জঙ্গলে হিরার সম্ভার, তুলতে প্রাণ যাবে ২ লাখ গাছের
গাছ বাঁচাতে নিজের জীবনের কথা ভাবেননি সুন্দরলাল বহুগুণা। গাছকে জড়িয়ে থেকে গাছের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তিনি এবং তার অনুগামীরা। ভারতের উত্তরাখণ্ডের সেই আন্দোলন নজর কেড়েছিল সারা বিশ্বের। ১৯৭৩ সালের এই আন্দোলন ‘চিপকো আন্দোলন’ নামে পরিচিত।
ফের আরও একবার গাছ বাঁচানোর আন্দোলন দেখছে সারা ভারত। গত ১৭ বছর ধরে মধ্যপ্রদেশে জঙ্গল বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পরিবেশপ্রেমী এবং সেই অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারা। সম্প্রতি হিরা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রদেশের ছতরপুর জেলা খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে।
শিরোনামে উঠে আসার কারণ কী? সেখানে বসবাসকারী মানুষগুলো, বন সংরক্ষণ নিয়ে লড়াই করা বিভিন্ন সমাজকর্মী এবং সংস্থা প্রাণপন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এর বিরোধিতা করে। লড়াই চলছে সেখানে বসবাসকারী মানুষ এবং জঙ্গলের অন্তত দুই লাখ গাছের প্রাণ বাঁচানোর জন্য।
কবে এই এলাকায় হিরার সন্ধান পাওয়া গেল? কারা সেই খোঁজ নিয়ে এলেন? এর সঙ্গে রাজনীতির যোগ কীভাবে রয়েছে এবং কেনই বা হিরা উত্তোলন শুরু হলে বাসিন্দাদের প্রাণ সংশয় হতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ১৭ বছর পিছিয়ে যেতে হবে।
এই বিবাদের সূত্রপাত ২০০৪ সাল থেকে। আন্দোলনকারীদের মতে বিভিন্ন সময়ে এর সঙ্গে বিজেপি এবং কংগ্রেস- এই দুই রাজনৈতিক দলই যুক্ত রয়েছে। আন্দোলনকারীরা এই দুই রাজনৈতিক দলের উপরই সমান দোষারোপ করে থাকেন।
দিল্লি থেকে ৬৫০ কিলোমিটার দূরে মধ্যপ্রদেশের ছতরপুর জেলায় বক্সওয়াহা জঙ্গল রয়েছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এখানে মোট জনসংখ্যা ১০ হাজার। হিরা উত্তোলন নিয়ে এই বিবাদ শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে।
রিও-টিন্টো নামে একটি অ্যাংলো-অস্ট্রেলিয়ান সংস্থা এই অঞ্চলের নিচে প্রথম হিরার খোঁজ পায়। ২০১০ সালে মধ্যপ্রদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় সংস্থাটি। হিরা উত্তোলন করে যা লাভ হবে তার ১০ শতাংশ নেবে মধ্যপ্রদেশ সরকার এবং বাকি ৯০ শতাংশ ওই সংস্থা, চুক্তি ছিল এমনই।
এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় বান্দর প্রকল্প। ওই এলাকায় প্রচুর পরিমাণ বাঁনর থাকার জন্যই এমন নামকরণ। সংস্থার অনুমান ছিল, এখান থেকে অন্তত পৌনে ৩ লাখ ক্যারাট হিরা পাওয়া যাবে।
জঙ্গলের ৯৭১ হেক্টর জমিতে এই হিরার সন্ধান পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ৯৫৪ হেক্টর জমিতে হিরা উত্তোলনের সবুজ সংকেত পেয়েছিল সংস্থাটি। তা করতে গেলে অন্তত ৫ লাখ গাছ কাটা পড়ত।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ছিল, বক্সওয়াহার জঙ্গলের কাছেই রয়েছে পান্না জাতীয় উদ্যান। যা বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্যও পরিচিত। আর হিরা উত্তোলনের ওই অংশ বাঘদের করিডর। এত পরিমাণ গাছ কাটা হলে তার ব্যাপক প্রভাব জীববৈচিত্রের উপর পড়বে বলে সতর্ক করেছিলেন পরিবেশবিদরা।
পান্না জাতীয় উদ্যানের প্রাণ হল কেন নদী। এই নদীতে প্রচুর ঘড়িয়াল পাওয়া যায়। ফলে সমস্ত দিক থেকেই জীব বৈচিত্রে ভরপুর এই বক্সওয়াহা। ৫ লাখ গাছ কাটা হলে তার প্রভাব ভয়াবহ হতো।
শুধু গাছ কাটার ফলেই ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয় ছিল না। আরও একটি বিষয় আন্দোলনকারীদের ভাবিয়ে তুলেছিল। এই অঞ্চল খরাপ্রবণও। হিরার খনির জন্য প্রচুর পরিমাণ জলেরও প্রয়োজন পড়বে। এই বিপুল পরিমাণ জল যদি হিরার কাজে লাগানো হয় তা হলে তার প্রভাবও জঙ্গলের জীব এবং আশাপাশের মানুষের উপর পড়বে।
২০১১ সালে কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস সরকার। সমাজসেবী শেহলা মাসুদ তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন। এ নিয়ে মামলাও হয়। একই সঙ্গে জঙ্গল বাঁচানোর জন্য তুমুল আন্দোলন চলতে থাকে ওই এলাকায়। যাতে যোগ দেন স্থানীয়রাও। সমাজকর্মী শেহলা এ সংক্রান্ত তথ্য জানতে আরটিআইও করেছিলেন।
২০১১ সালের ১৬ অগস্ট শেহলা আরটিআই-এর তথ্য সংগ্রহ করতে যাওয়ার পথে খুন হয়ে যান। যদিও পরবর্তীকালে জানা যায় যে, শেহলার খুনের সঙ্গে এর কোনও যোগসূত্র নেই। তা সত্ত্বেও শেহলার মৃত্যু অনেক প্রশ্ন রেখে গিয়েছে।
শেহলার মৃত্যুর সঙ্গে এই আন্দোলন আরও বড় আকার ধারণ করে। স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন সমাজসেবী সংস্থা এই আন্দোলনে যোগ দেয়। ২০১৬ সালে ফরেস্ট অ্যাডভাইসরি কমিটি ঘোষণা করে, এই অঞ্চলে হিরা উত্তোলন করা যাবে না কারণ পাশাপাশি দুই জঙ্গলের করিডর এটি। ফলে এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে প্রবেশ করার জন্য বন্যপ্রাণীদের এটিই সবচেয়ে ব্যস্ত রাস্তা।
ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটিও একই রিপোর্ট দেয়। সব দিক খতিয়ে দেখে শেষে মধ্যপ্রদেশ সরকার পিছিয়ে আসে। রিও-টিন্টো সংস্থাকে দেওয়া অনুমতি নাকচ করে দেয়। সে সময় মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় ছিলেন বিজেপি সমর্থিত শিবরাজ সিংহ চৌহান।
রিও-টিন্টো সংস্থা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল, যাতে অন্তত কিছু অংশে হিরা উত্তোলনের অনুমতি পাওয়া যায়। পরে মাত্র ৭৬ হেক্টর জমির উপর হিরে উত্তোলনের কথাবার্তাও চলেছিল। কিন্তু সেটিও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে পিছিয়ে এসেছিল মধ্যপ্রদেশ সরকার।
আর কথা বাড়ায়নি সংস্থাটি। ২০১৭ সালে পুরোপুরি হাল ছেড়ে দেয় তারা। এই চুক্তি পুরোপুরি বাতিল করে দেয়। এখানেই আন্দোলনকারীদের জয় হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। রাজনীতির পাশা বদলে যেতেই ফের আরও এক বার জঙ্গল কেটে সাফ করার দামামা বেজে ওঠে।
২০১৮ সালে মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হন কমল নাথ। এই প্রকল্পকে পুনরায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। প্রকল্পের আনুমানিক খরচ নির্ধারিত হয় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এর থেকে আনুমানিক ৫৫ হাজার কোটি টাকা উপার্জন হওয়ার সম্ভাবনা দাঁড়ায়।
এর জন্য টেন্ডার ডাকে মধ্যপ্রদেশ সরকার। আদিত্য বিড়লা গ্রুপ, আদানি গ্রুপ, বেদান্ত গ্রুপ তাতে অংশ নেয়। টেন্ডার পায় আদিত্য বিড়লা গ্রুপ। ৫০ বছরের লিজে ৩৬৪ হেক্টর জমি তাদের দেয় সরকার। নতুন চুক্তি অনুসারে, যে পরিমাণ লাভ হবে তার ৫৮ শতাংশ পাবে আদিত্য বিড়লা গ্রুপ এবং বাকি ৪২ শতাংশ আসবে মধ্যপ্রদেশ সরকারের কোষাগারে।
সরকারের পক্ষে স্থানীয় মানুষকে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বটে। কিন্তু খনি শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে রাজি হননি কেউই। এই অরণ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। তার সম্পদ সবার জন্যই জীবনদায়ী। স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায় এই জঙ্গলের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া। সেখানে সরকার পানীয় জলেরও বেসরকারিকরণ করে দিয়েছিল। যার ফলে পানীয় জলের দাম এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে সেখানে ‘ওয়াটার ওয়ার’ হয়। মধ্যপ্রদেশের ওই অঞ্চল এমনিতেই খরাপ্রবণ এলাকা। এই প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ জলের প্রয়োজন হলে জলসঙ্কট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভবিষ্যতে বলিভিয়ার মতো পরিস্থিতি এখানেও তৈরি হতে পারে।
আন্দোলন এখনও চলছে। তাই হিরা উত্তোলন শুরু করা যায়নি। কিন্তু আদৌ কি হিরার চাহিদা মেটানোর জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করার প্রয়োজন রয়েছে? কারণ, হিরা কার্বনের একটি রূপভেদ। কার্বনের সাহায্যে পরীক্ষাগারেও একই গুণমানের হিরা তৈরি করা সম্ভব বলে দাবি করেছে বিভিন্ন সংস্থা।
অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় এবং মধ্যপ্রদেশ- ভারতের এই তিন রাজ্যেই হিরা উত্তোলন হয়। যার মধ্যে দেশেটির ৯০ শতাংশ হিরা মধ্যপ্রদেশ থেকেই সরবরাহ হয়। সেই সরবরাহ শতাংশে মধ্যপ্রদেশ আরও এক ধাপ এগোবে কি না তা নির্ভর করে রয়েছে বক্সওয়াহা জঙ্গলের উপর।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা।
Tag: English News Featured world
No comments: