লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তানের অস্বাভাবিক উত্থান পরবর্তী অনিবার্য পতন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণাটির প্রকাশ ঘটেছিল লাহোর প্রস্তাবে। প্রস্তাবের পেছনে প্রধান ব্যক্তি ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। কিন্তু ১৯৪০ সালের সেই প্রস্তাবটি যে ১৯৪৬-এ এসে বিকৃত হয়ে গেল, তার কৃতিত্বও জিন্নাহর প্রাপ্য। আদি প্রস্তাবে একাধিক ‘স্টেট’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল এবং তখন পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমারেখা কী হবে তা চিন্তা করা হয়নি। শুধু এইটুকুই পরিষ্কার করে বলা হয়েছিল– ভারতীয় মুসলমানরা যেহেতু একটি স্বতন্ত্র জাতি, স্বাধীন ভারতবর্ষে তাই তাদের জন্য নিজস্ব বাসভূমি প্রয়োজন। তার জন্য একটি স্টেট নয়, একাধিক স্টেট দরকার পড়বে। একটি উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে, অপরটি পূর্বে। পাকিস্তান নামটিও লাহোর প্রস্তাবে ছিল না; এটি সংবাদপত্রের দেওয়া। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য যে ভূগোলকে কাটতে হবে, এমনটাও ভাবা হয়নি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়েই পাকিস্তান হবে– এটা বলা হলেও যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেখানকার মুসলমানদের অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে, তা নিয়ে মোটেও ভাবা হয়নি। শুধু এটুকু বলা হয়েছিল, মুসলমানরা যেখানে সংখ্যালঘু সেখানে সাংবিধানিকভাবে তাদের জন্য কার্যকর ও বাধ্যতামূলক এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে তাদের ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। জিন্নাহ ও তাঁর অনুসারীরা সংখ্যালঘুদের সমস্যাটা জানতেন। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, আসাম, মাদ্রাজ– এসব জায়গায় মুসলমানরা পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করছিলেন, অথচ স্বপ্নের পাকিস্তান বাস্তবায়িত হলে সেখানে তাদের ঠাঁই হবে না– এটা প্রকাশ পেয়ে গেলে তারা যে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন, এমন আশঙ্কা অবশ্যই ছিল। পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবয়বটি তাই পরিষ্কার করা হয়নি। ইচ্ছা করেই অস্পষ্ট রাখা হয়েছিল। ওদিকে ১৯৪৬-এর নির্বাচনের পর যখন সম্ভাবনা দেখা দিল যে পাকিস্তান পাওয়া যাবে তখন জিন্নাহ মনে করলেন, মুসলমানদের এই স্বতন্ত্র বাসভূমিতে একাধিক নয়; রাষ্ট্র থাকবে একটাই। জিন্নাহর চিন্তা ছিল– তিনিই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন এবং সে রাষ্ট্র দুখণ্ডে বিভক্ত হলে চলবে না; হতে হবে এককেন্দ্রিক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই মূল প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি ফেডারেল পদ্ধতির অধীনে পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক যে ব্যবস্থার দাবি পূর্ববঙ্গের পক্ষ থেকে করা হয়েছে তা ছিল ন্যায়সংগত, বাস্তবতাভিত্তিক ও ইতিহাস-সমর্থিত। কিন্তু জিন্নাহ তো বটেই, পাকিস্তানের পরবর্তী শাসকরাও, পারস্পরিক প্রতিযোগিতামূলক এবং স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে সে-দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। ফলে শাসকদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের বিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং ১৯৭১-এর ২৩ মার্চ বাংলাদেশের সর্বত্র যখন পাকিস্তানের পতাকার জায়গাতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে তখন বাংলার তো অবশ্যই, গোটা পাকিস্তানের মাটি থেকেই লাহোর প্রস্তাবের উপস্থিতি শেষ হয়ে গেছে। ১৯৪০-এর ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল এবং প্রতিষ্ঠার পরে পাকিস্তান রাষ্ট্র ওই দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে আসছিল। নিয়ম ছিল ওই দিন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ঘটা করে উত্তোলনের। ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান যে ভীষণ রকমের উত্তেজিত বক্তৃতাটি দিয়ে গণহত্যার যৌক্তিকতা খাড়া করবার হাস্যকর ও করুণ চেষ্টা করেন, তাতে পাকিস্তানের পতাকার অবমাননার কথাটা তিনি খুব জোর দিয়েই উল্লেখ করেছিলেন। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের ভেতর দিয়ে উদয়ের দিবস ২৩ মার্চেই লাহোর প্রস্তাবের অস্তাচলগমন ঘটে গেল। উদয় ঘটেছিল ১৯৪০-এর লাহোরে, অস্ত গেল ১৯৭১-এর ঢাকাতে। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান টিকবে কি টিকবে না– এই প্রশ্ন শুরুতেই দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভগ্ন অবস্থায় প্রাপ্তির পর। জিন্নাহ বলেছিলেন, এই পাকিস্তান খণ্ডিত ও পোকায়-খাওয়া, তবু একে মেনে নিতে হবে। পাকিস্তান দাবির জালে তিনি তখন স্বেচ্ছায় এমনভাবে জড়িত যে, তা থেকে বের হয়ে আসবার কোনো উপায় তাঁর জানা ছিল না। জানা ছিল না তা মুসলিম লীগেরও। দেশলাইয়ের একটি বাক্স দেখিয়ে শিখদের নেতা বলদেব সিংকে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘এই মাপের হলেও পাকিস্তান আমার চাই।’ কংগ্রেসের নেতারা ভেবেছিলেন, খণ্ডিত বাংলা ও পাঞ্জাবের ওপর ভর করে গঠিত পাকিস্তান বড় জোর ২৫ বছর টিকবে। কারও কারও মত ছিল– অতদিনও নয়, ১০ বছরেই পাকিস্তানিরা বলবে– ভুল হয়ে গেছে; ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। নতুন রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নিয়ে জিন্নাহর নিজের মনেও নিশ্চয়ই সংশয় ছিল। নইলে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অমন জোর দিয়ে বারবার তিনি বলবেন কেন– পাকিস্তান হ্যাজ কাম টু স্টে? টিকবে না যে মনে করা হচ্ছিল, তার কারণ একাধিক। প্রথমত, দুই অংশের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা। দ্বিতীয়ত, দুই অংশের ভেতর সম্পর্কের সমস্যা। পূর্বাংশে বসবাস ছিল শতকরা ৫৬ জনের, অথচ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পশ্চিমাংশের, যার লোকসংখ্যা শতকরা ৪৪ জন। ৫৬ : ৪৪-এর সমীকরণটা ছিল দুরূহ। অনুমান করা হচ্ছিল, ৪৪ জন যদি ৫৬ জনকে শাসন ও শোষণ করতে চায় তবে একসঙ্গে থাকাটা অসম্ভব হবে বৈ কি। টিকে থাকার ২৩ বছরে এসে সেটাই সত্য প্রমাণিত হয়। শতকরা ৪৪ জনেরও নয়; শাসন ছিল ২৯ জনের, অর্থাৎ পাঞ্জাবিদের। পাঞ্জাবি শাসকদের চেষ্টা ছিল পাকিস্তানে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ গড়ে তুলবে। সেটা যে পূর্ববঙ্গ কিছুতেই মেনে নেবে না– সে সত্যকে শাসকেরা বিবেচনার মধ্যে নেয়নি। সম্মতি ছাড়াই চলছে শাসন ও শোষণ। জিন্নাহ নিজে পাঞ্জাবি ছিলেন না; ছিলেন গুজরাটি। তিনিও মনে করতেন, পাঞ্জাবি শাসন কেবল অনিবার্য নয়, অপরিহার্যই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, পাঞ্জাব হবে পাকিস্তানের হৃৎপিণ্ড। তাঁর নির্ভরতা ছিল সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের পাঞ্জাবি সদস্যদের ওপর। তৃতীয়ত, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ছিল যে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ওপর ভর করে, সেটাই ছিল ভ্রান্ত। লাহোর প্রস্তাবের মূল ভ্রান্তিটাও ওইখানে। ভারতবর্ষ এক বা দুই জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহুজাতির দেশ এবং তাদের জাতীয়তার ভিত্তি যে ধর্ম হবে– এমনটা সম্ভব ছিল না। মূল ভিত্তি ছিল ভাষা। হিন্দু ও মুসলমান ছিল দুটি সম্প্রদায়ের নাম; দুটি জাতির নাম নয়। সম্প্রদায়কে জাতিতে পরিণত করার বিরুদ্ধে মওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন। বলেছিলেন নিগৃহীত হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি বি আর আম্বেদকরও। কিন্তু তাদের কথায় তেমন কেউ কান দেয়নি। পাকিস্তান গঠিত হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, পূর্ব-পশ্চিমে সবাই এক বলে প্রচার মাধ্যমে যতই আওয়াজ দেওয়া হোক না কেন; ভাষা, সংস্কৃতি ও আচার-ব্যবহারে দুই অঞ্চলের মানুষ মোটেই এক নয়। পরস্পরের অনেক দূরবর্তী। দুই পাকিস্তানের অর্থনীতি যে এক থাকবে না– সেটাও পরিষ্কার হওয়া শুরু করেছিল পাকিস্তানের যাত্রা শুরুর সময় থেকেই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সূচনাতেই জিন্নাহ বুঝে ফেলেছিলেন, দ্বি-জাতিতত্ত্বের ওপর ভরসা করা যাবে না। বিশেষ করে যখন স্বচক্ষে দেখলেন নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দরুন কেমন রক্তপাত ঘটেছে; কত মানুষ উৎপাটিত হয়েছে। শরণার্থীদের দুর্দশা দেখে তিনি তাঁর বিরল দুর্বলতার পরিচয়ও দিয়েছিলেন। একবারের জন্য হলেও চোখের পানি ফেলেছিলেন। রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে হিন্দু-মুসলিম পরিচয়ে যে কুলাবে না– এটা তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দেখতে পেয়েছিলেন সংখ্যালঘুদের বিবেচনা বাদ দিয়েও সংখ্যাগুরু মুসলমানরাও এক নয়। তারা পাঞ্জাবি, বাঙালি, সিন্ধি, বেলুচি, পাঠান ইত্যাদিতে বিভক্ত। তাই পাকিস্তানের জন্মের কয়েক দিন আগেই (১১ আগস্ট, ১৯৪৭) গণপরিষদের সভাপতি হিসেবে তিনি ঘোষণা করেছিলেন– পাকিস্তানে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না; ইংরেজিতে “ৎবষরমরড়হ ড়িঁষফ যধাব হড়ঃযরহম :ড় ফড় রিঃয :যব নঁংরহবংং ড়ভ :যব ংঃধঃব.”। বললেন, ‘এখন থেকে আমাদের পরিচয় আর ধর্মের ভিত্তিতে হবে না। হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের পরিচয় হবে একটাই– আমরা পাকিস্তানি।’ অর্থাৎ কিনা ধর্মনিরপেক্ষ একটি নতুন জাতিই সৃষ্টির পক্ষে বললেন তিনি এবং এই বলার মধ্য দিয়ে লাহোর প্রস্তাবের মূল ভিত্তি যে দ্বি-জাতিতত্ত্ব, বস্তুত সেটিকেই নাকচ করে দিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার কালে ‘স্টেটস’-এর জায়গাতে ‘স্টেট’ বসিয়ে প্রস্তাবটিকে বিকৃত করা হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মুহূর্তে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে আসাতে প্রস্তাবের প্রাণবস্তুতেই আঘাত করা হলো। উল্লেখ্য, জিন্নাহ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথমাংশে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কথাই ভাবতেন। কিন্তু এই যে নতুন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ পাকিস্তানি জাতীয়তা, এর ভিত্তিটা কী হবে– সে প্রশ্ন তো রয়েই গেল। ভিত্তি হিসেবে তিনি ভাষাকেই বেছে নিলেন এবং সে জন্যই ঘোষণা দিলেন– পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, এবং কেবল মাত্র উর্দু। উর্দু তাঁর নিজের ভাষা নয়; পাঞ্জাবিদের মাতৃভাষাও নয়। তবে উর্দুকে তারা সবাই মনে করতেন মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ভাষা। উর্দুই যে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে– এটা তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঢাকায় এসে তাঁর প্রথম গণসংবর্ধনা সভায় সাড়ম্বরে ঘোষণা করেছিলেন। প্রতিবাদ হয়েছিল, কিন্তু তিনি পরোয়া করেননি। সংবর্ধনা সভায় ওই ঘোষণা দেবার দুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন সভায় আবারও তিনি ওই কথার পুনরুক্তি করেন। শিক্ষার্থীদের তিনি বলেছিলেন, প্রাদেশিক হয়ো না; মনেপ্রাণে পাকিস্তানি হয়ে যাও। উর্দুকে ঐক্যের রজ্জু হিসেবে আঁকড়ে ধরো। সে নির্দেশ বাঙালিরা মেনে নেয়নি; নেওয়াটা সম্ভবও ছিল না। ভাষা দিয়ে ঐক্য গড়ার চেষ্টা তেমন জোরদার না হলেও পুঁজিবাদী উন্নতি দিয়ে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় কোনো বিরাম ঘটেনি এবং ঐতিহাসিক ও মর্মান্তিক বক্রাঘাতটি ঘটেছে এইখানেই। পাকিস্তানে যতই উন্নতি ঘটেছে ততই সে নিকটবর্তী হয়েছে ধ্বংসের। কারণ উন্নতিটা ছিল একপেশে। উন্নতি বৃদ্ধির প্রধান উপহারটি ছিল বৈষম্য বৃদ্ধি। শোষণ ও লুণ্ঠনভিত্তিক উন্নতির তালে তালে ও অন্তরালে শ্রেণি বৈষম্য ও আঞ্চলিক বৈষম্য, দুটোরই অপ্রতিহত বৃদ্ধি ঘটছিল। শ্রেণি বৈষম্যকে আড়াল করা গেলেও আঞ্চলিক বৈষম্য দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল এবং আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধির কারণেই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পতন ঘটল ১৯৭১-এ; প্রতিষ্ঠার মাত্র ২৪ বছরের ভেতরই। প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল ভয়াবহ এক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে; পতন ঘটল তার চেয়েও ভয়ংকর এক গণহত্যার পথ ধরে। সাতচল্লিশের দাঙ্গায় বাঙালিদের চাইতেও অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন পাঞ্জাবের মানুষ। সেই পাঞ্জাবি পরিচয়ধারী হানাদার সৈন্যরাই একাত্তরে গণহত্যা ঘটাল পূর্ববঙ্গে এসে। সবই ঘটেছে কর্তাদের ইচ্ছায়। কর্তারা নিজেদের স্বার্থ দেখেছেন; জনগণের স্বার্থ দেখেননি। কে মরল, কে বাঁচল– তাদের কিছু আসে যায়নি। উদারনীতিকরা বলেন, বলতে ভালোবাসেন, পাকিস্তানের পতনের জন্য দায়ী হচ্ছে গণতন্ত্রহীনতা। তাদের মতে, রাষ্ট্রের শাসকেরা এমনই স্বার্থান্ধ ছিল, তারা গণতন্ত্র দেয়নি। দিলে পাকিস্তানের এমন দুর্দশা ঘটত না। টিকে থাকত। কথাটা রাজনীতিকরাও কেউ কেউ বলেছেন; বলেছেন ‘দেশপ্রেমিক’ বুদ্ধিজীবীরাও। সোহরাওয়ার্দী তো সবসময়েই বলতেন– গণতন্ত্র দাও, নইলে পাকিস্তান টিকবে না। হয়রান হয়ে, ভগ্নহৃদয়ে তিনি অকালেই চলে গেলেন। বিমানবাহিনীর প্রধান (অবসরপ্রাপ্ত) আসগর খানের ছিল ওই একই কথা। পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক আবদুস সালাম সবসময়েই গণতন্ত্রকে সুযোগ দেবার কথা বলতেন এবং দুঃখ করতেন গণতন্ত্র চালু হচ্ছে না দেখে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জি ডব্লিউ চৌধুরী বই লিখেছেন ‘দি লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান’ নামে। তাঁরও একই উপলব্ধি; গণতন্ত্রহীনতাই হচ্ছে পাকিস্তানের পতনের জন্য দায়ী। তাদের জন্য গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত ছিল নিয়মিত ও গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন। তা নির্বাচনকে শাসক শ্রেণি যে ভয় পেত, সেটা ঠিক। ১৯৫৪তে পূর্ববঙ্গে নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় তারা দেখেছেন এবং মনে করেছেন, ওটি আসলে ছদ্মবেশী কমিউনিস্টদেরই জয়। পাকিস্তানজুড়ে নির্বাচন দিলে কমিউনিস্টরা না হোক, বামপন্থিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে– এ আশঙ্কা তাদের ছিল। ২২ বছর ধরে তারা তাই নির্বাচন ঠেকিয়ে রেখেছিল। নিরুপায় হয়ে ৭০ সালে যখন নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো তখন সেই নির্বাচনের ফলকে নাকচ করে দেবার জন্য যত প্রকার সমরাস্ত্র জোগাড় করতে পেরেছে সব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কাদের ওপর? না; যারা ভোট দিয়েছিল তাদের ওপরেই। শাস্তি দেবে– কেন ঠিকমতো ভোট দেয়নি। তা ছাড়া নির্বাচন মানেই যে গণতন্ত্র, তাও তো নয়। গণতন্ত্রের মূল শর্ত হচ্ছে অধিকার ও সুযোগের সাম্য এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে গণতন্ত্রের এ দুই শর্ত পূরণ তো দূরের কথা, বুর্জোয়া ধরনের নির্বাচনে আস্থা রাখাটাই যে সম্ভব ছিল না– তা তো প্রমাণিত। পাকিস্তান ছিল একটি বৈষম্যমূলক এককেন্দ্রিক অস্বাভাবিক রাষ্ট্র এবং স্বৈরাচারী। সেখানে নাগরিকদের সমান অধিকার এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ মোটেই সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য জনসম্মতি আদায়ের বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই কার্যকর হয়নি। মূল কারণ রাষ্ট্রটি ছিল অস্বাভাবিক ও অবাস্তবিক। পঙ্গু, বিকলাঙ্গ হিসেবেই তার জন্ম। তাই দেখি শাসকগোষ্ঠী, যারা হয় নিজেরাই আমলা, নয়তো আমলাতান্ত্রিক মনোভাবসম্পন্ন, তারা সবাই এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছেন যেগুলো চরিত্রগতভাবেই অগণতান্ত্রিক ও অকার্যকর। যেমন এক ইউনিট প্রবর্তন। এক ইউনিটের অর্থ হলো পশ্চিমের তিনটি স্বতন্ত্র জাতি অর্থাৎ সিন্ধি, বেলুচ ও পাঠানদের ওপর পাঞ্জাবিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। তারপর এলো সংখ্যাসাম্য। পূর্বাঞ্চলের ৫৬ জনকে কেটেছেঁটে সমান করে দেওয়া হলো পশ্চিমের ৪৪ জনের সঙ্গে। এমনটি কি কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে করা সম্ভব? সামরিক বাহিনীকে ক্রমাগত শক্তিশালী করা হতে থাকল। পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বেসামরিক আমলাতন্ত্রও নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে লাগল। সুবিধা দেওয়া হলো ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের। ভাবটা ছিল এই রকম, সুবিধাপ্রাপ্তদের উন্নতির অর্থই দাঁড়াবে সমগ্র দেশের উন্নতি। উন্নতি ওপর থেকে নিচে নামবে। পুঁজিবাদী উন্নতিতে যেটা কখনোই ঘটে না; ঘটা সম্ভব নয়। উন্নতি তরতরিয়ে খাড়াখাড়ি উঠে গেল ওপরের দিকে। ফলে ধনী-দরিদ্র এবং পশ্চিম-পূর্বে বৈষম্য বৃদ্ধির সুবিধা হলো। গৃহীত পদক্ষেপগুলো পাকিস্তানকে শক্তিশালী করেনি; উল্টো দুর্বলই করেছে। চূড়ান্তে বাঙালি বিদ্বেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভেঙে খানখান হয়ে গেল পাকিস্তান রাষ্ট্র।
Slider
দেশ
মেহেরপুর জেলা খবর
মেহেরপুর সদর উপজেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
যাবতীয়
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Home
»
»Unlabelled
» লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তানের অস্বাভাবিক উত্থান পরবর্তী অনিবার্য পতন
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News
No comments: