এবং ব্যাখ্যাও আছে। কুরআন শরীফের বিখ্যাত তাফসীর হচ্ছে ‘তাফসীর ইবনে কাসীর।’ এর একটি অনুবাদ বর্তমানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত মোট ১৩টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন ড. মুহম্মদ মুজিবর রহমান। এই অনুবাদটি সম্পূর্ণ প্রকাশিত হলে বাংলা ভাষায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসাবে গৃহীত হবে। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যে সমস্ত তাফসীর শাস্ত্র ব্যক্তিত্ব অমরত্ব লাভ করেছেন তার মধ্যে হাফিজ ইমাদুদ্দিন, ইসমাঈল ইবনু কাসীরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনুবাদক মুজিবুর রহমানের বাংলা ভাষা সৃমদ্ধ, বলিষ্ঠ এবং সাবলীল। এই গ্রন্থের জন্য একটি তাফসীর পাবলিকেশন কমিটি রয়েছে। এ কমিটির সদস্যবর্গ নিজেদের উদ্যোগে এই তাফসীরটি প্রকাশ করে চলেছেন। মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর কোরআন শরীফের বিখ্যাত তফসির ‘তাফহীমুল কোরআন’-এর বঙ্গানুবাদ করেছেন (১৯৮০)। মওলানা আবদুর রহীম সাধারণ তরজমার রীতি পরিত্যাগ করে স্বচ্ছন্দে অনুবাদের পথ বেছে নিয়েছেন যেহেতু শাব্দিক তরজমা দ্বারা কোরআনের মূল ভাবধারা অনুধাবনের ব্যাপার অনেক দিক থেকে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মূল তফসিরটি বিশ্ববিখ্যাত এবং আরব বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়েছে। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) সাহাবী এবং অন্যান্য পীর পয়গম্বরদের জীবনী ও বাণী: উনবিংশ শতাব্দীর নবম দশকে ‘সুধাকর দল’ বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ধারার সূত্রপাত করেন। এঁদের এবং এ ধারার অনুবর্তীদের প্রধান উপজীব্য ছিল ইসলাম ধর্ম, সূফীতত্ত্ব ও দর্শন এবং ইসলামী কাহিনী ইত্যাদি নিয়ে বই রচনা করা। এ বিষয়বস্তুর মধ্যে হযরত মুহম্মদের (সঃ) জীবনী ও বাণী (অর্থাৎ হাদীস সংগ্রহ) হযরতের পূর্ববর্তী অন্যান্য নবীর জীবনকাহিনী, তাদের সহিষ্ণুতা, ধর্মপ্রচার ব্রত, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং হযরতের অন্যান্য সাহাবীর জীবনই প্রাধান্য লাভ করেছে। এসব জীবনী আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁদের ধর্মাদর্শের ব্যাখ্যাও এঁদের জীবনীকাররা দিয়েছেন। এ বিভাগে সব চেয়ে বেশি রচিত হয়েছে হযরত মোহাম্মদের (সঃ) জীবনী। বাংলা ভাষায় ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই হযরত মুহাম্মদের প্রথম জীবনী লেখক। তারপরই শেখ আবদুর রহিমের নাম পাওয়া যায়। এর পরেই সুধাকর দলের মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ হযরতের জীবনী লেখেন। এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ রচিত ‘হযরত মোহাম্মদ মোস্তফার জীবনচরিত’ শীর্ষক গ্রন্থটির ভূমিকা থেকে এ চমৎকার তথ্যটুকু উদ্ধৃত করা প্রয়োজন বলে মনে করি: “আঁ হযরত (ছালঃ) এর ‘ছওয়ানে-ওমরি’ (জীবনচরিত) আরবী, পারশী ও উর্দু ভাষায় অনেক আছে; কিন্তু প্রায় সাড়ে তিন কোটি বংগীয় মুসলমানের মধ্যে ৫০ বৎসর পূর্বেও তাঁহার পবিত্র জীবনী কোনও মুসলমান লেখক লেখেন নাই। সর্বপ্রথম কোরআনের বঙ্গানুবাদক, নববিধানী ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী আচার্য কেশবচন্দ্র সেনের ভক্ত শিষ্য, বাবু গিরিশচন্দ্র সেন আঁ হযরত (ছালঃ) এর একখানি জীবনচরিত বাংলা ভাষায় লিখিয়া প্রকাশ করেন। উহাতে তাঁহার ব্রাহ্ম ধর্ম-বিশ্বাসের ছায়াপাত ছিল; পরে ১২৯১ কিংবা ৯২ সালে (প্রকৃতপক্ষে ১২৯৪) সাল অর্থাৎ ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে) কলিকাতাস্থ ডভ এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজদ্বয়ের সুযোগ্য আরব্য এবং পারশ্যধ্যাপক, উৎসাহের জ্বলন্ত মূর্তি এবং স্বজাতিগতপ্রাণ, আমাদের শ্রদ্ধেয় বন্ধু মহানুভব মৌলবী মেয়রাজুদ্দীন আহমদ মরহুম মনসুরের সাহায্যে ‘মিহির ও সুধাকর’ এবং “মোসলেম হিতৈষী’ সম্পাদক ভ্রাতৃবর মুন্সী শেখ আবদুর রহিম সাহেব আঁ হযরতের একখানি জীবন-চরিত লিখিয়া মুদ্রিত করেন। পূর্বোক্ত মৌলবী সাহেব মরহুম আরবী ও পারশী ভাষার প্রামাণ্য ইতিহাসসমূহ হইতে ইহার মাল মসলা সংগ্রহ করিয়া দিয়াছিলেন। কাজেই পুস্তকখানি উপাদেয় এবং মুসলমানদিগের পাঠের বিশেষ উপযোগী হইয়াছিল। এই জীবনী খানিতে ইসলামধর্মনীতি সম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হইয়াছে।” এ আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় রামপ্রাণ গুপ্ত সম্ভবত হযরতের চতুর্থ জীবনীকার। রামপ্রাণ গুপ্তের ‘হযরত মোহাম্মদ’ (পৃঃ ৫৫) লিখিত হয় ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে। এ পুস্তকটিতে রামপ্রাণ গুপ্ত সত্যধর্ম ইসলাম প্রচারে হযরতের সাধারণ কথা ব্যক্ত করেছেন। হযরতের জীবন যে একাধারে কর্মযোগ ও ধর্ম সাধনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রামপ্রাণ গুপ্ত তাতেই মোহিত হয়েছেন এবং সে কথাই এখানে ব্যক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। রামপ্রাণ গুপ্তের ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত বৃহত্তর গ্রন্থ ‘ইসলাম কাহিনী’ ইসলাম ধর্মকথা এবং ইসলামের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনার সংকলন। ‘সঞ্জীবনী’ সম্পাদক বাবু কৃষ্ণকুমার মিত্রও ‘মহম্মদ চরিত’ নাম দিয়ে হযরতের জীবনী লিখেছিলেন। তাঁর লিখিত হযরতের জীবনী প্রধানত হিন্দু ও ব্রাহ্ম সমাজে গৃহীত হয়েছিল। ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দে আবুল হোসেন ‘হযরত মোহাম্মদের জীবন’ রচনা করেন। এই বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ২১৮। এর কিছু পরের রচনা রংপুরের অধিবাসী খান বাহাদুর তসলিমুদ্দীন আহমদের (১৮৫২-১৯২৭) হযরত মুহাম্মদের জীবনী ‘সম্রাট পয়গম্বর’। তার মৃত্যুর পর ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে বইটি প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটি হযরত মুহাম্মদের জীবনী হিসেবে প্রামাণ্য এবং সুলিখিত। হযরতের জীবনের প্রধান ঘটনাবলী নিয়ে ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তসলিমুদ্দীন এ বইটি লিখেছেন। ইসলাম প্রচারক হযরতের জীবনাদর্শ বাঙালী সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক এবং তার সমসূত্রে বাঙালী মুসলমানের চরিত্র সুদৃঢ় হোক এ সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়েই তসলিমুদ্দীন লেখনী ধরেছিলেন। ‘সম্রাট পয়গম্বর’-এ তাঁর আদর্শ অক্ষুণ্ণ রয়েছে। তাঁর অপর গ্রন্থ দুটি-‘প্রিয় পয়গম্বরের প্রিয় কথা’ (প্রথম সংস্করণ, ১৯১৫) খ্রীঃ) এবং ‘সাহাবিয়া’ (ডিসেম্বর ১৯২৬ খ্রীঃ)। ‘প্রিয় পয়গম্বরের প্রিয় কথা’ প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ ‘মিশকাতুল মাসাবিহ’ থেকে প্রায় শ’ পাঁচেক হাদিসের অনুবাদ সৎশিক্ষা, শিষ্টাচার, সুব্যবহার ও সৎজীবন সংক্রান্ত বিষয়বস্তুর ওপরে হযরতের বাণী থেকে তসলিমুদ্দীন তাঁর ‘প্রিয় পয়গম্বরের প্রিয় কথা’ সংকলন করেছেন। ‘সাহাবিয়া’ (বা পয়গম্বর সহযোগিনী অষ্টবিংশতি মুসলিম মহিলা) গ্রন্থে তিনি হযরতের সহধর্মিণী, তাঁর কন্যা এবং আত্মীয়া সহযোগিনীদেরই জীবন কাহিনী অতি সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বিবৃত করেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগের মহীয়সী মহিলাবৃন্দ কিরূপে হযরতের সেবায় আত্মোৎসর্গ করেছিলেন এ বইটিতে তার বিশিষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। হযরতের স্ত্রী, কন্যা ও সাহাবিয়ারা ছিলেন মুসলিম নারী সমাজের শিরোভূষণ; গৃহধর্মে, ইসলামের পরিচর্যায় ধর্মযুদ্ধে, হযরতের সেবায় এবং জ্ঞানানুসরণে এ মহীয়সী মহিলারা যে আদর্শ রেখে গেছেন তা সকল দেশের সকলকালের নারী সমাজের অনুকরণীয়। এছাড়া তস্লিমুদ্দীন ‘মৌলুদ নফিসা’ এবং ‘সুরিয়া বিজয়’ও রচনা করেছিলেন। ‘মৌলুদ নফিসা’ বা জন্মোৎসবের কোনো কবিতা পড়ে মনে হয়, যেন সেগুলো তাঁর সাধন মুহূর্তের। মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ রচিত ‘মোস্তফা চরিত’ (১৯২১) হযরত মোহাম্মদের জীবন আলোচনামূলক ৭৭৫ পৃষ্ঠার একটি বৃহৎ গ্রন্থ। মুহাম্মদ আকরম খাঁর ‘মোস্তফা চরিত’ শুধু গতানুগতিক জীবনী নয়। হযরতের জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে অন্যান্য জীবনীকার যে পন্থা অবলম্বন করেছেন তিনি তা করেন নি। অন্যান্য জীবনীকার হযরতের জীবনের ঘটনাবলী সম্বন্ধে প্রধানত ‘তন্ত্রী’, ‘তবকাত’, ‘ইবনে হিশাম’ ও ‘ওয়াকেদী’র উপরেই নির্ভর করেছেন, কোরআন হাদিসের মাপকাঠিতে তাঁদের বর্ণনার সত্যাসত্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন নি। মৌলানা সাহেব শুধু ইতিহাসকারদের বর্ণনার ওপরে নির্ভর না করে কোরআন হাদীসের তুলাদন্ডে তাঁদের বর্ণনার সত্যাসত্য বিচার করেছেন। ‘মোস্তফা চরিত’-এ অন্ধ ভক্তির উচ্ছ্বাস নেই। প্রত্যেকটি ঘটনাকে তিনি ঐতিহাসিকের মন নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে বিচারসহ করে যাঁচাই করে দেখেছেন। তাঁর ভাষা বলিষ্ঠ এবং যুক্তিবহ। ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠতা হযরত মহাম্মদ সম্বন্ধে মুসলিম জগতের যেসব শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে, তার মধ্যে ‘মোস্তফা চরিত’-এরও একটা বিশিষ্ট স্থান আছে। বাংলা ভাষায় হযরতের জীবনী ও ধর্মালোচনা সংক্রান্ত গ্রন্থাদির মধ্যে ‘মোস্তফা চরিত’ অবিসংবাদিতভাবে শ্রেষ্ঠ রচনা। এছাড়া মৌলানা সাহেবের ‘মোস্তফা চরিতের বৈশিষ্ট্য’ শীর্ষক একটি পুস্তিকাও পাওয়া যায়। মৌলানা আকরম খাঁ ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে ২৪ পরগনার অন্তর্গত হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আকরম খাঁর পূর্ব পুরুষগণ হিন্দু ছিলেন। রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় আকরম খাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। মাসিক ‘মোহাম্মদী’ ও ‘দৈনিক আজাদ’ সম্পাদনার ভেতর দিয়ে মুসলিম বাংলার ইতিহাসে তিনি একটি Institution-এর স্রষ্টা। গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ (১৯৪২) হযরত মোহাম্মদের জীবনী এবং ইসলামধর্মের প্রচার ও বিস্তৃতি সম্পর্কে এ শতাব্দীতে রচিত একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বইটি অত্যন্ত সুলিখিত এবং সুখপাঠ্য। গোলাম মোস্তফা কবি। ‘বিশ্বনবী’তে তার কবি মনের প্রকাশ সুস্পষ্ট এবং রচনাও আবেগপ্রণেদিত। ‘বিশ্বনবী’ রচনা গোলাম মোস্তফার সাহিত্যিক জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। খান বাহাদুর আহসানুল্লাহ রচিত ‘ইসলাম ও আদর্শ মহাপুরুষ’ ও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এ বইটি লিখিত হয় ১৯২৪ সালের দিকে। আহসানুল্লাহ ভক্ত; সুতরাং ইসলাম-প্রচারক আদর্শ মহাপুরষ হযরত মুহাম্মদের (সঃ) জীবনী লিখতে গিয়ে তার গ্রন্থে যে ভক্ত মনের পরিচয় তিনি দেবেন তা অবধারিত। এ বইটিতে প্রকৃতপক্ষে ঘটেছেও তাই। এ বইটিতে সূফী তত্ত্বের প্রভাব পড়েছে। মৌলানা আবদুল খালেক রচিত ‘ছাইয়েদুল মুরছালীন’ (প্রথম খন্ড-মূল গ্রন্থ পৃঃ ৮৭১, ভূমিকা ইত্যাদি পূর্ব কথা ৯০-১০০; ২৪নং বখশীবাজার ঢাকা থেকে মওদুদুর রহমান, আবু আহমদ মোবাশের কর্তৃক ১৩৫৭ সনে (১৯৫০ খ্রীঃ) প্রকাশিত) হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর অর্ধনা প্রকাশিত জীবনীগ্রন্থগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ বিরাট গ্রন্থটির রচনায় লেখকের শ্রমশীলতা এবং হযরতের প্রতি অকৃত্রিম হৃদয়ানুরাগ লক্ষ্য করবার মতো। তবে এ ভাষাতে ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে। এ পর্যায়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নামও স্মরণীয়। হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর জীবনী ও বাণী সম্পর্কিত অনেক কয়টি বই তিনি লিখেছেন। ‘শেষ নবীর সন্ধানে’ (মার্চ ১৯৬১, ছোটদের রসুলুল্লাহ্’, (সঃ) আগস্ট ১৯৬২), ‘অমর কাব্য’ (অক্টোবর ১৯৬৩) নামক তিনটি বই এ ধারায় তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। ‘বিশ্বের শেষ নবীর’ (সঃ) জীবন বৃত্তান্তে কতকগুলি সমস্যা আছে। ‘শেষ নবীর সন্ধানে’ পুস্তকটিতে তিনি সে-সমস্যাগুলির সন্ধান ও সমাধান দিতে প্রয়াস পেয়েছেন। ‘রসূলুল্লাহ সকল মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ। তাঁকে জানা চাই। তাঁর আদর্শে জীবন গ’ড়ে তোলা চাই। বাল্যকালে মনে যে ভাবের ছাপ পড়ে, তা স্থায়ী হয়। এ জন্য ‘ছোটদের রসূলুল্লাহ’ তিনি লিখেছেন ও প্রকাশ করেছেন। তাঁর ‘অমর কাব্য’ মুহম্মদ শরফুদ্দীন বিন্ স’ঈদ বিন্ হসন বুসীরী (রাঃ) রচিত ‘কসীদতুল বর্দ; ও কার বিন্ যুহয়র (রাঃ) রচিত ‘বানত-সু- আদ’ কাব্য দুইটির সরল গদ্যানুবাদ। কসীদতুল বুর্দ: কাব্য হিসেবেই কেবল বিখ্যাত নয়, পবিত্র ও পুণ্যজনক বলে হযতের (সঃ) ভক্তগণের নিত্য পাঠ্য ওযীফা। ডক্টর শহীদুল্লাহ, এ কাব্যটি নির্ভুল গদ্যানুবাদ করে অশেষ পুণ্যার্জন করেছেন। শহীদুল্লাহ সাহেবের ইব্বালকৃত ‘শিকওয়াহ ও জওয়াব-ই-শিকওয়াহ’র অনুবাদ (১ম সং ১৯৪২, ৩য় সং ১৯৬৪) এবং দীওয়ান-ই-হাফিজ (সঞ্চয়ন) অনুবাদও (১ম সং ১৯৩৮) প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য। প্রবন্ধকার মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী লিখিত হযরতের জীবন ‘মরুভাস্কর’ (১ম সং ১৯৪১, ২য় সং ১৯৪৭, পৃঃ ২০৫) এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বুলবুল সম্পাদক হাবীবুল্লাহ বাহার ‘উন্নত জীবন সিরিজ’ নামক একটি সিরিজ সম্পাদনা করতে ব্রতী হয়েছিলেন। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘মরুভাস্কর’ এ সিরিজেরই একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বিচারসহ মন, পাণ্ডিত্য ও চিন্তাশীলতার জন্যে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর খ্যাতি আছে। ‘মরুভাস্কর’-এ হযরতের জীবনে যে দিকগুলো রূপায়িত হয়েছে তাতে ওয়াজেদ আলী তাঁর খ্যাতি অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছেন। মাওলানা মুহিউদ্দিন খান আল্লামা শিবলী নোমানীর সীরাতুন্নবীর একটি সংক্ষেপিত বাংলা সংস্করণ প্রকাশ করেছেন। এইটি শিবলী নোমানীর গ্রন্থে জীবনী অংশের উপর ভিত্তি করে রচিত। নোমানীর গ্রন্থটি বিশ্ব সাহিত্যের সর্ববৃহৎ জীবনীগ্রন্থগুলির অন্যতম। এ গ্রন্থটি দীর্ঘকাল যাবৎ সীরাত শাস্ত্রের একখানা আকর গ্রন্থরূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাঁর গ্রন্থটি উর্দুতে রচিত ছিল এবং ৬ খণ্ডে সমাপ্ত হয়েছিল। মাওলানা মুহিউদ্দিন একখণ্ডে সংক্ষেপিতভাবে বাংলা প্রকাশিত করেছেন। এ গ্রন্থটিও বাংলা ভাষায় রসূলের জীবনী গ্রন্থে একটি মূল্যবান সংযোজন। সীরাত গ্রন্থগুলির মধ্যে প্রাচীনতম গ্রন্থ হচ্ছে ‘সীরাতে ইবনে হিশাম’। এর একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ আকরমে ফারুক করেছেন। এটি মোজাম্মেল হক কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে ঢাকাস্থ বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম প্রকাশের তারিখ ১৯৮৮। এ অনুবাদের ভাষা সুন্দর এবং মনোজ্ঞ। বাংলা ভাষায় এই ধারা সর্বশেষ গ্রন্থ সৈয়দ আলী আহসান রচিত ‘মহানবী’। এই গ্রন্থ প্রকাশের তারিখ ১৯৯৪। এবং এটি প্রকাশ করেছেন আহমদ পাবলিশিং হাউজ। এ গ্রন্থ সম্পর্কে প্রকাশকের প্রতিবেদন নিম্নে উপস্থিত করা হল: ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সৈয়দ আলী আহসান একজন অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। বাংলা সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে তাঁর আশ্চর্য অধিগম্যতা আছে। শিল্পকলা বিষয়েও তাঁর পরিণত বুদ্ধি এবং বিচার বিশ্লেষণ সকলকে মুগ্ধ করেছে। মানবতাবোধের সকল অঙ্গনকে তিনি স্পর্শ করতে চেয়েছেন। আবাল্য তিনি ধর্মীয় পরিবেশে বড় হয়েছেন। তাঁর পূর্বপুরুষ সকলকেই সূফী মতাদর্শে দীক্ষিত ছিলেন। শৈশবে পারিবারিক পরিবেশে আরবী ফারসী ও উর্দু শিক্ষা লাভ করেছেন। তাঁর দুটি ধর্মীয় গ্রন্থ ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। গ্রন্থ দুটির নাম ‘হে প্রভু আমি উপস্থিত’ এবং ‘নাহজুল বালাঘা।’ সম্প্রতি তিনি মহানবী সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের একটি অসাধারণ জীবনীগ্রন্থ আমাদের উপঢৌকন দিয়েছেন। সাহিত্যের একটি বিস্ময় পরিচর্যা ঘটেছে। একটি মহান জীবন এবং প্রজ্ঞার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে তিনি এ গ্রন্থটি রচনা করেছেন। যে জীবন মানুষকে অভিভূত করে। যে জীবন বিধাতার নিকট আত্মসমর্পণের একটি অলৌকিক পরিচয় বহন করে এবং যে জীবন সকল মানবের কল্যাণে সর্ব সময়ের জন্য নিয়োজিত সেই জীবনের একটি মনোজ্ঞ আলেখ্য ‘মহানবী’ গ্রন্থটি। আমরা এ গ্রন্থটি পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে গর্ববোধ করছি।” ‘প্রিয়তম নবী’ বলে মহানবীর একটি জীবনী শিশির দাস নামে এক ভদ্রব্যক্তি লিখেছেন। বইটি প্রকাশ পায় ১৯৮৭ সালের কলকাতা থেকে। গ্রন্থটি ভক্তের দৃষ্টিতে লেখা। লেখক সমগ্র জীবনীটি কুরআন শরীফ এবং হাদীসের আলোকে উপস্থাপিত করেছেন। যতদূর মনে হয় শিশির দাস একজন একেশ্বরবাদী পুরুষ। ড. ওসমান গনি ‘মহানবী’ বলে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে কলকাতা থেকে। তিনি ইসলামের ধারাবাহিক ইতিহাস নয় খণ্ডে প্রকাশ করেছেন। তার প্রথম খণ্ডটি হলো মহানবী হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী। এছাড়া হযরতের জীবনের কতগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে ছোটদের উপযোগী করে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী রচনা করেন ছোটদের ‘হযরত মোহাম্মদ’ (১৯৪৮ খৃঃ)। এ বইটিতে ধর্ম ও অর্ধমের পার্থক্য আলো আর কালো তথা আলো আঁধারের মধকার পার্থক্যরূপে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। বিষয়বস্তুর নির্বাচন তত্ত্ব-গন্ধী হলেও সহজ বর্ণনার জন্যে ছোটদের বোধগম্য হয়ে উঠেছে। হযরতকে বলা হয়েছে অন্ধকার যুগের আলো, নাম দেওয়া হয়েছে ‘আলোক শিশু’। এ পর্যায়ে সফিউদ্দীন আহমদ (১৮৭৭-১৯২২?) নামক আর একজন লেখকের সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর ‘ফাতেমা জোহরা’, ‘হযরত আলী’ ‘হযরত বড় পীর সাহেবের জীবনী’ ‘মজলিস’ প্রভৃতি গ্রন্থ এ পর্যায়ে রচনা হিসেবে উল্লেখের দাবী রাখে। তিনি (মোহাম্মদী বুক এজেন্সী) ‘ছোটদের হযরত মোহাম্মদ’, পুণ্য কাহিনী, শিশুর ‘সৈয়দ সাহেব’, ‘কনৌজ কুমারী’ ‘প্রতাপনন্দিনী’ এবং ‘দুইটি ভগ্নী’ প্রভৃতি উপন্যাসও রচনা করেছিলেন। তাঁর শিশুদের জন্য লেখা বইগুলো সহজ ভাষায় রচিত হয়েছিল। তাঁর উপন্যাসগুলো গ্রাম্যতাদোষ মুক্ত নয়। এয়াকুব আলী চৌধুরী(১৮৮৭-১৯৩৮): ফরিদপুর জেলার পাংশা গ্রামের এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৭-১৯৩৮) ইসলাম ধর্ম, ইসলাম দর্শন, তাসাওওয়াফ এবং তমদ্দুনের ভিত্তিতে তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্য রচনা করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর নাম ‘মানব মুকুট’, ‘নূরনবী’, ‘শান্তিধারা’ এবং ‘ধর্মের কাহিনী’। ইসলাম বিষয়বস্তুর ওপরে রচিত হওয়া সত্ত্বেও বইগুলো অত্যন্ত সুলিখিত বলে এদেশের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেরই অকুণ্ঠ প্রীতি ও প্রশংসা অর্জন করেছে। ফলে প্রত্যেকটি বইয়ের বহু সংস্করণ হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পরে ‘মানব মুকুট’-এর (পৃঃ ৭৮) পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। ‘নূরনবী’র (পূঃ ১১৪) তৃতীয় সংস্করণ হয় ১৯৫০ সালে, ১৯৪৮ সালে হয় ‘শান্তিধারা’র ষষ্ঠ সংস্করণ। ‘ধর্মের কাহিনী’ (পৃঃ ৫৬) ১৯১৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হলেও তার পঞ্চম সংস্করণ প্রকশিত হয় ১৯৫২ সালে। ‘মানব মুকুট’ ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী হযরত মুহাম্মদের জীবন ও শিক্ষাকে ভিত্তি করে রচিত। এ গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন দিক থেকে মহানবীর জীবন ও শিক্ষাদর্শের আলোচনা করেছেন। মহানবীর জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে এ গ্রন্থে তিনি অপরূপ সত্যানুসন্ধিৎসার পরিচয় দিয়েছেন; তারই ফলে লাভ করেছেন তিনি হযরতের প্রচারিত সার্বজনীন আদর্শের সন্ধান। তাঁর ‘শান্তিধারা’ গ্রন্থে ছ’টি প্রবন্ধ রয়েছে: ‘শান্তিধারা’, ‘ইসলামের স্বরূপ;’, ‘ইসলামের ধারা,’ ‘রমজান’, ‘আজান’, ‘উপাসনা’। ইসলাম শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘শান্তি।’ ইসলামী আদর্শে অনুপ্রাণিত প্রবন্ধগুলোকে তাই একত্রে গ্রথিত করে ‘শান্তিধারা’ নাম দেওয়া হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে প্রবন্ধগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হলেও এগুলো সমসূত্রে গ্রথিত এবং ইসলামের আদর্শ, সৌন্দর্য, মহত্ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব এবং সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বই এ প্রবন্ধগুলোর অন্তর্নিহিত মূলতত্ত্ব। আর ধর্মের নামে সংসারে মানুষকে প্রতিনিয়ত অধর্ম করতে দেখে তাঁর প্রাণে যে বেদনা ধ্বনিত হয়েছে তা থেকেই স্বতঃ উৎসারিত হয়েছে তাঁর ‘ধর্মের কাহিনী।’ ধর্মের কাহিনীতে, ‘পূর্বাভাস,’ ‘খোদাভক্তি,’ ‘নামায,’ ‘সত্য’, ‘স্বার্থ’, ‘দয়া,’ ‘দান’, ‘অতিথি সেবা’, ‘সুদ’ প্রভৃতি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। ছোটদের জন্য হযরত মুহাম্মদের জীবনী কম লেখা হয়নি। শিশু পাঠ্য হিসেবে হযরতের জীবন এখনও কম লেখা হচ্ছে না, কিন্তু এদিকেও এয়াকুব আলী চৌধুরীর ‘নূরনবী’ অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ রচনা। হযরত চরিত্রের কোমল মধুর দিকগুলো ততধিক কোমল সুন্দর করে এয়াকুব আলী তাঁর নূরনবীতে অঙ্কিত করেছেন। এ বই-এর ভাষা শিশুদের জন্য শুধু সহজবোধ্য নয় মধুর বলেই আকর্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথও এ গ্রন্থ-খানা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ইঁহার ভাষা সরল ও সুন্দর এবং রচনা প্রণালী শিশু পাঠকের পক্ষে মনোরম। এরূপ সহজ বাংলা লেখা কঠিন কাজ।” পাঁচ সাত বছর বয়স্ক শিশুপাঠ্য বই মঈনুদ্দীনের ‘আমাদের নবী’র কথা বাদ দিলে হযরতের জীবনী সম্পর্কিত এধরনের শিশুদের উপযোগী বই ইদানীং আর লেখা হয়নি। এয়াকুব আলী চৌধুরী যে একজন উঁচুদরের সাহিত্যিক ছিলেন এও তার আর এক বিস্ময়কর পরিচয়। এয়াকুব আলীর মতো খ্যাতনামা সাহিত্যিক বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে খুব কমই জন্মেছে। তিনি ছিলেন চিন্তাশীল এবং দার্শনিক। তাঁর চিন্তাশীলতা ‘মানব মুকুট’-এর মধ্যে স্ফূর্তি পেয়েছে। সে জন্যে হযরতের জীবনী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁর ভাষাও হয়ে উঠেছে অপূর্ব ধ্বনিব্যঞ্জনাময়-গতিশীল। ‘মানব মুকুট’ ও ‘শান্তিধারা’ একই বিষয়ের এপিঠ ও ওপিঠ। এয়াকুব আলী অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিলেন; তাঁর আবেগ প্রবণতা তাঁর যুক্তিবাদিতাকে ক্ষুণ্ণ করেনি। ইসলামী বিষয়বস্তুও যে উন্নততর সাহিত্যের উপাদান হতে পারে এয়াকুব আলীর সাহিত্য সাঙ্গনাই তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। সমগ্র বাংলা গদ্য সাহিত্যের উৎকর্ষাপকর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যাবে এয়াকুব আলীর মধুর ও প্রসাদগুণবিশিষ্ট গদ্য-বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। হিন্দু মুসলমান সকল বাঙালী সাহিত্যিকল্পের মধ্যে তাঁর যে একটি বিশিষ্ট স্থান আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কাব্যে হযরত মুহাম্মদের (সঃ) জীবনী লেখেন কবি মোজাম্মেল হক (শান্তিপুরের) এবং কাজী নজরুল ইসলাম। মোজাম্মেল হকের বই-এর নাম ‘হযরত মোহাম্মদ’। নজরুলের ‘মরুভাস্কর’ হযরতের অসম্পূর্ণ জীবনী। কোরবান আলী লিখিত ‘শান্তিকর্তা হযরত মোহাম্মদ’ (সঃ) এবং আবদুল জব্বার সিদ্দিকীর ‘মানুষের নবী’ (১৯৫৩) ও এ-বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতো বই। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদের (সঃ) জীবনী ছাড়াও অন্যান্য নবীর জীবনী ও কাহিনী বাংলা সাহিত্যে কম লেখা হয়নি। খ্যাত ও অখ্যাতনামা বহু সাহিত্যিক এদিকে লেখনি চালনা করেছিলেন। এ বিভাগের মুসলিম সমাজচিত্রমূলক উপন্যাস ‘আবদুল্লাহ’র লেখক খান বাহাদুর কাজী ইমদাদুল হকের ‘নবী কাহিনী’ অত্যন্ত সুলিখিত বই। ‘নবী কাহিনী’ প্রথম প্রকাশিত হয় এ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের দিকে। এই বইটির সপ্তম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ খ্রীষ্টাব্দে। ‘নবী কাহিনী’তে ‘হযরত আদম’, ‘হযরত নূহ,’ ‘শাদ্দাতের বেহেস্ত’, ‘আদ ও সমুদ’, ‘হযরত ইব্রাহিম্’, ‘হযরত ইউসুফ’, ‘হযরত মুসা’, হযরত আইয়ুব’, ‘হযরত দাউদ,’ ‘হযরত সোলায়মান’, ‘হযরত ইউনুস’ এবং ‘হযরত ঈসা’ প্রমুখ বারজন নবীর কাহিনী অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক করে বর্ণনা করা হয়েছে। নবীকাহিনী মূলত শিশুদের জন্য রচিত; কিন্তু শিশু ও শিশুদের পিতামাতা নবীদের সুখ-দুঃখের এবং ত্যাগ সাধনার কাহিনী একই সঙ্গে উপভোগ করতে পারে। নিছক শিশুপাঠ্য বই হিসেবেও এটি এয়াকুব আলী চৌধুরীর ‘নূরনবী’র সমপর্যায়ের রচনা। আলাউদ্দীন আহমদ (১৮৫১-১৯১৫) মাসিক ‘ইসলাম প্রচারক’ পত্রিকার একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন। তাঁর মুদ্রিত পুস্তকের নাম ‘ওমর চরিত’। পুস্তকটি ১৩১০ সাল অর্থাৎ ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। হযরত ওমরের চরিত্র ও আদর্শ রক্ষা করাই এ গ্রন্থে গ্রন্থকারের উদ্দেশ্য ছিল। এ ছাড়া তিনি ‘ইসলাম প্রচারক’-এ ধারাবাহিকভাবে ‘তফসীরে হাক্কানী’র বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন। এবং ‘হযরত বড় পীর সাহেবের জীবন চরিত’ও রচনা করেন। পারস্যের শেখ সাদী, জালালুদ্দীন রুমী প্রমুখ বিভিন্ন কবির জীবনীও তিনি ‘ইসলাম প্রচারক’-এ প্রকাশ করেছিলেন। আলাউদ্দীন আহমদ পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার চৌহালী নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। সেকালের সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর সম্পাদক নাজির আহম্মদ চৌধুরীর লেখা বই ‘ফারুক চরিত’ ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ‘ফারুক চরিত’ হযরত ওমরের আদর্শোজ্জ্বল জীবনের কাহিনী। সৈয়দ আবদুর রউফের ‘হযরত ওমর’ (১৯২৭) ও এ প্রসঙ্গ স্মরণীয়। আবু আহমদ আবুদল ওয়াহেদ ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে ‘হযরত মুসার জীবনী লেখেন। মীর্জা সুলতান আহমদ রচিত ‘হযরত এব্রাহিম’ ১৯২৭ এর প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য বই। একজন অজ্ঞাতনামা লেখকের ‘খলিল গুলজার’ নামক হযরত ইব্রাহীমের জীবনী ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এস্ ওয়াজেদ আলী রচিত ‘পীর পয়গম্ববের কথা’ বিভিন্ন পয়গম্বর ও ওলি আল্লাদের বাণী-সংকলন। আম্বিয়াদের অনেক কাহিনী বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে, যেমন আমির নামক জনৈক অনুবাদকের মূল ফারসী থেকে অনূদিত ‘কেছাছুল আম্বিয়া’ (১৮৬৮), আবুল হোসেনের ‘হাকিকাতুল আম্বিয়া’ (১৮৭৬), মোহাম্মদ তাজউদ্দীন ও মোহম্মিদ খাতিরের ‘কোলাছাতুল আম্বিয়া’ (১৮৮১), কাজী মোহাম্মদ গোলাম রহমানের ‘তাজকেরাতুল আম্বিয়া’ (১৯৫৯) আবদুস সোবহানের ‘নবী কাহিনী’ (১৯৬০) এবং গাজী শামছুর রহমানের ‘নবীদের কথা’ (১৯৬৮)। আবযজোহা নূর আহমদের ‘খুলাফা-ই-রাশেদীন’ (১৯৫৩) এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ‘পয়গম্বর-কাহিনী’ এবং ‘এসরাইল বংশীয় নবীগণ প্রভৃতি গ্রন্থ রচিয়তা ফজলুর রহিম চৌধুরীর ‘মেশকাত শরীফ’। এটি মেশকাতুল মাসাবিহর বাছা বাছা হাদিসের অনুবাদ; সাত’শ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত। প্রকশিত হয় ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে। বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে ফজলুরর রহিমের মেশকাতের এ সুবৃহৎ অনুবাদের একটি বিশিষ্ট স্থান আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি বোখারী শরীফের ও (১৯২৮) আংশিক অনুবাদ করেছিলেন। কোরআনের অনুবাদক এবং ‘ইসলাম পরিচিতি’র লেখক খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁর (১৮৮৯-১৯৬৪) ‘শেষ নবী’ (১৯৪৯) পুস্তকটি হযরত মোহাম্মদের জীবন বৃত্তান্ত। হযরতের জীবন এবং কোরআনের মধ্যে পরস্পরের সম্বন্ধ তিনি তাঁর এ বইটিতে দেখিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর ‘মেশকাতুল মাসাবিহ্’র অনুবাদও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিন খণ্ডের তিনি ‘মেশকাত শরীফে’র পূর্ণ অনুবাদ করেন। তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। প্রথম খণ্ডে তিনি একটা মূল্যবান ভূমিকা সংযোজিত করেছেন। তাঁর ‘সহীহ বুখারী তজরীদ’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। বাংলা সাহিত্যের পবিত্র কোরআন হাদীসের অনুবাদ ইসলামের মর্মব্যাখ্যার জন্য আবদুর রহমান খানের নামও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মওলানা ফজলুল করিম-এর নামও বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য রচনার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি ‘আদর্শ মানব’ বা হযরতের আদর্শ জীবনী ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। চার খণ্ডে প্রকাশিত ‘মেশকাত শরীফ’-এর বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। এছাড়া এ বিভাগে আবুল মনসুর আহমদের ‘মুসলমানী কথা’, হাবীবুল্লাহ বাহার লিখিত ‘ওমর ফারুক’, বেগম শামসুন্নাহার লিখিত ‘পুণ্যময়ী’, তোরাব আলীর ‘ছোটদের মোস্তফা,’ ‘ছোটদের ফারুক চরিত’ প্রভৃতি বইগুলোর নাম করা যেতে পারে। কাজী আবদুল ওদুদের বহুদিনের স্বপ্ন ছিল হযরত মোহাম্মদের (সঃ) জীবনী লেখার। তার সেই স্বপ্নের ফল ‘হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম’ প্রকাশিত হয় বৈশাখ ১৩৭৩ বাংলা সাল মোতাবেক ১৯৬৬ খ্রীষ্টাব্দে। হযরতের মানস ও চরিত্র সম্বন্ধে এ গ্রন্থে তিনি যে আলোচনা করেছেন তার ভিত্তিভূমি হচ্ছে ‘কোরআন ও হাদীস।’ কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন ঢাকার মুসলিম সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মুসলিম সাহিত্য সমাজ সেদিন বাঙালী মুসলমানের জীবনে মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তা স্বাধীনতার সংঘাত সৃষ্টি করেছিল। হযরতের চরিত্রের বিশালতা, ইসলাম ধর্মপ্রচারে তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, ধৈর্য্য, সহনশীলতা এবং সর্বোপরি তাঁর মহত্ত্ব ও ঔদার্য প্রভৃতি মহৎ গুণাবলীকে কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর এ গ্রন্থেই বুঝবার প্রয়াস পেয়েছেন অন্ধ বিশ্বাসে নয়, মুক্ত মন দিয়ে বিচারসহ করে। পরধর্মাবলম্বী পাঠকও আবদুল ওদুদ সাহেবের এ গ্রন্থ পাঠ করে হযরত মহাম্মদের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হবে। এদিকে থেকে কাজী আবদুল ওদুদের ‘হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম’ হযরতের জীবন চরিতগুলোর মধ্যে একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ। পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত ফুলবাড়ী গ্রামের ডক্টর গোলাম মকসুদ হিলালী রচিত ‘হযরতের জীবনী প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৬৭ খ্রীস্টাব্দে। তার কথায় আল্লামা শিবলী নু’মানী সাহেবের ‘সীরাতুন্নবী’ গ্রন্থের শেষভাগে প্রদত্ত পয়গম্বর সাহেবের আচার ব্যবহার ও চরিত্র সম্বন্ধী অংশই এ পুস্তকের ভিত্তি। হযরত মুহাম্মদের (সঃ) জীবন কাহিনীর সঙ্গে ইসলামের শিষ্টাচারী খলিফা চতুষ্টয়- ‘খুলাফা-ই-রাশেদীনে’র জীবন কথা না জানলে ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হয় না। পৃথকভাবে এই খলিফা চতুষ্টয়ের জীবনী অনেকে লিখলেও তাদের জীবনকথার যথার্থ ইতিহাসভিত্তিক আলোচনা বাংলা সাহিত্যে ছিল না বললেই চলে। বাংলা ভাষায় আমাদের ইসলামী সাহিত্যের এ অভাব দূর করবার জন্য ঢাকার কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ইসলামে ‘খুলাফা-ই-রাশেদীন’ তথা ‘শিষ্টচারী খলিফা চতুষ্টয়ে’র জীবনী লেখানোর একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই পরিকল্পনা অনুসারে কবি গোলাম মোস্তফার ‘হযরত আবু বকর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে আবদুল মওদুদের (১৯০৮- ১৯৭১) ‘হযরত ওমর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে, মুহম্মদ বরকতুল্লাহর ‘হযরত ওসমান’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে এবং আবুল ফজলের ‘হয়রত আলী’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। হযরত আবুবকর সিদ্দিকের অনেকগুলো জীবনী বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শামসুর রহমান আলজামালীর ‘প্রতিষ্ঠা বা হযরত আবুবকরের সংক্ষিপ্ত জীবনী’ (১৯২২), হেদায়েত হোসেন মোরশেদের ‘খলিফা আবুবকর’ (১৯৬৩), ফজলুর রহমানের ‘হযরত আবুবকর’ (১৯৬৪), আবদুল হক মাশরেকীর’হযরত আবুবকর’ (১৯৬৬)-এর গোলাম রব্বানীর ‘হযরত আবুবকর সিদ্দিক’ (১৯৬৫)। কারবালা সংক্রান্ত সাহিত্য: মুসলিম ঐতিহ্য ও ইসলামের ইতিহাসের কাহিনী সম্পর্কিত বিষয়বস্তু অবলম্বন করে বহু সাহিত্যিকই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। বিশেষত কারবালার ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে বহু কবিই কাব্য রচনা করেছেন। মুসলিম ইতিহাসের এ মর্মস্পর্শী কাহিনী গদ্য সাহিত্যিকদেরও যে উপজীব্য হয়নি, তা নয়। মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’ই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সমগ্র বাংলা গদ্য সাহিত্যে ‘বিষাদসিন্ধু’র মতো সৃষ্টি খুব কম পাওয়া যায়। ফজলুর রহিম চৌধুরীর ‘মহরম চিত্র’ (১৯১৭) এবং কাব্যে কায়কোবাদের ‘মহরম শরীফ’ (১৯১৩) এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। মুসলমানদের জীবনে কারবালার ঘটনা একটি মর্মবিদারক ঐতিহাসিক সংঘটন। এ ঘটনাকে অবলম্বন করে বহু কাব্য কাহিনী অতীতে রচিত হয়েছে, তবে আধুনিকালে গদ্য রচয়িতারাও এ ঘটনাকে অবলম্বন করে উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। মীর মশাররফ হোসেনের নাম আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। ১৮৮৫ থেকে ১৯৯০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত তাঁর ‘বিষাদ সিন্ধু’ বাংলা সাহিত্যের একটি অসাধারণ গদ্যরচনা। আবুল মালী মোহাম্মদ হামিদ আলীর ‘কাসেম বধ কাব্য’ এবং ‘জয়নাল উদ্ধার’ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯০৬ এবং ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে। অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছে মোহাম্মদউদ্দীন আহমদের ‘মোহররম কান্ড’ (১৯১২), মোহাম্মদ আবদুল বারীর (১৮৭২-১৯৪৪) ‘কারবালা’ (১৯১৩), ফজলুর রহিম চৌধুরীর ‘মহরম চিত্র’ (১৯১৭), খয়রাতুল্লার (১৯২৪-১৯৩৬) ‘কারবালা’ (১৯০৬) আমির হোসেন আলকাদেরীর ‘কারবালার যুদ্ধ’ (১৯৩৬), খান বাহাদুর আবেদ আলীর ‘মহরম পর্ব’ আবদুল গফুর সিদ্দীকির ‘বিষাদ সিন্ধুর ঐতিহাসিক পটভূমি,’ ডক্টর গোলাম সাকলায়েনের ‘কারবালার কাহিনী’, মুহম্মদ বরকত উল্লাহর ‘কারবালার যুদ্ধ ও নবী বংশের ইতিবৃত্ত’ (১৯৫৭) এবং ‘কারবালা ও ইমাম বংশের ইতিবৃত্ত’ (১৯৬৫)।
Slider
দেশ
মেহেরপুর জেলা খবর
মেহেরপুর সদর উপজেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
যাবতীয়
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News
No comments: