যে বৈষম্যের কারণে বাঙালিরা পাকিস্তান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৪৭ সালে যে দেশ গঠিত হয়েছিল, মাত্র ২৫ বছরের মধ্যে তার মৃত্যু কেন হলো - তা নিয়ে গত পঞ্চাশ বছরে বিস্তর গবেষণা-ব্যাখ্যা-বিতর্ক হয়েছে, এখনও হচ্ছে। সন্দেহ নেই যে পাকিস্তান তৈরির পেছনে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর যুক্তিতে সায় দিলেও পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা কখনই তাদের বাঙালি জাতিসত্তা এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেনি। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণে এত দ্রুত কেন অস্থির হয়ে পড়লো বাঙালি? কেন পাকিস্তান সৃষ্টির দুই দশক না যেতেই বাঙালি জাতিসত্তা নিয়ে তাদের আবেগ, আকাঙ্ক্ষার বাঁধ ভেঙ্গে পড়েছিল? এক কথায় উত্তর- বৈষম্য, শোষণ । পাকিস্তান আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা যেহেতু দেশের পশ্চিমাংশে ঘাঁটি গাড়েন, শাসন ক্ষমতাও সেখানেই কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। সেই সাথে শুরু হয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সমস্ত ক্ষেত্রে দেশের অন্য একটি অংশের নাগরিকদের প্রতি পদে পদে বৈষম্য। যেখানে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুই অংশে মাথাপিছু আয় ছিল সমান, ১৯৭১ সালে পশ্চিমের মানুষের আয় পূর্বের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ঐ ২৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগের অভাবে শত শত স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু পশ্চিমে বেড়ে গেছে তিন গুণ। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে, সেনাবাহিনীর উঁচু পদে বাঙালিদের নিয়োগ পাওয়া খুব কঠিন ছিল। সেই সাথে, বিনিয়োগে অবহেলার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে হয়ে উঠেছিল পশ্চিমের কল-কারখানার কাঁচামালের যোগানদাতা এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রধান ক্রেতা। আরো পড়ুন: যে চার নেতা বদলে দিলেন ১৯৪৭-পরবর্তী পূর্ব বাংলার রাজনীতি যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল তার ‘ডেডলি এমব্রেস‘ বইতে লিখেছেন পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই “পাকিস্তানের কাছে বাংলার গুরুত্ব ছিল দ্বিতীয়“ এবং বাঙালিদের “দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক“ হিসাবে দেখা হতো। 'দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক' মি রিডেল, যিনি একসময় মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর বিশ্লেষক হিসাবে কাজ করেছেন, তার বইতে লিখেছেন, প্রথম থেকেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার ভরকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ পাঞ্জাব রাজ্যের হাতে চলে যায় এবং সেই একচ্ছত্র প্রাধান্য ধরে রাখার চেষ্টা পাকিস্তানের জন্য কাল হয়ে যায়। “প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাব প্রদেশের একচ্ছত্র দৌরাত্ম্য ছিল। পাকিস্তানের ঐ অংশে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ছিল পাঞ্জাবে। সবচেয়ে বেশি উর্বর কৃষি জমি ছিল সেখানে। সবচেয়ে বড় কথা সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্ব ছিল পাঞ্জাবের। অনেক পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তা মনে করতেন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে তাদের স্বার্থ রক্ষায়। তাদের অনেকেই বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করতেন, মনে করতেন বাঙালিদের লড়াই করার ক্ষমতা নেই।“ মার্কিন ঐ গবেষক আরো লিখেছেন, “সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্রে পাঞ্জাবিদের আধিপত্য কায়েম হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমাংশের উন্নয়নের দিকে প্রধান নজর দিল। পূর্ব পাকিস্তানকে একরকম উপনিবেশ হিসাবে দেখা শুরু হয়।“ পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরের ২৫ বছর সেই প্রভু-সুলভ মনোভাবের প্রতিফলন দেখা গেছে পদে পদে। সেইসাথে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে বাঙালি জনগোষ্ঠীর দূরত্ব ক্রমাগত বেড়েছে এবং বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব চাঙ্গা হয়েছে বৈষম্যের খতিয়ান কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক মোহাম্মদ নিয়াজ আসাদুল্লাহ ২০০৬ সালে তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিমের চেয়ে বেশি হওয়া স্বত্বেও সরকারি উন্নয়ন বরাদ্দে বৈষম্য কতটা পাহাড় সমান ছিল। পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৫০-৫৫), কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দের মাত্র ২০ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৬৫-৭০) সেই বরাদ্দ বাড়লেও তা হয়েছিল ৩৬ শতাংশ । মি. আসাদুল্লাহ লিখেছেন, একেতো বরাদ্দ অনেক কম দেওয়া হতো, তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রকাশ্যে এবং গোপনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে তহবিল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জটিল সব কর ব্যবস্থায় আড়ালে নানা খরচ দেখিয়ে এই তহবিল নিয়ে যাওয়া হতো। এক হিসাবে ২৫ বছরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পাচার এই টাকার পরিমাণ ছিল ২৬০ কোটি ডলার। বছরের পর বছর বরাদ্দে এই বৈষম্যের শিকার হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের অবকাঠামো, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা। ভারত ভাগের সময় পাকিস্তানের দুই অংশে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল প্রায় সমান। কিন্তু ১৯৭১ সালে এসে পূর্ব পাকিস্তানে ২৪ বছরের আগের তুলনায় প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা কমে যায়। অথচ পশ্চিমে ১৯৬০ এর দশকে এসেই প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা তিনগুণ বেশি হয়ে যায়। উনিশ'শ একান্ন সালে পূর্ব পাকিস্তানে গ্রাজুয়েটের সংখ্যা ছিল ৪১০০০ আর পশ্চিমে ছিল ৪৫০০০। কিন্তু দশ বছর পর ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গ্রাজুয়েট তৈরি হয় ২৮০০০, যেখানে পশ্চিমে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪০০০-এ। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা শেষ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে ঐ দশ বছরে ৩২ শতাংশ কমে গিয়েছিল, পশ্চিমে বেড়েছিল ২১ শতাংশ। সরকারি বৃত্তি, অনুদান প্রধানত পেয়েছে পশ্চিমের শিক্ষার্থীরা,কারণ বিজ্ঞাপন যখন পূর্বে প্রকাশিত হত তখন আবেদনের সময় থাকতো না। চাকরির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এবং একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে সুযোগ প্রচারে এই দেরি করা হতো উদ্দেশ্যমুলকভাবে। পাকিস্তানী পণ্যের বাজার পাশাপাশি, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপাদিত শিল্প পণ্যের প্রধান বাজার। সরকারি হিসাবেই ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বাণিজ্যে পশ্চিমের উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ১০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ মে মাসের ১৯৭১ একটি গোপন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল যাতে তারা দেখার চেষ্টা করেছিল যে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে দুই ভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে তার কী পরিণতি হবে। দু'হাজার দশ সালে ঐ রিপোর্টের যে খণ্ডিত অংশ প্রকাশ করা হয়, তাতে দেখা যায় যে সিআইএ তখন মনে করেছিল পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পশ্চিম পাকিস্তান বড় ধরণের বাণিজ্য সঙ্কটে পড়বে কারণ তাদের পণ্যের যে মান তাতে বিকল্প বাজার পেতে তাদের সমস্যা হবে। সিআইএর ঐ গোপন রিপোর্টে বলা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক যত বেড়েছে দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য সেই সাথে বেড়েছে, জীবনযাত্রার মানের তারতম্য বেড়েছে। “পূর্ব পাকিস্তানকে বিনিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। তবে সেই বিনিয়োগ কখনই ঠিকমত আসেনি, বিশেষ করে ষাটের দশকের আগে। বেসরকারি বিনিয়োগও ছিল নামে মাত্র। ফলে পূর্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল খুবই নিম্ন। “ ঐ রিপোর্টে বলা হয়, “১৯৭০ সালের বিধ্বংসী সামুদ্রিক ঝড় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি কতটা অসহায় এবং ভঙ্গুর। ঐ সাইক্লোনের পর কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।“ আয় বেড়েছে পশ্চিমে, কমেছে পূর্বে উনিশ'শ সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা মাথাপিছু আয়ের বিবেচনায় তেমন কোনও তারতম্য না থাকলেও, অব্যাহত এই বৈষম্যের পরিণতিতে পরের ২৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৪৯-৫০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৩১১ রুপি (১৯৫৯-৬০ সালের মূল্যের ভিত্তিতে) এবং পূর্ব পাকিস্তানের ছিল ২৮৭ রুপি যা প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু ১৯৬৯-৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথা পিছু আয় দাঁড়ায় ৫৩৭ রুপি এবং পূর্ব পাকিস্তানে ৩৩১ রুপি।পাকিস্তানের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দলিল থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একটি যুক্তি তুলে ধরা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের অব্যাহত অনগ্রসরতার ঐতিহাসিক একটি প্রেক্ষাপট ছিল যে যুক্তি পশ্চিমা অনেক বিশ্লেষকও অংশত স্বীকার করেন। উনিশ'শ সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ পূর্বের অংশের চেয়ে বাড়তি কিছু সুবিধা পেয়েছিল। পশ্চিমের অবকাঠামো অপেক্ষাকৃত উন্নত ছিল। কুড়ি শতাংশ মানুষ নগরের বাসিন্দা ছিলেন। ভারত থেকে অনেক দক্ষ উদ্যোক্তা পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে চলে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রধানত একটি কৃষিনির্ভর অঞ্চল ছিল। অবকাঠামো ছিল খুবই সেকেলে। উদ্যোক্তা যারা ছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন সম্পন্ন হিন্দু যারা ভারতে চলে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেন, এসব যুক্তি ছিল খোঁড়া। তিনি বলেন, শাসক শ্রেণী অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং পাকিস্তানেও সেটাই হয়েছে। পাকিস্তানে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভি, যিনি পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন, বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা এবং উন্নয়নে পিছিয়ে ছিল এই যুক্তি সবসময় এখানে এক পক্ষ দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের জন্য যে ভাগাভাগি, সাম্য, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল তা কি ছিল? আমি বলবো ছিলনা।“ বরঞ্চ পাকিস্তানের সামরিক এবং রাজনৈতিক শাসকরা উল্টো পথে হেঁটেছেন। উঁচু পদে উধাও বাঙালিরা জনৈতিক ক্ষমতা থেকে জবরদস্তি করে দূরে রাখার পাশাপাশি সরকারি চাকরি এবং সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব আটকানোর অব্যাহত চেষ্টা হয়েছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে রিজওয়ান উল্লাহ কোকাব তার একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন কীভাবে সরকারি উঁচু পদের নিয়োগে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। উনিশ'শ পঞ্চাশ সালে, ২০ শতাংশ মেধা-ভিত্তিক নিয়োগের পর ৮০ শতাংশ সরকারি চাকরি দুই অংশের মধ্যে কোটা-ভিত্তিক নিয়োগের নীতি ঘোষণা করা হয়। কিন্ত গবেষক রিজওয়ান কোকাব বলছেন, পূর্ব পাকিস্তানে যোগ্য প্রার্থী নেই এই যুক্তিতে কখনই সে কোটা মানা হয়নি। ফলে, ১৯৬৬ সালে এসেও দেখা গেছে সরকারি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব খুবই কম। উনিশ'শ ছেষট্টি সালে প্রেসিডেন্ট সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের ৮১ শতাংশ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের আর মাত্র ১৯ শতাংশ পূর্বের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এই অনুপাত ছিল ৬৪ এবং ৩৬ শতাংশ। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৯২ শতাংশ কর্মকর্তাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৭৮ শতাংশই ছিলেন পশ্চিমের বাসিন্দা। উনিশ'শএকাত্তর সালে এসেও সেই চিত্র তেমন বদলায়নি। ঐ বছর সরকারি গেজেটেড কর্মকর্তাদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিল ১৯৬, সেখানে এক পাঞ্জাব প্রদেশের কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ১৯৯। বাংলাদেশের সাবেক সচিব ড. আকবর আলী খান, যিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা ছিলেন, বিবিসিকে বলেন, সরকারি চাকুরীতে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যে কোনো রাখ-ঢাক ছিলনা। “প্রচুর বিহারী ( ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসা উর্দুভাষী) নিয়মিত বাঙালি কোটায় চাকরি পেয়েছে।“ ভারত ভাগের সময় ভারতীয় সিভিল সার্ভিস এবং ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের যে ৯৫ জন মুসলিম কর্মকর্তা পাকিস্তানে গিয়েছিলেন তাদের মাত্র দুইজন ছিলেন বাঙালি। এক-তৃতীয়াংশই ছিলেন পাঞ্জাবি। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে জেলা বা মহকুমা পর্যায় পর্যন্তও প্রধান প্রশাসকরা ছিলেন অবাঙ্গালি।এই ব্যবধান থেকেই গিয়েছিল। একজন সচিব হতে বাঙালিদের ১৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। উনিশ'শ চৌষট্টি সালে দুইজন বাঙালি সচিব হয়েছিলেন, তাও একজনের পোস্টিং ছিল ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সেক্রেটারিয়েটে, অন্যজনের পরিকল্পনা বিভাগে। সংস্থাপন, অর্থ, প্রতিরক্ষার মত জায়গায় বড় পদে বাঙালি অফিসারদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হতো। গবেষক রিজওয়ান কোকাব বলছেন, বাঙালিদের এমন জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হতোনা যেখানে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সিদ্ধান্ত হয়।গবেষণাপত্রের উপসংহারে তিনি লিখেছেন, “সরকারি চাকুরীতে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং কম প্রতিনিধিত্ব - এই দুটো বিষয় বাঙালিদের মধ্যে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতায় ইন্ধন দিয়েছে।“ সেনাবাহিনীতেও একই চিত্র জেনারেল ওয়াসিউদ্দিন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে একমাত্র তির তারকা বাঙালি অফিসার হতে পেরেছিলেন যদিও তার জন্য তাকে ১৯৬৯ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। উনিশ'শ উনসত্তর সালে এ ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা নেওয়ার পর বাঙালিদের অসন্তোষ সামাল দিতে সেনাবাহিনী এবং সরকারি উঁচু পদে তাদের নিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন।কিন্তু তারপরও ১৯৭০ এ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ৬০০০ অফিসারের মেধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ৩০০। সিংহভাগই নিম্নপদের কর্মকর্তা। উনিশ'শএকাত্তর সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ বাঙালি অফিসার ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুনিরুজ্জামান। তিনি বিবিসিকে বলেন, “একাকী মনে হতো। একটি জায়গায় বিশজন অফিসারের মধ্যে হয়তো একজন থাকতেন বাঙালি। যদি ২০০ ক্যাডেট অ্যাকাডেমিতে ঢুকতো, তার মধ্যে বড়জোর চার-পাঁচজন থাকতো বাঙালি। ১৯৭০ এর দিক এসে কিছুটা বেড়েছিল।“ তিনি বলেন, নিয়োগে একচোখা নীতি তো ছিলই, সেইসাথে সমান প্রতিযোগিতা করে ঢোকার মত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর একটি ঘাটতিও পূর্ব পাকিস্তানে ছিল। “দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তান ব্রিটিশদের তৈরি কতগুলো আবাসিক ইংরেজি স্কুল পেয়েছিল যেগুলো তাদের পাহাড়ি শৈল শহরগুলোতে ছিল। আমাদের এখানে তা ছিলনা,“ তিনি বলেন। জেনারেল জামান বলেন, সেনাবাহিনীতে বাঙালি শুধু যে কম ছিল তা নয়,, সামরিক সরঞ্জামের ৯৫ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। “ইস্টার্ন ফ্রন্টকে তারা কখন গুরুত্বই দেয়নি।“ ''উনিশ'শ পইষট্টি সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত যেভাবে অরক্ষিত ছিল, তাতে বাঙালিদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছিল পাকিস্তান সরকার কাশ্মীরের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে হারাতেও হয়ত কার্পণ্য করবে না,'' তিনি বলেন। সাংস্কৃতিক বৈষম্য, নির্যাতন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী জেনিফার কোটস পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই নিয়ে গবেষনাধর্মী একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। ঐ বইতে তিনি লেখেন, “পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতির অনেক অমিল ছিল এবং বাঙালিরা তাদের সংস্কৃতি রক্ষা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল।“ কিন্তু বিশেষ করে ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও বাঙালিদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কঠোর নজরদারিতে পড়ে। জেনিফার কোটস লেখেন, “১৯৫৮ সালে পাকিস্তান শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে ভিন্ন খাতে - তারা বলতো সঠিক খাতে- পরিবর্তনের কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চাপ দেওয়া। ''ইসলামি সংস্কৃতি ঢোকানোর চেষ্টা শুরু হয়। জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো তৈরি হয় যার প্রধান কাজই ছিল বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন। সরকারের নীতির স্তুতির জন্য লেখক বুদ্ধিজীবীদের গাড়ি-বাড়ি-টাকা উপঢৌকন দেওয়া শুরু হয়। তাদের বিদেশে ভ্রমণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। ''প্রেস এবং পাবলিকেশন আইন করে ১৯৬১ সালে সংবাদপত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দারুণভাবে খর্ব করা হয়।“ এমনকি ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান এবং আইয়ুব খানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন সরকারি প্রচারমাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম প্রচার নিষিদ্ধ করে দেন। নজরুল ইসলামের কবিতা প্রচারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়, এমনকি তার কবিতার অনেক শব্দ উর্দু করে নতুন করে প্রকাশ করা হয়। মিজ কোটস তার বইতে লিখেছেন কয়েকটি গ্রুপকে শায়েস্তার জন্য সনাক্ত করা হয়: ১. যেসব শিক্ষকের সাথে আওয়ামী লীগের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে, কারণ তারা স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে কাজ করবে। ২. নাম করা বুদ্ধিজীবী তা তিনি সরাসরি রাজনীতিতে থাকুন আর নাই থাকুন। ৩. বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ৪. ছাত্র এবং বিপ্লবী রাজনীতিক। “মোদ্দা কথা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করছেন, জাগিয়ে রাখছেন, প্রচার করছেন এমন যে কেউই টার্গেট। ২৫শে মার্চের রাতের হামলার টার্গেট এবং নৃশংসতা দেখে বোঝা যায় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা তাদের নিয়ন্ত্রণ আরোপের পথে কাদের প্রধান সমস্যা মনে করতেন,“ মিজ কোটস লেখেন। বছরের পর বছর এসব অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক-সংস্কৃতি নির্যাতন বাঙালিদের পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে মনস্তাত্বিকভাবে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করেছে এবং তাদের মধ্যে দিনে দিনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ শক্ত হয়েছে। পাকিস্তানের কোনো অনুশোচনা? পাকিস্তানী শাসকরা বা সেখানকার সমাজের প্রভাবশালীরা পূর্ব পাকিস্তান এবং বাঙালিদের প্রতি এসব বৈষম্যকে কিভাবে দেখতেন? রাজনীতির শিক্ষক, লেখক এবং পাঞ্জাব প্রদেশের সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হাসান আকসারি রিজভি ১৯৭১ সালে ব্রিটেনে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে স্বাধীন হয়। ফলে, পাকিস্তানের ঐ পর্ব নিয়ে পরে তিনি অনেক পড়াশোনা এবং লেখালেখি করেছেন। মি রিজভি বলেন, পাকিস্তান ভাঙার পেছনে যে অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতাই মূল কারণ ছিল এই বোধোদয় এখন পাকিস্তানে অনেক বেশি। “এ নিয়ে পাকিস্তানে এখন অনেক খোলামেলা তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, বিশ্লেষণ হচ্ছে।“ “পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রাজনৈতিক এবং সামরিক শাসকরা এই বৈষম্যের বিষয়টি বুঝতে পারতেন না, বোঝার চেষ্টাও করতেন না। বিশেষ করে ৫৮ সালের পর সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার পর এই বোধোদয় আরো দূরে সরে গিয়েছিল।“ মি রিজভি বলেন, বাঙালিদের অসন্তোষ যত বেড়েছে শাসক শ্রেণী ততই বলেছেন ভারত এসব করাচ্ছে। “ সন্দেহ নেই যে ভারত পাকিস্তানের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে, কিন্তু ব্যর্থতার প্রধান দায় সে সময়কার শাসকদের।“ “তারা বোঝেননি শুধু ধর্ম দিয়ে ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব নয়। জাতীয় ঐক্যের জন্য যে ভাগাভাগি, সাম্য, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন, তা ছিলনা।“ পাকিস্তান কি এখন অনুশোচনা করে? প্রশ্নে মি. রিজভি বলেন, এ নিয়ে দুই ধরনের মতামত রয়েছে। “একদল মনে করে পাকিস্তান অটুট থাকলে আজ বিশ্ব রাজনীতিতে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের অনেক বেশি প্রভাব হতে পারতো। আরেক দল মনে করে পাকিস্তান এখন অনেক ম্যানেজেবল, সামাল দেওয়া সহজ হয়েছে।“ তবে মি. রিজভি মনে করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে পাকিস্তান। “ষাটের বা সত্তরের দশকের পাকিস্তানের চেয়ে এখনকার পাকিস্তান জাতিগত, ভাষাগত, সাংস্কৃতিগত ভিন্নতা এবং স্পর্শকাতরতা নিয়ে অনেক বেশি অ্যাকোমোডেটিভ। এ বিষয়গুলো নিয়ে অনেক বেশি ভাবা হয়।“Slider
দেশ
মেহেরপুর জেলা খবর
মেহেরপুর সদর উপজেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
যাবতীয়
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News

No comments: