Sponsor



Slider

দেশ

মেহেরপুর জেলা খবর

মেহেরপুর সদর উপজেলা


গাংনী উপজেলা

মুজিবনগর উপজেলা

ফিচার

খেলা

যাবতীয়

ছবি

ফেসবুকে মুজিবনগর খবর

» »Unlabelled » মেহেরপুরে ভাষা আন্দোলন, ৫দিনের জেল ও ভয়াবহ দিনগুলোর স্মৃতি




মেহেরপুরে ভাষা আন্দোলন, ৫দিনের জেল ও ভয়াবহ দিনগুলোর স্মৃতি -মোহাম্মদ ছহিউদ্দীন বিশ্বাস ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় নিহত ভাষা শহীদের কলকাতা রেডিওতে প্রচারের পর মেহেরপুরে পুলিশ-জনতার মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করে।১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় নিহত ভাষা শহীদের মসজিদে দোয়া ও মোনাজোত করার কারণে ১৯৫২ সালে ২২ শে ফেব্রুয়ারী বিকালে মেহেরপুর শহরের মসজিদে থেকে ৩১ জনকে আটক করেছে পুলিশ। পরে তাদের ৩১ জনকে মেহেরপুর আদালতের হাকিম পাঁচ দিনের কারাদন্ড দিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করেছিল। ঊনিশ শত বায়ান্ন সালের ২১ শে ফ্রেরুয়ারী দুপুরের পর মেহেরপুর শহরের রাস্তায় মেহেরপুর পৌরসভার সামনে এবং মেহেরপুর শহরের চৌরাস্তা মোড়ে পুলিশ টহল দিচ্ছে। এই সময় পুলিশের ভূমিকা অগ্নিমুর্তি আমাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। তারপর মেহেরপুর শহরে আনসার বাহিনীর একটি দল সরকারী ভবনের নিকট পাহারা বৃদ্ধি করেছে। এলাকার মানুষকে নিজ বাড়িতে চলে যেতে নির্দেশ দিচ্ছে পুলিশ। তখন মেহেরপুর থানা পুলিশ অস্ত্র উঁচিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব সৃষ্টি করেছে । মেহেরপুর শহরের থানা-বড়বাজার- হোটেলবাজার - কোর্টরোড় ইট বিছানো রাস্তা ছিল। অনেকে দ্রুত সাইকেল চড়ে পলায়নের সময় ইটের রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে। এই সময় আমার বই এর দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যাচ্ছি। আমি কিছুই জানতে বা বুঝতে পারিছি না। আমার মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। আমি বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছি। সেই সময় ইট বিছানো রাস্তায় যেতে পায়ে হুছুট খেয়ে আমার হাতে থাকা ব্যাগটি পড়ে যায়। আমার সকল জিনিষপত্র ব্যাগ থেকে রাস্তায় পড়ে ছিটিয়ে যায়। আমি পুনরায় জিনিস পত্র কুড়িয়ে ব্যাগে উত্তোলন করেছি। সেই সময় রাস্তায় পুলিশের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি তখন তাড়াতাড়ি বাড়ি প্রবেশ করেছি। আমার পরিচিত ও অপরিচিত সকলের নিকট ঘটনাটি জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এর কুলকিনারা পেলাম না। আমি বাড়িতে অবস্থান করলাম। কলকাতা রেডিও খবরে শুনলাম ঢাকা শহরে পুলিশের গুলিতে তিন ছাত্র নিহত হয়েছে। আমি বাড়িতে অবস্থানের সময় অস্থির হয়ে পড়েছি। আমি বাড়ির ভিতরের উঠানে পায়চারী করছি। আর মনে ভাবছি ভারতের সাথে কি পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়ে পড়েছে? তাই আর অপেক্ষা না করে আমার রেডিও টি অন করলাম। তখন রেডিওতে শা-শো বিকট শব্দ হচ্ছে। আমি কিছুই শুনতে পারলাম না। আসলে অনেক দিন রেডিও টি চালানো হয়নি । যার ফলে ব্যাটারী নষ্ট হয়ে গেছে। বিরক্ত হয়ে রেডিওটি টান দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলাম। আমি আবারো বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। আমি রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে মেহেরপুর পৌরসভায় প্রবেশ করেছি। পৌরসভার জনৈক ক্লার্ক আমাকে বললেন কলকাতা রেডিও এর খবরে শুনলাম ঢাকা শহরে পুলিশের গুলিতে তিন ছাত্র নিহত হয়েছে এবং বহু ছাত্র জখম হয়েছে। আমি তখনও পরিষ্কারভাবে ঘটনাটি জানতে পারছিলাম না। আমি আস্তে আস্তে মেহেরপুর পৌরসভা থেকে বের হচ্ছি। তখন পুলিশ আমাকে নির্দেশ দিলেন আপনি রাতে রাস্তায় বের হতে পারবেন না। তাদের নির্দেশ মোতাবেক আমাকে দ্রুত সন্ধ্যার আগে বাড়িতে প্রবেশ করতে হবে । আমি তাড়াহুড়া করে মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলের (জন্ম :১৮৯৫ সাল) বাড়িতে প্রবেশ করলাম (মেহেরপুর পৌরসভার পশ্চিমে বর্তমান মেহেরপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে বাড়ি) । সেই সময় পৌরসভার চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলেরও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তখন খবর পাচ্ছেন না। আমাকে চাচা বললেন, ছহী তুই কি জানিস আসলে দেশে কি হয়েছে ? আমি তাকে অবগত করলাম কলকাতা রেডিও খবরে বলেছে ঢাকা শহরে পুলিশের গুলিতে তিন ছাত্র নিহত হয়েছে। মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান আকবর মন্ডল বললেন আমার রেডিও টা চালিয়ে দেখ কি বলছে। আমি রেডিও টির নব ঘুরিয়ে যাচ্ছি। যে সেন্টারে দিচ্ছি শুধু গান বাজানো যাচ্ছে। কলকাতা রেডিও রাত ৮ টায় বাংলা খবর পরিবেশন করে থাকে। তখন তাকে বুঝালাম রাত ৮ টায় ছাড়া কোন খবর পাওয়া যাবে না । তিনি ও আমি সঠিক তথ্য কোথাও পাওয়ার জন্যে উদ্বেগ হয়ে পড়েছি। তখন পাকিস্তান রেডিও তে শুধু উর্দু ভাষার গান হচ্ছে। কোন খবর প্রচার করছে না । তিনি বলেন, পাকিস্তান রেডিও টি চালু রাখ, তারা কি খবর দেয় দেখ কেমন ? আমি রেডিওতে গান শুনছি। তিনি আমাকে চা কলা খেতে দিলেন । তার এক মাত্র সন্তান নকিব উদ্দীন (জন্ম : ১৯২৪ সাল) আর আমি বন্ধুর মতো চলা ফেলা করি এবং এই বাড়িতে প্রতিদিন আমি একবার চা খেয়ে এসে থাকি। অনেকটা পারিবারিক মানুষের মতো অধিকার দিয়েছে বন্ধু নকিব উদ্দীনের বাবা । সেই জন্য মেহেরপুর পৌরসভার কাজ কর্ম আমার জানার বাইরে কিছু হয়না বললেই চলে। এদিকে রাত বেড়ে চলেছে হঠাৎ পাকিস্তান রেডিও উর্দু ভাষায় এক বুলেটিন প্রচার করেন। রেডিও এর বুলেটিনে উর্দু ভাষায় বলছেন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে এক দল সন্ত্রাসী পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ করলে ২ জন পুলিশ নিহত হয়েছে। তখন তিন বাঙালী সন্ত্রাসীও নিহত হয়েছে। সেই সময় তাদের বোমার আঘাতে বহু পুলিশ জখম হয়ে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তাদের আটকের জন্য ঢাকা পুলিশ চিরুনী অভিযান চালাচ্ছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল এলাকা বাঙালী সন্ত্রাসীদের ঘেরাও করে রেখেছে পুলিশ । তাদের রাতের মধ্যে আত্মসমর্পণ করার নিদের্শ দিচ্ছে পুলিশ। আগামীকাল দেশের সকল মসজিদে পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক পুলিশের জন্য দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের নির্দেশ দিয়েছে পাকিস্তান সরকার। এরপর রাতে কলকাতা রেডিও খবরে শুনলাম, ঢাকা শহরে পুলিশের গুলিতে তিন ছাত্র নিহত এবং ১০ জন ছাত্র গুরুতর জখম হয়েছে। আমাদের কলকাতা রেডিও এর সংবাদদাতা অরুন দেব ঘটনাস্থল ঘুরে ঘুরে দেখে বলেছেন মেডিক্যাল এলাকায় পুলিশ ব্রাশফায়ার করলে তিন ছাত্র এর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়েছে। চিকিৎসার অভাবে বাকী আহত ছাত্ররা মেডিক্যালের খোলা স্থানে পড়ে রয়েছে। তাদের শরীরে রক্ত ঝরছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যালএলাকা ঘেরাও করে রেখেছে পুলিশ।এভাবে কলকাতা ও পাকিস্তান রেডিও এর খবর শুনে আমরা তিন জন (আকবর মন্ডল, তার ছেলে নাকিবউদ্দীন এবং আমি ছহি) একমত হলাম বাঙ্গালীদের ওপর আঘাত শুরু করেছে। তিনি আক্ষেপ করে বল্লেন, কয়েক বছর আগে মাতৃভূমি ভারতকে ফেলে পাকিস্তানে পালিয়ে এসেছি। হিন্দুস্থানে কয়েক হাজার বিঘা জমির বদলে পাকিস্তানে কয়েক শতাধিক জমি বিনিময় করে পেয়েছি সেই কাহিনী মনে হয়ে হলে আমার বুকের ছাতি ফেটে যায়। আমি পাকিস্তান নামক মুসলিম দেশে এসে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। বৃটিশ সাদা চামড়াদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমরা পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু আবার তারা বাঙালীদের ওপর আঘাত শুরু করছে। আমরা সহজে ছেড়ে দিব না বুঝলে ছহী ? তুমি কি বলছো ? আমি বললাম, চাচা লড়াই করতে হবে। মেহেরপুর শহর ছিল হিন্দু অধ্যষিত এলাকা তাই তখন মেহেরপুর শহরে হোটেল বাজারে একমাত্র জামে মসজিদ রয়েছে। মেহেরপুর শহরের সকল মুসলিম এক মাইল দুরে হোটেল বাজারের জামে মসজিদের নামাজ আদায় করে থাকে। ওহে ছহি, একটি কাজ করলে হয়না, মেহেরপুরের এসডিও হোটেল বাজারের জামে মসজিদে মিলাদ দিবে পুলিশের পক্ষে। আমরাও হোটেল বাজারের জামে মসজিদে মিলাদ দিব নিহত ছাত্রদের পক্ষে । তাহলে মানুষ আমাদের ওপর খুশি হবে। যে কথা সেই কাজ শুরু হয়ে গেল। মেহেরপুর শহরে এখন থেকে আগামীকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা ঘোষণা করা হলো। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা মহাসড়কে মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলের দুইটি যাত্রিবাহী বাস চলাচল করতো। তাই এই শহরে মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলে ব্যাপক প্রভাব ছিল। তিনি এক সিপাইকে দিয়ে মেহেরপুর থানার ওসি ওহিদুজ্জামানকে ডেকে পাঠালেন । তিনি রাত বারোটার দিকে তার বাসায় এসেছিলেন। তিনি তার কাছে সব কিছু অবগত হলেন। তার একটু আগেই রাত ১০ টার দিকে মেহেরপুর এসডিও অফিস থেকে চৌঙ দিয়ে ঘোষণা করছে যে, মেহেরপুর শহরে এখন থেকে আগামীকাল সকাল ১২ টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বলবদ থাকবে এবং বিকাল ৬ টা থেকে আবার ও তা বলবদ থাকবে। এই সময় মেহেরপুর থানার বাঙালী ওসি ওহিদুজ্জামানকে চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, মেহেরপুরের শান্তি প্রিয় মানুষকে যেন হয়রানী করা না হয়। তিনি বলেন, আগামীকাল হোটেল বাজারের জামে মসজিদে বাদ আছরের পর মিলাদ মাহফিল হবে। আপনাকে মাহফিলে উপস্থিত থাকতে মেহেরপুর এসডিও স্যার হামিদ সিদ্দীকী অনুরোধ করেছেন। তখন ওসিকে তিনি বলেন, আমার ভাতিজীকে (আমাকে) তার বাড়িতে পৌঁছে দেবার কথা । তিনি আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন। আমার বাড়ির মানুষ পুলিশ দেখে কাতর ও সব শুনার পর স্বস্তি পেলেন। ঐ রাতে অনেক পরিকল্পনা মাথায় আসায় ঘুম আর আসছিল না। আমি গভীর রাতে বর্তমান সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের পিছন দিক দিয়ে আবারও মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলের বাড়িতে প্রবেশ করেছি এবং তার পুত্র নকিবউদ্দীনকে চুপে চুপে ডেকে তার ঘরে প্রবেশ করলাম। আমরা একটা পরিকলল্পনা তৈরী করেছি। তার বিছানায় শুয়ে থাকলাম। ঐ দিন সকালে মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান আকবর মন্ডল আমাকে বিছানায় ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছেন। তিনি অবাক হয়ে বলছেন, তোমার কি কোন সমস্যা হয়েছে? আমি তখন তাকে বলেছি পুলিশের ভয়ে পালিয়ে এসেছি। যদি সন্দেহ জনক ভাবে আটক করে নিয়ে যায়। -তোমার ভয় কি? তোর জন্য তো আমি আছি। এই পুলিশের এত বুকের পাটা হয়নি যে তোকে আটক করে নিয়ে যাবে। তিনি সহ আমরা তিন জন এক সঙ্গে সকালে মিষ্টি দিয়ে রুটি খেলাম। তিনি এই বাজারের কিছু মানুষের তালিকা আমার হাতে দিয়ে বল্লেন, আছর ওয়াক্ত নামাজের সময় হোটেল বাজার (তখন ছোট বাজার বলা হত) মসজিদে নামাজের জন্য আমার অনুরোধ পৌঁছে দিবে। তুমি ও নকিব পাড়ার ভিতর দিয়ে বাড়ি বাড়ি বলে এসো । আমরা সেই মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৫০ জন মানুষকে বলে এসেছি। তিনি বল্লেন, মুসলিমলীগের কিছু চাটুকাররা অপ্রচার করছে । যাতে মসজিদে নামাজে কেউ না যায় ।এই সব কথা আমার কানে এসেছে। তাই মসজিদে লোকের সংখ্যা আশানুরুপ হবে না মনে হয় ছহী ? অবশ্য তার আশঙ্কা সত্যি হয়েছিল। আমরা যথারীতি হোটেল বাজার মসজিদে হাজির হয়ে গেলাম। পাকিস্তানি উর্দু ভাষী ইমাম সাহেব মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলকে পাশে নিয়ে গল্প করছে। ইতিমধ্যে মোয়াজ্জিন আযান দিয়েছে। তার একটু পরে মেহেরপুরের এসডিও হামিদ সিদ্দীকী ২/৩ জন লোক নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন। আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব এসডিওকে স্বাগত জানালেন। তখন হঠাৎ মসজিদের আশে-পাশে কয়েক ডজন পুলিশ ঘেরাও করেছে। এদিকে ছোট বাজারের আরও কয়েক জন আমাদের সাথে যোগ দিলেন। এই নিয়ে আমরা ৩১ জন বাঙালী মুসুল্লি মসজিদে উপস্থিত রয়েছি। এই মসজিদের চারিদিকে বাঁশের রেলিং দিয়ে ঘেরাও রয়েছে। মেইন রাস্তা থেকে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লম্বা আধা পাকা ঘর রয়েছে। মাথার ওপর টিনের ছাইনী রয়েছে। লম্বা ঘরের ৪/৫ টি কাঠের দরজা ও বন্ধের জন্য ভিতরে কাঠের খিড়কী পাশে রয়েছে । একটি পাট কোয়া থেকে বালতী দিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। পাশে কেউ কেউ ওযু করছে। এখানকার পায়খানা ও উন্মুক্ত প্রসাবখানার দুর্গন্ধ মাঝে মাঝে নাকে আসছে। খাকি ড্রেস পরা পুলিশের একটি দল মসজিদের আঙ্গিনায় ঘুরাঘুরি করছে। এই সময় আকবর মন্ডল আমাকে ডেকে বাইরের পরিস্থিতি কেমন জানাতে বল্লেন । তার নির্দেশে পুলিশ মোতায়েনের মধ্যেই মসজিদের বাইরে গেলাম। মসজিদের সামনের কাঁচা রাস্তায় দুই/এক জন লোক চলাচল করছে। এদিকে রাস্তায় পুলিশের উপস্থিতি দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। এ যেন এক অচেনা মেহেরপুর বলে মনে হচ্ছে। গতকাল থেকে যে ভাবে পুলিশ মেহেরপুর শহরে আগ্রাসী ভূমিকায় দেখাচ্ছে। এই পরিস্থিতির সম্মুখীন আমার জীবনে হয়নি । যে ভাবে চৌঙ দিয়ে মেহেরপুরের অলি-গলি-রাস্তার মোড়ে প্রচার করছে। মনে হচ্ছে বাঙালীরা যেন সন্ত্রাসী হিসেবে জন্মিয়েছে। আমি এই পরিস্থিতি চেয়ারম্যান সাহেবকে কানে কানে অবগত করলাম । তিনি উঠে এসে আমাকে বলেন, নামাজের পর ওনারা মোনাজাত করবে । ঠিক ঐ সময় আমি মোনাজাত শুরু করবো কেমন? তোমরা সেই সময় এসডিও এর সামানে বাঙলা আমার মায়ের ভাষা উচ্চস্বরে বলেতে থাকবে। আমি সে মোতাবেক নকিবুদ্দীন সহ আমরা ৪/৫ জনকে সামনে আসতে নির্দেশ দিলাম। তারা সেই মোতাবেক পিছন থেকে এসডিও এর সন্নিকটে আবস্থান করছে। এই সময় নন বাঙালী ত্রিশ ঊর্ধ্ব এসডিও বিরক্ত হয়ে তার হাতের ঘড়ি দেখছেন। তখন ইমামের সাথে তিনি উর্দু ভাষায় কথা শুরু করেছে। আমাদের লিডার আকবর মন্ডল আমাদের মানুষ জনের সাথে চোখে চোখে ইশারই কথা ও নির্দেশ দিচ্ছেন। আমরা তাকে অনুসরণ করছি। আমরা শিক্ষককে ফাঁকী দেবার জন্য স্কুলের ক্লাসে বন্ধুরা এই ধরণের চোখে চোখে কথা বলতাম। আমাদের মধ্যে কোন উদ্বেগ কাজ করছে না বরং মনে আনন্দ ও উত্তেজনা কাজ করছে। ওনার ইস্পাত কঠিন সাহস ও অনুপ্রেরণা আমাদেরকে জাগ্রত করছে। আমরা যেন সময় অতিবাহিত করার অপেক্ষায় রয়েছি। সেই ক্ষণকাল শুরু হয়েছে। আমরা আছরের নামজের জন্য কাতারে সারিবদ্ধ ভাবে দাড়িয়েছি। ইমাম সাহেবের পাশে এসডিও এবং চেয়ারম্যান দাঁড়িয়েছে। নামাজ শুরু হয়েছে ইমাম লম্বা সুরা পড়ছে যেন সেজদার কথা ভুলে গেছেন। এই ভাবে নামাজ শেষ করলেন। ইমাম সাহেব ঘোষণা করলেন কিছু সন্ত্রাসী পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশকে আক্রমণ করছে। তাদের দমনে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। পাকিস্তানের নিহত পুলিশের জন্য দোয়া ও মোনাজাত হবে । আপনাদের জন্য এসডিও স্যার তোবারকের ব্যবস্থা করেছেন। এই সময় মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক সামাদ সিদ্দীকী বক্তব্যে বলেন, বাঙালীদের কতিপয় নেতার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিচ্ছে। তারা গতকাল পুলিশকে হত্যা করছে। আমরা কঠোর ভাবে আপনাদের অবগত করছি। আপনাদের সন্তানদের সন্ত্রাসী নেতাদের কাছ থেকে সরিয়ে আনুন। নইলে ইংরেজরা যেমন মুসলমানদের জামিদারদের ভিখারী বানিয়েছিল আপনাদের একই অবস্থা পাকিস্তান সরকার করবে। আপানাদের সম্পত্তি সরকার কেড়ে নেবে । আগামীতে আপনাদের সন্তানেরা কোরআন শিখবেন আরবীর মাধ্যমে, আর ছাত্রদের উর্দুর মাধ্যমে ক্লাসের সব বই পড়তে হবে। আগামীতে পাকিস্তানে অন্য ভাষা বিলুপ্ত করবে সরকার। তার ভাষণের সময় চেয়ারম্যান সাহেব পাশে দাড়িয়ে সিংহের মত ফোঁস ফোঁস করছিলেন। এই সময় আমরা কানাঘুষা করছি। এসডিও কে পিটিয়ে দেই কিন্তু সেটা আর আমাদের করা লাগলো না । এই সময় সুউচ্চ বিশাল দেহের অধিকারী চেয়ারম্যান সাহেব বাঘ্রের মত গর্জে উঠলেন । তিনি এসডিও সাহেব “খামোস” “খামোস”“খামোস” বলতে থাকেন । তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েছে। আমরা এক সঙ্গে চিৎকার করে বলতে থাকি ”বাংলা আমার মায়ের ভাষা” এই ভাষা নিয়ে বিলুপ্ত করার কারোর ক্ষমতা নেই। এ শ্লোগান দিয়ে আমরা চিৎকার করতে করতে আমি ও নকিব এসডিও কে ঘিরে ফেললাম । আমাদের সাথে আরো ৪/৫ জন যোগ দিলেন। আমরা ৪/৫ জন লোক তাকে ঝাপটে ধরে রেখেছে। তিনি ভয়ে কাবু হয়ে পড়েছেন। এদিকে আমরা মারমুখি হয়ে শ্লোগান দিতে থাকলাম । সেই সময় এসডিও ভয়ে ইমাম সাহেবের হাত ধরে থর থর করে কাঁপছেন । এদিকে পুলিশ মসজিদের দরজায় দরজায় অবস্থান নিয়েছে। ইমাম সাহেব উচ্চস্বরে মোনাজাত ধরলেন। পাশাপাশি তিনি ঢাকায় নিহত বাঙালী ছাত্রদের পক্ষে লম্বা চড়া দোয়া করতে লাগলেন। তাদের আল্লাহ যেন বেহেস্ত নছিব করেন। আমরা এসডিও কে ব্যারিকেট দিয়ে রেখেছি। তখন মসজিদে পুলিশ ঢোকার পাঁয়তারা করছে । তার আগে আমাদের লোক জন মসজিদের কাঠের দরজা খিড়কী দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। পুলিশ দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। আমরা দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি । যাতে পুলিশ দরজা ভেঙ্গে ফেলতে না পারে । পুলিশ দরজা খুলতে নির্দেশ দিচ্ছে। মসজিদের ভিতর ও বাইরে রণক্ষেত্র তৈরী হয়েছে। পুলিশ কি করবে বুঝতে পারছে না। তারা এসডিও সাহেবের নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তখন এসডিও সাহেব ও তার লোকজন ভয়ে কাঁপছে। এদিকে মোনাজাত শেষ হয়েছে। ইমাম সাহেব শান্ত হয়ে এসডিও সাহেবের কাছে গেলে তিনি কিছুটা স্বস্তি পেলেন। এই সময় তিনি একটি দরজা খুলে দিলেন এবং এক কাঠের খিরকী হাতল হাতে নিয়ে পুলিশকে সাবধান করলেন। তিনি বল্লেন,মসজিদে প্রবেশ করা যাবে না। আমরাও যে যা পেলাম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চেয়ারম্যান সাহেব চিৎকার করে বলেন, আমাদের কাউকে প্রহার বা আটকের চেষ্টা করবেন না। সেই সময় পুলিশ অফিসার এসডিও এর সাথে কথা বলেন এবং এসডিও সাহেব পুলিশের সাহায্য নিলেন। তখন পুলিশ মারমুখি অবস্থানে রয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের বল্লেন,তোমাদের কোন ভয় নেই। আমি সব দেখবো ও পরিস্থিতি মোকাবিলা করবো। সবাই চিৎকার করে বললাম চেয়ারম্যান সাহেব জিন্দাবাদ, পাকিস্তানীরা নিপাত যাক। এই সময় এসডিও সাহেব এক নির্দেশ জারি করলেন। তখন মেহেরপুর থানার ওসি বলেন, আপনাদের আটকের নির্দেশ দিয়েছে এসডিও। আপনারা আমার সাথে থানায় চলুন ক্ষমা চাইলে মুক্তি হয়ে যাবে। আমরা একে একে মসজিদ থেকে বের হলাম। মসজিদের আশে-পাশে পুলিশের বেষ্টনে আমাদের ঘেরাও করে রেখেছে। চেয়ারম্যান সাহেব পুলিশের ওসিকে বলেন, আমাদের কোথায় যেতে হবে। তিনি বলেন, স্যার থানায় যেতে হবে। পুলিশ আমাদের ৩১ জনকে আটক করে নাম ঠিকানা লেখার চেষ্টা করছে। আমাদের মধ্যে কয়েক জনকে দড়ি দিয়ে হাত বেঁধেছে। চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, আমরা বাঙালী, বাঙালী কেউ পালাবে না। আমাদের বিশাল দড়ি দিয়ে বেষ্টন করে থানায় নিয়ে গেলেন । আমরা এক মাইল রাস্তা পায়ে হেটে হোটেল বাজার-বড়বাজার হয়ে থানায় যাচ্ছি। রাস্তার ধারে মানুষগুলো আমাদের দেখছে। আর কয়েকজন বলছে, তোমাদের ভয় নেই আমারা আছি তোমদের পাশে। যেহেতু এখানকার পুলিশরা ও বাঙালী তারাও বেশ কষ্ট পাচ্ছে। তারা চেয়ারম্যান সাহেবকে ধীরে হাটার জন্য সহযোগিতা করছে। আমরা পৌঁছে গেলাম মেহেরপুর থানায় । এত লোক থাকার জায়গা নেই থানায় । সেই সময় ওসি চেয়ারে বসে ছিলেন। আমরা পুলিশ হেফাজতে এদিক-ওদিক বসে রইলাম। তখন থানা তার কাটা দিয়ে ঘেরাও ছিল। সেই সময় ভিতর বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে পুলিশ। তখন আমাদের কয়েকজনকে চা দিলেন এবং বল্লেন,আপনারা আগামীকাল হাকিম এর নিকট মুসলেকা দিলে ছেড়ে দেয়া হবে। তিনি বলেন সাত ধারায় মামলা রজু করেছি। চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, তোরা আজ একটু কষ্ট কর আগামীকাল তোদের বাড়ি পৌঁছে দিব কেমন ? তিনি ওসিকে বলেন আমার লোকজন ডাকেন তাদের জন্য রাতে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। তাকে বলেন, একটি ছাগল জবাই করে পুলিশ সহ সবার খাবার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন। তোরা আর কি খাবি? আমরা সবাই বেশ খুশি হলাম। সেই মোতাবেক রাতে আমরা ভুরিভোজ করেছি। আমরা সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। চেয়ারম্যান সাহেবও সারা রাত চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি আমাদের পরিবারকে আগেই অবগত করছেন। যেহেতু তখন যোগাযোগ করার কোন সুযোগ নেই । এদিন মেহেরপুর থানা পুলিশকে এসডিও কড়া বার্তা দিয়েছে। যদি আমাদের ব্যাপারে কোন প্রকার শৈথল্য দেখাই তবে ব্যবস্থা নেয়া হবে । পরের দিন সকালে মেহেরপুর থানার ওসি নির্দেশ দিলেন আপনাদের মেহেরপুর আমলী আদালতে যেতে হবে। মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান সাহেব টমটম ঘোড়ার গাড়ী ভাড়া করে আনতে বল্লেন ওসিকে। তিনি সেই মোতাবেক বেশ কয়েকটি টমটম গাড়ী থানার গেটে হাজির করেছেন। একটা গাড়িতে একটি সিপাই আমাদের মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা টমটম গাড়ীতে মেহেরপুর থানা রোড-বড়বাজার-ছোটবাজার হয়ে কোর্টে উপস্থিত হলাম। এই সময় রাস্তার ধারে শত শত মানুষ আমাদের হাত নাড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছে। তখন আমাদের সাথে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক ও খেটে খাওয়া নিরীহ মানুষগুলো উজ্জীবিত হয়েছে। তারাও আনন্দ পেয়ে আমাদের উৎসাহিত করছে। তখন চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, ক্ষমা চাওয়া যাবে না আমাদের। তাহলে আমাদের পরাজয় হয়ে যাবে কেমন ? তোরা কি বলিস ? আমরা তার সাথে এক মত হয়েছি। এদিকে কোর্টের ভিতরে বাইরে পুলিশ ছাড়া কোন মানুষ চোখে পড়ছে না। এ ব্যাপারে মেহেরপুর থানা ওসি ওহিদুজ্জামান গোপনে বলেন, মেহেরপুর কোর্টে কোন উকিল আসেনি এবং সাধারণ মানুষের আদালতে প্রবেশ নিষেধ দিয়েছে এসডিও সাহেব। এই সময় আমাদের আমলী আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন বিচারকের পেসকার সাহেব আমাদের এডভোকেট এর মাধ্যমে উকালতনামা জমা দিতে নির্দেশ দিলেন। তখন বিচারক আদালতের চেয়ারে বসেনি তার সহকারী আমাদের উকালতনামা জমা দিতে আধাঘন্টা সময় বেঁধে দিলেন। এখানে আমাদের কোন লোকজন প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। আমরা অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। তখন আমাদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই সময় পুলিশ অফিসার পরামর্শ দিলেন আপনাদের পক্ষে একজন উকিলের কাজ করতে পারবেন। আমরা কিছুটা স্বস্তি পেলাম। মেহেরপুর পৌরভার চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলকে আমাদের পক্ষে উকালতনামায় সই করে দেয়া হলো। একটু পরে পশ্চিম পাকিস্তানী বিচারক (হাকিম) হাজির হলেন। সেই সময় পুলিশ অফিসার উর্দু ভাষায় আমাদের আটকের কারণ জানালেন। তিনি বলেন, মেহেরপুরের ছোট বাজারের জামে মসজিদে ঢাকায় নিহত পুলিশের পক্ষে দোয়া ও মিলাদের সময় মৃদু কথাকাটি হয়েছে। এতে আমাদের মেহেরপুর মহকুমার এসডিও স্যারের সম্মান ক্ষুন্ন হয়েছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে সাত ধারা অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। মাননীয় আদালতের কাছে আমার প্রার্থনা তারা যাতে আগামীতে এই ধরণের ঘটনা থেকে বিরত থাকে তার জন্য মুসলেকার মাধ্যমে অঙ্গিকার করতে হবে। যদি তাঁরা অঙ্গিকার করতে অস্বীকার করে তবে তাদের এক সপ্তাহের জেল ও মসজিদ চত্বরে আজীবন প্রবেশ নিষিদ্ধ করার প্রার্থনা করছি। এরপর বিচারক আমাদের চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলকে বক্তব্য পেশ করতে বল্লেন,চেয়ারম্যান সাহেব উচ্চস্বরে বক্তব্যর সময় আদালত এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। তখন আদালতের বিভিন্ন কর্মচারীরা আশে-পাশের জানালা ও দরজায় ফাঁকে ওকি মারছে। তখন বিচারক বলে উঠেন, মাননীয় চেয়ারম্যান সাহেব আপনি বিচলিত না হয়ে ধীরে ধীরে কথা বলুন আমি সব কথা শুনবো। তিনি বলেন, পাকিস্তানের জাতির পিতা মুহাম্মদ জিন্নাহ আলী দ্বি-জাতি তত্ত্বর ওপর ভিত্তি করে মুসলমানরা ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট পাকিস্তান বলে একটি রাষ্ট্র পেয়েছি। তিনি মুসলমানদের একটি জাতি হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন এবং হিন্দু ও মুসলিমদের দ্বন্দ্ব দুর করেছিলেন। কিন্তু মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক সামাদ সিদ্দীকী সিন্ধী সাহেব বাঙালী ও উর্দু ভাষী মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছেন । আমরা মাতৃভূমি হিন্দুস্থানে সহস্রাধিক বিঘা জমি বিসর্জন দিয়ে পরদেশ পাকিস্তানের নাগরিকতা গ্রহণ করেছি। আমরা সবাই খাঁটি মুসলমান হিসেবে মেহেরপুরের ছোট বাজার মসজিদে নামাজ আদায় এর জন্য গিয়েছি। মেহেরপুরের এসডিও সাহেব আমাকে মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠানের জন্য দাওয়াত করেছিলেন। আমি সেই দাওয়াত গ্রহণ করে মসজিদে এসেছি । কিন্তু মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক সামাদ সিদ্দীকী মসজিদে দাঁড়িয়ে বক্তব্যে বলেন বাঙালী সন্ত্রাসীরা ঢাকায় দুই পুলিশকে হত্যা করছে। আমরা কঠোর ভাবে আপনাকে অবগত করছি তিনি বাঙালী জাতিকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার ফলে বাঙালী জাতিকে তিনি ছোট করেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের কতিপয় সন্ত্রাসী হিসেবে বল্লে আমাদের আপত্তি ছিল না। তিনি বাঙালী জাতিকে ছোট করছেন।আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করেছি এবং আপনার মাধ্যমে আরও প্রতিবাদ করছি। তাকে অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে। এবার তিনি মেহেরপুরের ওসিকে তার বক্তব্য খন্ডনের আদেশ দিলেন। মেহেরপুরের ওসি সাহেব বলেন, তখন মসজিদের পাশে পুলিশ অবস্থান নিয়েছিল। মসজিদে নিহত পুলিশদের দোয়া হচ্ছিল। তাদের আল্লাহ বেহেস্ত নছিব হবে বলে শুনেছি। দোয়া ও মিলাদের সময় মৃদু তিনি বলেন কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। কি নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল মসজিদের বাইরে থেকে বুঝতে পারিনি স্যার। আমাদের মেহেরপুর মহকুমার এসডিও স্যার আমাকে আদেশ দেন তাঁর সম্মান ক্ষুন্ন করেছে আসামীরা। তাই তাদের বিরুদ্ধে সাত ধারায় অভিযোগ দায়ের করেছি । এরপর তিনি এক আদেশ দিলেন আগামীতে এই ধরণের ঘটনা থেকে বিরত থাকতে তার জন্য মুসলেকার মাধ্যমে অঙ্গিকার করতে হবে । যারা আদেশ পালন করবে তাদের মুক্তি দেওয়ার আদেশ দেন। যদি আপনারা অঙ্গিকার করতে অস্বীকার করেন। তবে তাদের পাঁচ দিনের জেল ও মসজিদে আজীবন প্রবেশ নিষিদ্ধ করছি। আপনারা জেলখানা ও আদালতে মুসলেকার মাধ্যমে অঙ্গিকার করলে যে কোন সময় মুক্তি পাবেন বলে আদেশ দিলেন। এই সময় ৩১ জন আসামী ‘এই আদেশ মানি না’ বলে চিৎকার করে উঠেছিল। তারপর বিচারক আসন ছেড়ে গিয়েছেন। আমাদের ৩১ জন আসামীকে হাত বেঁধে জেল হাজাতে প্রেরণ করেছে। মেহেরপুর কারাগারে আমাদের প্রচন্ড খাদ্য কষ্টে দিনাপাত কাটাতে হয়েছে। মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) এর আদেশ মোতাবেক পশ্চিম পাকিস্তানীর জেলার সাহেব একচিমটি গুড দিয়ে একটি রুটি ও দুপুরে এক প্লেট ভাতে কাঁকর মিশিয়ে দিতেন যাতে আমরা খেতে না পারি। এইভাবে ক্ষিদের কষ্ট দিয়ে এসডিও প্রতিশোধ নিয়েছিল। যা আজও ভুলতে পারিনি। মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান সাহেবের সাহস ও সংগ্রামে ফলে আমরা জয় পেয়েছি। পরে আমাদের ৩১ জন পাঁচদিন জেল খাটার পর সন্ধায় মেহেরপুর মহকুমা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমরা পরিবার ও পৃথিবীর সমস্ত যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলাম। গত কয়েকদিন মেহেরপুরে কি হয়েছে কিছুই অবগত হতে পারি না। আমরা জেল থেকে মুক্তি পেলেও কেউ আমাদের অভিনন্দন বা রিসিভ করতে আসেনি। মেহেরপুর আদালত এলাকা অন্ধকার, রাস্তায় জন মানবহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের সকলেই প্রচন্ড ক্ষিদেতে পেট চু চু করছে। আমাদের দুপুরে ছেড়ে দেবার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু মেহেরপুর এসডিও এর কুটকৌশলে দুপুরে আমাদের শায়েস্তা করার জন্য ভাত খেতে দেয়নি। আমরা সকালে এক চিমটা আখের গুড় দিয়ে একটি রুটি খেয়েছি। সেই খেয়ে কি জীবনে বেঁচে থাকা যায়। আমাদের শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়েছে কেউ রাস্তায় হেটে বাড়ি যেতে পারছি না। আমরা হোটেল বাজারের ত্রি-মাথা মোড়ে পুলিশের মাধ্যমে জানতে পারলাম। আমাদের আন্দোলন ঠেকানোর জন্যে ১৪৪ ধারা বলবদ রয়েছে। মেহেরপুর শহরে প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা ১৪৪ ধারা বন্ধ রেখে সাধারণ মানুষকে চলা ফেরা করতে দেয় পুলিশ। আমরা নিজ বাড়িতে চলে এসেছি। এই সময় মেহেরপুর পুলিশ চৌঙ এর মাধ্যমে ঘোষণা করেন আগামীকাল শুক্রবার বিকাল তিনটা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জনসারণের চলাচলের জন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। আমি বাড়িতে এসে জানতে পেরেছি যে, পুলিশের আগ্রাসী ও কঠোর ভূমিকায় শহরের মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। এই সময় মেহেরপুর শহরে আমাদের নিয়ে ”টক অব দি মেহেরপুর” পরিণত হয়েছিল। শুক্রবার সকালে মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলের মেহেরপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সন্নিকটের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছি। এখন কি করা যায়? হোটেলবাজার মসজিদ আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বড় বাজারে একটি মসজিদ তৈরী করবো। মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানের একমাত্র পুত্র সন্তান নকিউদ্দীন এর নিজ নামে (বর্তমান মেহেরপুর পৌরসভার পাশে ফুড গোড়োয়ান ও গড়ের মসজিদ) প্রায় এক একর জমি ছিল। সেই জমির মেহেরপুর পৌরসভার পূর্বদিকের অংশ মসজিদকে দান করলেন । সেই সময় আমার বন্ধু নকিবুদ্দীন সকলের সামনে মসজিদকে জমি দান করার কথা ঘোষণা করছে। তাকে জনতা করতালির মাধ্যমে অভিনন্দন জানিয়েছে। তিনি ঘোষণা করেন আজকের মধ্যে মসজিদ তৈরী হবে এবং আজই শুক্রবারের জুম্মার নামাজ আদায় করবো আমরা। তার বাবা ১০ ব্যান্ডেল টিন দেবার ঘোষণা দিয়েছে। তিনি বাঁশ কাঠ তার বাগান থেকে সরবরাহ করা হবে জানিয়েছেন। আপনারা স্বেচ্ছাশ্রমে মসজিদটা নির্মাণ করবেন। যেমন কথা তেমন তৈরীর কাজ শুরু হয়েছে। তখন আমাকে ও নকিবকে সামগ্রীক কাজ তদারকীর দায়িত্ব দিয়েছে। এছাড়া কয়েক শতাধিক মুসুল্লিকে মিলাদের জন্য জিলাপী মিষ্টি বিতরণ করার দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয়েছে । সেই সময় যেয়ে দেখি স্বেচ্ছাশ্রমে ৪০/৫০ মানুষ জমির কাঠালগাছ, আমগাছ ও কলাগাছ কেটে সাবাড় করেছে। গাড়ীতে বাঁশ ও টিন নিয়ে গড়ের ধারে জমা করা হচ্ছে। তখন এলাকার এদিকে এলাকার মানুষ জামে মসজিদ তৈরীর জন্য আনন্দ ও উল্লাসে মেতে উঠেছে। এ ব্যাপারে মেহেরপুর থানা পাড়া অধিবাসী ও সাবেক চালের ডিলার মোহাম্মদ রমজান আলী (জন্ম: ১৯৩৫ সাল) বলেন আমি আমাদের বাজারে মসজিদ হচ্ছে জানি না। যেহেতু আকবর চেয়ারম্যান সহ ৩১ জনের আদালতে কারাদন্ড হলে আমরা পুলিশের ভয়ে আমার জন্মভূমি ঝাঁঝা গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলাম। আমি নিজে বাঁশের খুঁটি মাটি খুড়ে পুঁতছি। এছাড়া বাঁশের চাটাই তৈরী করেছি। তখন মানুষ দলে দলে একটি বাঁশ ও পাটাই নিয়ে আসছে। এই সময় তিন/চার গুণ বেশী বাঁশ জনগণ মসজিদে নিয়ে এসেছিল। তখন লম্বা করে বিশাল একটি টিন শেড করা হয়েছে। তখন ঘরের ভিতর ও বাইরে মাটির ওপর বাঁশের চাটাই বিছিয়ে তার ওপর খেঁজুরের পাটি দেওয়া হয়েছে। পরে কয়েকজন কিশোর বাঁশে লাল নীল কাজ দিয়ে সাঁজিয়েছিল। তখন আশে-পাশের গ্রামের মানুষ দলে দলে দেখতে এসেছে। তারা আমদের সাথে কাজ করছে। ঐদিন দুপুরে ১২ টার দিকে প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান আকবর মন্ডল লাল ফিতা কেটে গড়ে জামে মসজিদটি উদ্বোধন করেন। এই সময় কয়েক শতাধিক শিশু,কিশোর,যুবক ও বৃদ্ধ উপস্থিত হয়ে বিশাল করতালী দিয়েছিল। এ সময় আকবর চেয়ারম্যান সহ আমাদের আনন্দ বুঝানো যাবে না।৩১ জনকে জনতা বকুল ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছিল। তখন জনতার আওয়াজ ছিল বাঙলা আমার মায়ের ভাষা” জীবন দিয়ে রক্ষা করবো। গড়ের মসজিদের প্রথম আযান দেয়ার ভার পড়লো আমার ওপর। মেহেরপুর বড় বাজার জামে মসজিদের ১১ সদস্য কমিটিতে আকবর মন্ডল সভাপতি এবং আমি ছহিউদ্দীন সাধারণ সম্পাদক ও নকিবউদ্দীন অর্থ সম্পাদক ও আর অন্যরা সাধারণ মানুষ নাম স্মরণ নেই । শুক্রবার দুপুরে রাস্তার পাশে মসজিদের উত্তর কোনে জুম্মার নামাজের আযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখন টিনের ঘরে বাইরে মানুষে পরিপূর্ন হয়েছে। উত্তর পাশে মেহেরপুর হাসপাতালের রোগীরা রাস্তায় লাইন দিয়ে উপভোগ করছে। সবাই আমার দিকে দৃষ্টি রয়েছে। এত মানুষ এক সঙ্গে আমাকে তাকিয়ে দেখছে। তখন ভিতরে একটু আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কানে আঙ্গুল দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে আযান শেষ করলাম। সে এক ঐতিহাসিক দিন যা কখনও ভুলতে পারবো না । গড়ের মসজিদের প্রথম ঈমাম হলেন আকবর মন্ডল। এবার যে যার মতো সুন্নত নামাজ শেষ করলেন। এরপর আকবর মন্ডল বলেন, আমি এখন থেকে মসজিদের প্রথম ঈমাম দায়িত্ব পালন করতে ইচ্ছুক। সকলে রাজী হলেন। তিনি খুদবা সহ জুম্মার নামাজ খুব ধীরে পড়ালেন। তিনি বলেন, আদালত মেহেরপুর শহরের হোটেল বাজার জামে মসজিদে ৩১ জনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আমরা কোন দিন প্রশাসনের নিকট কোন দিন ক্ষমা চাইবো না । যদি আমরা ক্ষমা চাই তাহলে ঐ মসজিদে যেতে পারবো। আমরা ক্ষমা চাইবো না তাই আজ আমরা এই মসজিদ করলাম। গড়ের মসজিদের প্রথম জুম্মার জামাতের পর বিশাল মিলাদ মাহফিল পরিচালনা করলেন প্রথম ঈমাম আকবর মন্ডল । তারপর আমি ও নকিবুদ্দীন দুইজন মিলে ১০ মন জিলাপী মিষ্টি বিতরণ করেছি। সেই সময় কয়েক শতাধিক শিশু,কিশোর,যুবক ও বৃদ্ধ উপস্থিত হয়েছিল। আমার জানা মতে সকলে মিষ্টি পেয়ে খুশি হয়ে বাড়ি গিয়েছে। সেই সময় গড়ের মসজিদ কমিটি গঠিত হয়েছে। মেহেরপুর বড় বাজার জামে মসজিদের ১১ সদস্য কমিটিতে আকবর মন্ডল সভাপতি এবং আমি ছহিউদ্দীন সাধারণ সম্পাদক ও নকিবউদ্দীন অর্থ সম্পাদক।সেই থেকে আজও এই মসজিদটি অন্তরে গেঁথে রয়েছে । মেহেরপুর স্কুল চত্বরে কলা গাছ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরী করা হয় এবং প্রশাসন স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ দুই ছাত্রকে আটক করে। ১৯৫২ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারী ”দৈনিক আজাদ” পত্রিকায় মেহেরপুর শহরের হোটেল বাজার জামে মসজিদে আমাদের ৩১ জনকে আটকের খবর এসেছে। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' ঢাকায় দৈনিক আজাদ পত্রিকায় একটি প্রতিবাদ লিপি পাঠিয়েছে। এ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত জেলা ও মহকুমার মধ্যে মেহেরপুরে সব চেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে বলে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় মন্তব্য করেছে। আমরা জেলে থাকার কারণে এই সব খবর জানতে পারিনি। আমি শনিবার সকালে মেহেরপুর পৌর চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলকে নিউজটি দেখালাম। এরপর থেকে 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' এর নির্দেশ পালন করার প্রচেষ্টা অব্যহত রাখলাম । মেহেরপুর পৌর চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলকে দেখালাম কলাগাছ দিয়ে দেশের আনাছে- কানাছে শহীদ মিনার করছে। পত্রিকায় দেখেছি পুলিশ হয়রানী ও করছে। আামদের একটি কাজ করলে হয় না ? তিনি বলেন তুমি ও নকিব দ্রুত পরিকল্পনা করতে থাক কেমন ? তিনি বলেন, মেহেরপুর ওসিকে ডেকে সরকার ও মেহেরপুরের পিশাচ এসডিও এর মনোভাব জেনে নিই। তিনি মেহেরপুরের বাঙালী ওসিকে ডেকে পাঠালেন তিনি তার বাড়িতে এসেছেন । তারা দুইজন গোপনে শলাপরামর্শ করেছে। এক পর্যায়ে মেহেরপুরের ওসি চলে গেলেন। তিনি আমাদের বলেন, ছহী কি করা যায় বল দেখি ? মেহেরপুর ওসি বলেন এক আদেশ এসেছে। এই ধরণের অপরাধে কেউ আটক হলে তার তিন মাস জামিন হবে না। আমরা বড় চিন্তায় পড়ে গেলাম। তোরা চিন্তা করিস না আমাদের মসজিদে সারা রাত একটি ধর্মসভার আয়োজন করবো। তোরা ঐ রাতে স্কুলের ভিতরে কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার করবি কেমন ? এদিকে মেহেরপুরে অনির্দিষ্ট দিন স্কুল বন্ধ ঘোষণা করছে মেহেরপুরের এসডিও সাহেব। তিনি মেহেরপুর শহরে সভা ও পোষ্টার মারা নিষিদ্ধ করেছে। মেহেরপুরের প্রত্যেক ছাত্রদের বাড়িতে পুলিশ গিয়ে তাদের বাবা ও মাকে সতর্ক করেছে। তাই সকল বাবারা আতঙ্কে দিনাপাত করছে। সেই সময় একটি দরখাস্ত হাতে লিখে তার স্বাক্ষর নিয়ে মেহেরপুর থানায় আমরা দুইজন ওসিকে দিয়ে এলাম। তিনি ধর্মসভার অনুমতি দিয়েছে। এদিকে মেহেরপুর শহরের আনাছে-কানাছে মসজিদে ধর্মসভার প্রচার চৌঙ দিয়ে চলছে। মেহেরপুরের মানুষের মধ্যে প্রাণ চঞ্চল ফিরে এসেছে। আমরা গোপনে কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার করার জন্য ব্যস্ত রয়েছি। তিনি একজন লেবার দিয়ে বলেন তোমাদের কাজ সব সে করে দিবে কেমন ? রবিবার রাতে মসজিদে ধর্মসভায় লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা মহকুমার বরেণ্য ইসলামী ব্যক্তিরা মেহেরপুর বড় বাজার জামে মসজিদের ধর্মসভায় ওয়াজ মাহফিল করবেন। বিকালেই বরেণ্য ইসলামী ব্যাক্তিগণ মেহেরপুরে চলে এসেছেন। তাই মেহেরপুর শহরে আশে-পাশে গ্রামের মানুষ দলবদ্ধ ভাবে মসজিদের চত্বরে জড়ো হয়েছে। তখন পুলিশ এলাকায় টহল দিচ্ছে। মেহেরপুর মহকুমার প্রশাসক অফিসের কর্মকর্তারা মসজিদে এসে খোঁজ খবর নিচ্ছে। এই সময় মেহেরপুরের পুলিশ সহ সমস্ত প্রশাসন ধর্ম সভাকে কেন্দ্র করে ব্যস্ত রয়েছে। সেই সুযোগে বর্তমান মেহেরপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে (তখন বালক বিদ্যালয় ছিল) প্রাচীর টপকিয়ে আমরা লেবারসহ (নাম ভুলে গেছি) প্রবেশ করেছি। সে আমাদের নিশ্চিত করছে যে স্কুলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বিশাল কলার গাছ রয়েছে। সে আমাদের বলেছে, স্কুলের মাঝখানে তিনটি কলা গাছ পুঁতার জায়গা ঠিক করে এসেছি। আমরা তিনটি কালো পতাকা তৈরী করেছি। এই কালো পতাকাটি তিনটি কলা গাছের মাথায় কঞ্চিতে বেঁধে টাঙ্গিয়ে দিবো । আর কয়েকটি পিচ বোর্ডে কিছু শ্লোগান লিখলাম। শ্লোগান গুলো ছিল-”বাঙলা মায়ের ভাষা” ” বাঙলা ভাষায় কথা বলবো” বাঙলা ভাষায় পড়বো” বাঙলা ভাষায় লিখবো” পশ্চিম পাকিস্তানী জানোয়ারদের উর্দু ভাষা প্রতাখ্যান করবো”। মেহেরপুর মসজিদ প্রাঙ্গনে হ্যাচাক লাইটের আলো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই আমরা দুইজন মেহেরপুরের ওসি সাহেবকে সিগারেট এবং চা এর ব্যাবস্থা করে এসেছি। আমরা দুইজন ওসির পাশে সব সময় আঠার মতো লেগে আছি। আমাদের পুলিশ কোন প্রকার যাতে সন্দেহ করতে না পারে । এই ভাবে রাত একটার দিকে আমি (ছহী) নকিব ও সহ তিনজন স্কুলে প্রবেশ করেছি। আমরা অন্ধকারে কলা গাছ দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের সেই কানাদের হাতি দেখার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের লেবার কলা গাছ কাটছে। আমরা দুইজন ঘাড়ে করে নিয়েছি। তখন আস্তে আস্তে মাটিতে ফেলে দিচ্ছি। আমাদের মসজিদের হ্যাচাক লাইট এর মৃদু আলো চোখে পড়ছে। আমরা দুইজন এখানে দাড়িয়ে ছিলাম। সেই লেবার সাবল দিয়ে এক হাত করে গর্ত খুড়েছে। আমরা কলাগাছের মাথায় কালো পতাকা টাঙ্গিয়ে দিলাম । এরপর তিনটি গাছে কিছু শ্লোগান লেখা পিচ বোর্ড গুলো পেরেক দিয়ে কলা গাছে পুতে ও দড়ি দিয়ে বেঁধে দিলাম। আমাদের তৈরী শহীদ মিনার তৈরীর পর এক পলক দেখে পালিয়ে এলাম। এবার নকিব এর বাড়িতে এসে পুলিশের জন্যে চা তৈরী করেছি। সেই চা ফ্লাক্সে করে মসজিদে নিয়ে গেলাম । তখন রাত ২টা বেজে গেছে। আমরা মেহেরপুর ওসিকে গরম চা, নাবিস্ক বিস্কট, এবং এক ধামা মুড়কী দিলাম । তারা বেশ মজা করে খাচ্ছে আর আমাদের গায়ে হাত দিয়ে সহনূভুতি দেখাচ্ছে । আমরা দুইজন মৃদস্বরে হাসছি। আর বলছি সকালে যে কি হবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আমরা চেয়ারম্যান আকবর মন্ডলকে অবগত করেছি। তখন তিনি বেশ খুশি হয়েছে। তারপরই ধর্মসভা কায়ক্রম শেষ করে দিলেন । তিনি আমাদের বলেন ফজরের নামাজ মসজিদে পড়তে আসবে কেমন ? সেই সময় তোমরা মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে পাবে ? তোমরা তাদের কাছে বোবার মতো আচরণ করবে কেমন ? আমরা নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেলাম । যথারীতি আমরা এই মসজিদে ফজরে নামাজ আদায় করেছি। আমরা তজবী পড়ছি। আর ভাবছি একটু পরেই তো পুলিশ বেপরোয়া আচরণ শুরু করবে।। ২০/২৫ জন মানুষ মসজিদ থেকে বের হয়ে চলে গেছে। (তখন বালক বিদ্যালয় ছিল) বর্তমান মেহেরপুর সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের এক বুক প্রাচীর থেকে কলাগাছের শহীদ মিনার দেখা যাচ্ছে। মেহেরপুর শহরে সেকেন্ডের মধ্যে এলাকায় ঘটনাটি প্রকাশ হয়ে গেল। অনেক মানুষ আমাদের মসজিদে এসে এই সংবাদ দিচ্ছে। আমরা কর্ণপাত করছি না। আমরা তজবী নিয়ে ব্যস্ত ভাব দেখাচ্ছি। আমরা আস্তে আস্তে রাস্তায় এলাম । তখন প্রাণ ভরে এক নয়নে কলা গাছ দিয়ে আমাদের হাতে তৈরী শহীদ মিনার দেখছি। আমরা রাতের অন্ধকারে তৈরী করলেও অপূর্ব হয়েছে। তিনটি কলাগাছের ওপর কাল পতাকা উড়ছে। দেখছি আর প্রাণ আমাদের জুড়ে যাচ্ছে। এলাকার মানুষ দেখছে আর মানুষ দ্রুত স্থান চেড়ে চলে যাচ্ছে। মেহেরপুর শহরে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ও দ্রুত সরে পড়লাম । বর্তমান মেহেরপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের (তখন মেহেরপুর বালক বিদ্যালয় ছিল) ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইন্দু বাবু সাহেব সকালে মেহেরপুর এসডিও কে স্কুলে কলা গাছ দিয়ে শহীদ মিনারের ব্যাপারে অবগত করেছেন। তিনি স্কুলে পরিদর্শনে এসে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইন্দু বাবুকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করলেন। তিনি কালো পতাকা ও “পশ্চিম পাকিস্তানী জানোয়ারদের উর্দু ভাষা প্রতাখ্যান করবো” এই উক্তি দেখে তেলে-জলের মতো বিস্ফোরণ ঘটেছে। ইতিমধ্যে মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ও মেহেরপুর বালক বিদ্যালয় সভাপতি আকবর মন্ডলকে ডেকে এনে আনা হয়েছে। তারা শ্লোগানের কাগজ শহীদ মিনার থেকে নামিয়ে নিয়ে এনেছে। এলাকায় অনেক পুলিশ মোতায়ন করেছে। তারপর কলাগাছ থেকে কালো পতাকা পুলিশ নামিয়ে ফেলেছে। তিনি সকল শিক্ষক ও কর্মচারীকে কড়া ভাষায় নির্দেশ দিয়েছে। এই স্কুলের কোন ছাত্র শহীদ মিনার তৈরীতে জড়িত রয়েছে। এখনই তাদের তালিকা দিতে হবে। তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের আসামীর কাঠ গড়াই দাঁড় করালেন। মেহেরপুর থানা ওসিকে প্রশ্ন করেন রাতে স্কুলে এত বড় একটি ঘটনা ঘটেছে আপনারা কি করছিলেন। তিনি বলেন আমরা সারা রাত মসজিদে ধর্মসভায় ডিউটি করেছি। তিনি বলেন সরকারকে আমি কি কৌফিয়ত দিব ? মেহেরপুরের ছাত্র আন্দেলন ঠেকানোর জন্য বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তবুও এত বড় অঘটন ঘটিয়েছে ছাত্ররা। তিনি চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে এসডিও হেডমাষ্টার ইন্দু বাবুকে বরখাস্তের আদেশ দিলেন। তখন চেয়ারম্যান সাহেব বলেন ইন্দুবাবু এর সাথে জড়িত এর প্রমাণ নেই । তাই হেডমাষ্টার ইন্দু বাবুকে বরখাস্তের আদেশ আপনি দিতে পারেন না। আমি এই বিষয়টি পরিচালনা কমিটিকে অবগত করবো। তারাই সিদ্ধান্ত নিবে। আমি সভাপতি হিসেবে এই বক্তব্য প্রত্যাখান করলাম। তিনি অনেকটা হতভম্ব হয়ে পড়লেন। স্কুলের সভাপতি প্রস্তাব করলেন হোস্টেলের ছাত্রদের হাতের লেখা যাচাই করতে হবে। তাহলেই আসল ছাত্র ধরা পড়বে। সেই মোতাবেক মেহেরপুরের ওসি ও হেডমাষ্টারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা ছাত্র হোষ্টেল (বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা ভবন) থেকে ১০ জন ম্যাটিকুলেশন পরীক্ষার্থীকে স্কুলে ডেকে এনেছে। শ্লোগান গুলো ছিল-"বাঙলা মায়ের ভাষা” ” বাঙলা ভাষায় কথা বলবো” বাঙলা ভায়ায় পড়বো” বাঙলা ভাষায় লিখবো” ” পশ্চিম পাকিস্তানী জানোয়ারদের উর্দু ভাষা প্রতাখ্যান করবো”। সব ছাত্রকে হুবুহু লেখানো হয়েছে । কিন্তু তাদের লেখার সাথে মিল পাওয়া যায় নি। তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সময় মেহেরপুর ওসিকে প্রশাসনের অনেকেই বাঙালী ওসি বলে তিরস্কার করেছিল। ওসি অনেকটা হতভম্ব ও বেকুব হয়েছে বলে মনে হয়েছে। সোমবার রাতে মেহেরপুর বালক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইন্দু বাবু ও দশম শ্রেণীর দুই ছাত্রকে আটক করেছে পুলিশ। ১৯৫২ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারী মসজিদ থেকে আমাদের ৩১ জনকে আটক করেছিল পুলিশ। পরে আমাদের ৩১ জনকে মেহেরপুর আদালতের হাকিম পাঁচ দিনের কারাদন্ড দিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করেছিল। এই ঘটনায় পর স্কুলে দশম শ্রেণীর ছাত্র মোঃ খবির ও বশির হোষ্টেল (বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা ভবন) এর ভিতরে শ্লোগান দিয়েছিল। এ সময় তার বিরুদ্ধে পুলিশের নিকট রিপোর্ট রয়েছে। সেই কারণে গাংনী থানা তেঁতুলবাড়িয়া এলাকার মোঃ খবির এবং দৌলতপুর থানার মোঃ বশির উদ্দীন (দুই জন দশম শ্রেণীর ছাত্র)কে পুলিশ আটক করেছে। এই সময় মেহেরপুরের পৌর চেয়ারম্যানের আহবানে গণআন্দোলনে মেহেরপুর অচল হয়ে পড়েছিল। সেই সময় মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানের একমাত্র যাত্রী বাস দুইটি অনির্দিষ্টিকালের জন্য বন্ধ রেখেছিল। মেহেরপুর শহরের সমস্ত দোকান-পাট, স্কুল, আদালত সহ যাবতীয় সরকারী ও বেসরকারী অফিস বন্ধ ছিল। এর ফলে মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসককে প্রত্যাহার করে নিতে সরকার বাধ্য হয়েছিল। তারপর কুষ্টিয়ার ডিসি নতস্বীকারের পর হেডমাষ্টার ও দুই ছাত্রকে মুক্তি দিয়েছিল। লেখক মোহাম্মদ ছহিউদ্দীন বিশ্বাস (১৯২৩-২১ মার্চ ১৯৯০) মেহেরপুরের গণমানুষের নেতা, সাবেক জাতীয় সংসদ ও মেহেরপুর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি ২০২২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। অনুলিখন: মহসীন আল আঙ্গুর ১৯৮৯ সালে সাবেক জাতীয় সংসদ ও মেহেরপুর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ছহিউদ্দীন বিশ্বাসের সাথে মহসীন আল আঙ্গুর এক সাক্ষাৎকারে মিলিত হলে এই বক্তব্য পেশ করেন। সূত্র ছহিউদ্দীনএর সাফল্যে আলোকিত মেহেরপুর গ্রন্থ প্রকাশকাল অক্টোবর ২০২২






«
Next
Newer Post
»
Previous
Older Post

No comments:

Leave a Reply