Sponsor



Slider

দেশ

মেহেরপুর জেলা খবর

মেহেরপুর সদর উপজেলা


গাংনী উপজেলা

মুজিবনগর উপজেলা

ফিচার

খেলা

যাবতীয়

ছবি

ফেসবুকে মুজিবনগর খবর

» » » বাংলার সাহিত্যের যে অধ্যায় শুরু হয়েছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের হাত ধরে




বাংলার সাহিত্যের যে অধ্যায় শুরু হয়েছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের হাত ধরে

‘পুথি’ শব্দটা এসেছে ‘পুস্তিকা’ থেকে। সাধারণভাবে যার অর্থ বই বা গ্রন্থ। তবে মজার ব্যাপার হলো— সব পুথিকে বই বলা গেলেও সব বইকে পুথি বলা যায়না। পুথি সাহিত্য মানে কিন্তু একদম আলাদা কিছু। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক সময় ছিল, যখন বিশেষ ধরণের কিছু রচনা তৈরি হয়েছিল— যেখানে ভাষা, বিষয় আর ধাঁচ—সবকিছুই ছিল আলাদা। আপনি কি জানেন, বাংলা সাহিত্যে এক সময় এমন এক ধারা ছিল যেখানে বাংলা, আরবি, ফারসি—সব ভাষা মিলেমিশে এক অদ্ভুত, রঙিন ভাষা তৈরি হয়েছিল? যে ভাষায় প্রেম, যুদ্ধ, ধর্ম আর রোমাঞ্চ একসঙ্গে নেচেছে কাব্যের পাতায়! যে সাহিত্যের রচয়িতা এবং পাঠক উভয়ই ছিল মুসলমান সম্প্রদায়। চলুন আজকে জেনে নিই বাংলা সাহিত্যের হারিয়ে যাওয়া এক অধ্যায় পুথি সাহিত্য! পুথি সাহিত্য আসলে কী? ‘পুথি’ শব্দটা এসেছে ‘পুস্তিকা’ থেকে। সাধারণভাবে যার অর্থ বই বা গ্রন্থ। তবে মজার ব্যাপার হলো— সব পুথিকে বই বলা গেলেও সব বইকে পুথি বলা যায়না। পুথি সাহিত্য মানে কিন্তু একদম আলাদা কিছু। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক সময় ছিল, যখন বিশেষ ধরণের কিছু রচনা তৈরি হয়েছিল— যেখানে ভাষা, বিষয় আর ধাঁচ—সবকিছুই ছিল আলাদা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেই বিশেষ সময়ে রচিত বিশেষ ধরণের সাহিত্যই পুথি সাহিত্য নামে পরিচিত। চর্যাপদ ইতিহাসের পাতায় পুথি সাহিত্য পুথি সাহিত্য শুরু হয়েছিল প্রায় আঠারো শতকে। আরবি, ফারসি, উর্দু আর হিন্দির প্রভাব মিশে গিয়েছিল বাংলার মাটির গন্ধে। আনুমানিক ১৬৮০-১৭৭০ হুগলির বালিয়া-হাফেজপুরের কবি ফকির গরীবুল্লাহ এ কাব্যধারার সূত্রপাত করেন আমীর হামজা রচনার মধ্য দিয়ে। আরব দেশের ইতিহাস-পুরাণ মিশ্রিত কাহিনী অবলম্বনে রচিত আমীর হামজা এক যুদ্ধকাব্য, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরিসংখ্যান মতে যার ৩২ শতাংশ শব্দ ছিল বিদেশী। মধ্যযুগে প্রায় পাঁচশ বছর ধরে বাংলা ভাষার যে ঐতিহ্য, তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ধারণা করা হয়, এর উৎস ছিল কলকাতা, হাওড়া, হুগলি ও ২৪ পরগনা অঞ্চলের মুসলমানদের কথ্যভাষা। ভাবুন তো, বাংলা শব্দের মধ্যে আরবি-ফারসি এমনভাবে মিশেছে যে তৈরি হয়েছে একদম আলাদা এক সাহিত্যভাষা! বাংলা পুথি: মুসলমান সমাজের কণ্ঠস্বর পুথির লেখক আর পাঠক— দুজনই ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। বিশেষ করে, নিম্নবিত্ত চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা ছিল বিস্ময়কর। ফকির গরীবুল্লাহ নিজে এবং তার শিষ্য সৈয়দ হামজার অনুসরণে পরবর্তীকালে বহু সংখ্যক মুসলমান কবি এ জাতীয় কাব্য রচনা করেন। তখনকার দিনে এ পুথিগুলোই ছিল বিনোদন, ধর্মীয় শিক্ষা আর ইতিহাসের অন্যতম উৎস। ভাষার জাদু পুথির ভাষাকে কেউ বলতেন ‘মুসলমানী বাংলা’, কেউ বলতেন ‘দোভাষী পুথি’, আবার কেউ বলেতেন ‘মিশ্র ভাষারীতির কাব্য’। কলকাতার বটতলার ছাপাখানায় ছাপা হতো বলে একে ‘বটতলার পুথি’ও বলা হতো। সাধারণ বাংলা গ্রন্থের মতো পুথি সাহিত্য বাম দিক থেকে পড়া হলেও তা ছাপা হতো আরবি-ফারসির মতো ডান দিক থেকে। পয়ার-ত্রিপদী ছন্দে রচিত অলঙ্কারবর্জিত গদ্যধর্মী সরল ভাষা এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কাব্যের ধরণ ও বৈচিত্র্য বিষয় ও রস বিচারে পুথি সাহিত্য ছয় ভাগে ভাগ করা যায়— ১. রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য (ইউসুফ-জুলেখা, লাইলী-মজনু) ২. জঙ্গনামা বা যুদ্ধকাব্য (আমীর হামজা, হাতেম তাই) ৩. নবী-আউলিয়ার জীবনীকাব্য ৪. লৌকিক পীর পাঁচালি (সত্যপীরের পাঁচালি, বনবিবির জহুরনামা) ৫. ইসলামের ইতিহাস, ধর্ম, রীতিনীতি বিষয়ক শাস্ত্রকাব্য (নসিহতনামা) ৬. সমসাময়িক ঘটনা নির্ভর কাব্য প্রেম থেকে পীর, জীবনীকাব্য থেকে জঙ্গনামা— সবকিছুই ছিল পুথির পাতায়। পুথি লেখার উপকরণ ও প্রস্তুত প্রণালি কাগজ আবিষ্কারের আগে পুথি লেখার জন্য ব্যবহার করা হতো চামড়া, ভূর্জপত্র, তেরেটপত্র, গাছের বাকল, কলা ও তালপাতার মতো প্রাকৃতিক উপাদান। এগুলো জলে ভিজিয়ে, সেদ্ধ করে ও শুকিয়ে লেখার উপযোগী করা হতো। ফলে রঙ হতো ধূসর বা পান্ডু এবং টেকসই হতো। পরে এসব উপকরণের সীমাবদ্ধতা দূর করতে শন, তুলা, তিসি ও ছেঁড়া কাপড়ের তন্তু দিয়ে তৈরি হয় তুলট কাগজ। লেখার জন্য কলম হিসেবে ব্যবহার করা হতো বাঁশের কঞ্চি, পাখির পালক বা নলজাত ঘাস। আর কালি তৈরি হতো শিমুলের ছাল, জবা, গাব, আমলকী, কাঠকয়লা ও পোড়া চালের গুঁড়োসহ নানা প্রাকৃতিক উপাদান থেকে। কলম পুথি লেখার প্রাচীন উপকরণ তুলট কাগজ ও বাঁশের কঞ্চি বাংলার উল্লেখযোগ্য পুঁথি সাহিত্য ইউসুফ-জুলেখা, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল— এসব ছিল প্রেমের কাব্য। আর আমীর হামজা, সোনাভান, জৈগুনের পুথি, হাতেম তাই— এসব কাব্যে পাওয়া যায় বীরপুরুষদের যুদ্ধ আর ইসলাম প্রচারের গল্প। এরপর আছে নবী, পীর আর আউলিয়াদের জীবনীভিত্তিক কাব্য— যেমন কাসাসুল আম্বিয়া, তাজকিরাতুল আউলিয়া। তবে সবচেয়ে চমৎকার বিষয় যেখানে হিন্দু দেবতা আর মুসলমান পীরের গল্প একসঙ্গে মেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সত্যপীরের পাঁচালি, গাজীকালু চম্পাবতী বা বনবিবির জহুরনামার কথা। আরো ছিল ধর্মীয় উপদেশভিত্তিক পুথি— নসিহতনামা বা ফজিলতে দরুদ। এমনকি হাজী শরিয়তুল্লাহর সময়কার সমাজঘটনাও উঠে এসেছে কিছু কাব্যে। তখনকার মুসলমান সমাজ ছিল এক রকম হতাশা আর পরাজয়ের ভেতর। তাই এ কাব্যগুলোয় তারা খুঁজে পেয়েছিল আশ্বাস, গৌরব আর আত্মতৃপ্তি। এ কারণেই খুব অল্প সময়ে পুথি সাহিত্য সমগ্র বাংলায় ছাড়িয়ে উড়িষ্যা আর ত্রিপুরাতেও ছড়িয়ে পড়ে। পুথি সাহিত্যের লেখক পরিসংখ্যান পুথি সাহিত্যের এ ধারায় ঠিক কতজন কবি কতগুলো কাব্য রচনা করেছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান আজও জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া যায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ১৮৫৫ সালে জেমস লং তার ‘এ ডেসক্রিপ্টিভ ক্যাটালগ অব বেঙ্গলি ওয়ার্কস’-এ ৪১টি দোভাষী পুথির তালিকা প্রকাশ করেন। ১৯৬৪ সালে মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন ২৭০টি দোভাষী পুথির কথা, যদিও রচয়িতাদের নাম সেখানে নেই। গবেষণা বই অন্যদিকে, অধ্যাপক আহমদ শরীফ সম্পাদিত ‘পুথি-পরিচিতি’ গ্রন্থে পাওয়া যায় শতাধিক কবির প্রায় ২০০ পুথির তালিকা। আর অধ্যাপক আলী আহমদের সংকলিত তালিকায় পুথিকারের নামসহ রয়েছে ৫৬৯টি কাব্যের নাম। সব উৎস একত্রে বিশ্লেষণ করলে পুনরাবৃত্তি বাদ দিয়ে শতাধিক কবির রচিত প্রায় দুই থেকে আড়াইশ পুথির তথ্য পাওয়া যায়। যেভাবে হারিয়ে গেল পুথি যখন বাংলা সাহিত্যে এলেন রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত; তখন শুরু হলো আধুনিক গদ্যের যুগ। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ‘পন্ডিতি বাংলা’ আর কোম্পানির ভাষানীতি বদলে দিল সব কিছু। মুসলমান সমাজও ধীরে ধীরে পুথির ভাষা ত্যাগ করল। এর ফলে আজ পুথি সাহিত্য শুধু ইতিহাসের পাতায় থেকে যাওয়া এক অধ্যায় হয়েই রয়ে গেছে। আজকের প্রাসঙ্গিকতা তবুও ভাবুন, এ পুথিগুলোর ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক সময়ের সমাজ, ভাষা আর সংস্কৃতির চিত্র। এতে দেখা যায়, একজন বাঙালি মুসলমান কেমন করে নিজের সাহিত্য তৈরি করেছিল, নিজের কণ্ঠে। সেই কণ্ঠ, সেই ভাষা আজও আমাদের সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ।গ্রন্থনা:অধ্যক্ষ মহসীন আলী আঙ্গুঁর ,সম্পাদক ও প্রকাশক, মুজিবনগর খবর ডট কম,মেহেরপুর।






«
Next
Newer Post
»
Previous
Older Post

No comments:

Leave a Reply