মেহেরপুরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখায় মেহেরপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমী উদ্যোগে ৫ গুণী শিল্পিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। সংবর্ধিত শিল্পিরা হলেন,যাত্রায় আব্দুল গনি, নাটকে প্রফেসর একেএম শামিম, সঙ্গীতে রতন সরকার, কবিতা আবৃতিতে কামরুল হাসান খান হিরক এবং সাহিত্যে নাসির উদ্দিন মিরু। শনিবার বিকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ঢাকা’র সহযোগীতায় মেহেরপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক মাহমুদ হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন,মেহেরপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক অ্যাড. মিয়াজান আলী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আলমগীর হোসেন, আওয়ামীলীগের সহসভাপতি আলহাজ্ব আশকার আলী, সংবর্ধিত শিল্পি আব্দুল গনি, প্রফেসর একেএম শামিম, রতন সরকার, কবিতা আবৃতিতে কামরুল হাসান খান হিরক । বক্তব্য রাখেন জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাধারন সম্পাদক সাইদুর রহমান, প্রশিক্ষক শামিম জাহাঙ্গীর সেন্টু। প্রশংসা পত্র পাঠ করেন মেহেরপুর সরকারী কলেজের সহকারী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল আমিন। অনুষ্ঠানে ৫ গুনী শিল্পিকে ক্রেষ্ট,সনদপত্র ও আর্থিকভাবে পুরুষ্কৃত করা হয়। পরে সম্মাননা স্মারকপত্র পান্থজনের সখা’র মোড়ক উন্মোচন করা হয়। আব্দুল গণি: ‘মা মাটি মানুষে’র আপন জন ABDUL GONIযাত্রাশিল্পকে উঁচুমানের লোকশিল্পে পরিণত করতে এ অঞ্চলে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে যাত্রাভিনেতা, নির্দেশক আব্দুল গণি অন্যতম। শৈশব থেকেই তার কাছে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত বিশেষত যাত্রা হয়ে উঠে স্বপ্ন-কল্পনা, ধ্যানজ্ঞান এবং জীবনচর্যার অবিভাজ্য অংশ। যাত্রা শিল্পের রূপ-রসে সমার্পিত এই প্রতিভাবান শিল্পীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি অবিভক্ত নদীয়ার তেহট্ট থানার হরিপুর গ্রামে। তার পিতা প্রয়াত জাহান বিশ্বাস ছিলেন তেহট্ট থানার সিটকা ইউনিয়ন কাউন্সিলের পাঁচ বারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং শিল্প সঙ্গীত অনুরাগী। পিতার একমাত্র পুত্র আব্দুল গণি বেড়ে ওঠেন সচ্ছল, উদার সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে। তার পিতৃব্য আজাদ আলী বিশ্বাস অগ্রগন্য মরমী সাধক ও খ্যাতিমান পদ রচয়িতা হিসেবে স্বীকৃত ও সমাদৃত। ১৯৫০ সালে তাঁর পরিবার পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস ছেড়ে মেহেরপুরের গাংনী থানার সাহারবাটী গ্রামে চলে আসে। আব্দুল গণি প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশুনা করেন সাহারবাটী গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে মেহেরপুর গভ. হাই স্কুলে। যাত্রা থিয়েটারের প্রতি প্রবল ঝোঁক আর ব্যক্তিগত অনাগ্রহের কারণে মাধ্যমিক পর্যায়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পরিসমাপ্তি ঘটে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে প্রয়াত আহাদ আলী বিশ্বাস ও শহীদ এমলাক হোসেন মাস্টারের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় শিল্প সংস্কৃতি-যাত্রা-থিয়েটার সহ সব ধরনের মননশীল কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বন্ধুদের সাথে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন সাহারবাটী ইয়ুথ ক্লাব ও পাবলিক লাইব্রেরী। ১৯৬১ সালে ক্লাব এই সমাজ সেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন প্রাপ্ত হয়। এই ক্লাবকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক বিশাল সাংস্কৃতিক বলয় আর এ বলয়ের মধ্যমণি ছিলেন আব্দুল গণি। তার সকল শুভকর্ম ও সৃষ্টিশীল উদযোগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাকে সহযোগিতা করেছেন আক্কাস আলী, আব্দুল মতিন, আব্দুল মজিদ, প্রয়াত মওলা বকশো, প্রয়াত ফরিদ উদ্দীন, প্রয়াত অনীল কর্মকার, সন্তোষ কুমার সান্তারা, আব্দুস সাত্তার, রফিকুল ইসলাম, প্রয়াত ওয়াজেদ আলী,গোলাম গাউস, কবির হোসেন, আলী হোসেন,নজরুল ইসলাম, বশিরউদ্দিন চুন্নু প্রমুখের মত নিষ্ঠাবান অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। আব্দুল গণি কৈশোর থেকেই সাহিত্যপ্রেমী, সংস্কৃতিমনস্ক, যাত্রামোদী। ক্লাসের পড়াশুনার চেয়ে যাত্রাপালার সংলাপ আর অর্কেস্ট্রা দলের সুরের মুর্ছনা তাকে বিহবল ও আলোড়িত করতো বেশি। যেখানেই যাত্রার আসর, সেখানেই তিনি সদলবলে হাজির হতেন। বিনোদনের জন্য নয়, সবার কাছ থেকে শেখার বা নেয়ার জন্য যেতেন। তিনি যে পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেন। সেখানে শিল্প সঙ্গীত সাহিত্যের অনুরাগী ছিল। কিন্তু তা জানা বোঝার মত তেমন কেউ ছিল। তাই অভিনয় শেখার জন্য কখনও হাজির হয়েছেন মফিজুর রহমান এর কাছে; কখনও দারিয়াপুরের হাজী ইদ্রিসের কাছে। মেহেরপুরের নাট্য ভুবনের এই দুই পুরোধা পুরুষের কাছেই তিনি গ্রহণ করেন অভিনয়ের প্রথম পাঠ। তিনি পেশাদার অভিনেতা ছিলেন না। তথাপি চারদশক ধরে বিভিন্ন মঞ্চে শতাধিক যাত্রাপালায় সুনাম ও সাফল্যের সাথে অভিনয় করেছেন, সেসাথে নির্দেশনা দিয়েছেন। ১৯৭৮ সালে আমঝুপিতে অনুষ্ঠিত জেলা ব্যাপী যাত্রা প্রতিযোগিতায় ‘যে আগুন জ্বলছে’ পালার জন্য তার দল ‘নবকল্লোল অপেরা’ প্রথম স্থান অধিকার করে এবং তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে মনোনীত হন। ‘দস্যু মোহন’, ‘সোহরাব রুস্তম’, ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’ ‘মা মাটি মানুষ’, ‘মরণের’ পরে, সাত টাকার সন্তান, সতী না অসতী, পালায় অভিনয় করে ও নির্দেশনা দিয়ে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। দর্শককে অভিনয় শৈলী দিয়ে সম্মোহিত করার অলৌকিক ক্ষমতা তার ছিল আর এর জন্য গর্ব অনুভবও করেন তিনি। বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলায় বিভিন্ন আসরে তিনি অভিনয় করেছেন, তবে কুষ্টিয়া উজান গ্রামের প্যান্ডেলে সাত রাত (১৯৭২), বৃত্তিপাড়ায় পাঁচরাত (১৯৭২), আলমডাঙ্গায় সাত রাত (১৯৭৪), দামুড়হুদার ছুটিপুরের পাঁচ রাত (১৯৭৮) পালায় অভিনয় করতে পারা তার জীবনের অনন্য স্মৃতি। জীবন জীবিকার তাগিদে নানা পেশায় তিনি যুক্ত হয়েছেন, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রয়োজনে নানা মানুষের মিশেছেন। কিন্তু যাত্রা তাকে বারবার টেনে এনেছে আলোক-উজ্জ্বল রঙ্গমঞ্চে। যাত্রাকে তিনি তার জীবনের অবিভাজ্য অংশ বলে মনে করেন। যাত্রা শিল্পের সোনালী অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি আজও খোঁজেন জীবনের অর্থময়তা, সান্তৃনার ¯িœগ্ধ প্রলেপ। অভিনয় জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা দিয়ে তিনি জীবনের হিসাব মেলাবার চেষ্টা করেন। তিনি মনে করেন, যাত্রা কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয় এর সাহিত্য ও শিল্প মূল্যও রয়েছে। এই নন্দিত মঞ্চ অভিনেতা দর্শকের দায় মেটানোর সাথে সাথে মা, মাটি, মানুষের দায়ও মিটিয়েছেন ইতিহাসের প্রয়োজনে। প্রথম যৌবন থেকেই তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির একজন একনিষ্ঠ কর্মী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি পলিটিক্যাল মোটিভেটর হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে সংগঠিত করার কাজে ব্রতী হন। মুক্তিযুদ্ধোত্তোর কালে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার পুনর্গঠনে কাজ করেন পদ-পদবী ছাড়াই। ১৯৮৪, ১৯৮৯, ১৯৯৬ সালে তিনি সাহারবাটী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জেলার শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবে লাভ করেন ¯^র্ণপদক। তাঁর উদযোগে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় কাজলা ব্রিজ নির্মিত হয়। সাহারবাটী দক্ষিণপাড়া রেজি. প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাহারবাটী এবাদত খানা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, এবাদত খানা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অসামান্য। সত্তর-উর্ধ্ব এই কৃতী অভিনেতা সফল চেয়ারম্যান আজও হাস্যোজ্জল, প্রাণবন্ত, সদালাপী এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। রোগ-শোক, পরাভব-গ্লানি কোন কিছুই তাকে জীবনের ধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি। উত্থান-পতন, পরিবর্তন পালাবদল তার শরীরকে ন্যুব্জ করতে পারলেও আত্মার শক্তি ও মনের উচ্ছাসকে গ্রাস করতে পারেনি। তাই এই মঞ্চ সারথি আজো যাত্রাশিল্পের গৌরব পুর্ননির্মাণের কথা ভাবেন, তেমনি ভাবেন প্রিয় স্বদেশের কথা, মা, মাটি মানুষের কথা। রতন সরকার : গানে গানে গেঁথে বেড়াই Roton Sorkarযন্ত্রশিল্পী, সঙ্গীত সাধক রতন সরকারের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৫- মে মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলাধীন নিত্যানন্দপুর খ্রিস্টান পল্লীতে। তার পিতা শৈলেন সরকার ছিলেন পেশাদার যন্ত্রশিল্পী। রতন সরকারের পুর্ব পুরুষদের মধ্যে শরৎ সরকার, বসন্ত সরকার, গোপাল সরকার, দাউদ সরকার, শীতল সরকার, দিলীপ সরকার, থমাস সরকার ছিলেন যন্ত্রশিল্পী ও কীর্তনীয়া। শৈশব থেকেই গান বাজনায় প্রবল অনুরাগী ছিলেন রতন সরকার। বাবা শৈলেন সরকার ও শিক্ষক গোলাম আ¤ি^য়ার অনুপ্রেরণায় তিনি সঙ্গীত জগতে পদার্পন করেন। তিনি আড়বাঁশি শেখেন পাকুড়িয়ার কাদের বিশ্বাস, ফ্লইট ঝিনাইদহের নুরু মাস্টার, কর্ণেট শেখেন হযরত মিয়ার নিকট। এছাড়াও আলম মাস্টার, জুয়েল মল্লিক, যুগল বাবুর কাছ থেকে সঙ্গীত ও যন্ত্রানুষঙ্গের তালিম নেন। অভাব-অনটনের আর পিতার অকাল মৃত্যুর কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর জীবন-জীবিকার তাগিদে কাকাদের সাথে ক্ষেতে খামারের কাছে লেগে যান। রতন সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পান অভাব-অনটন। কিন্তু তার রক্তে ছিল গান আর তাই গান কেই করে নেন একেলা পথের সঙ্গী, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। গানের ভেতরে খুঁজে পান দুঃখ জয়ের দূর্জয় সাহস আর বেঁচে থাকার অফুরন্ত প্রাণশক্তি। এ প্রাণশক্তিতে বলীয়ান হয়ে তিনি পথ চলেন। গানই তার ধ্যান-জ্ঞান; জীবন-জীবিকা। গানকে সাথে নিয়ে তিনি পথ চলেন আঁধার রাতে। গান থেকেই পান আত্মার খোরাক। জগৎ জীবন সম্পর্কিত রহস্যের জবাব। কৈশোরে জীবিকার তাগিদে তিনি বাদ্যকার হিসেবে যাত্রাদলে যোগ দেন। পালা ও দলের প্রয়োজনে কখনও ঢোল-খোল-করতাল, কখনও হারমোনিয়াম, আঁড়বাশি, ফ্লুট-কর্ণেট বাজাতে হয়েছে তাকে। চার দশক ধরে তিনি যাত্রাদলের বাদ্যকার হিসেবে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। এখন বয়সের ভারে রাত জাগতে পারে না আর। শরীরেও কুলোয় না। তাই যাত্রা দলের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন কয়েক বছর আগে। তবু আলোক উজ্জ¦ল রঙ্গমঞ্চের সুখকর স্মৃতি তাকে আনন্দ দেয়, সতেজ করে রাখে। সাহারবাটী, পিরোজপুর, আমঝুপি, দারিয়াপুর, আসমান খালি, কুমারখালি, খোকসা, যশোর কালীগঞ্জে অনুষ্ঠিত যাত্রার বড় আসরে মিউজিক পার্টিতে কাজ করে যে যশ-খ্যাতি পেরেছেন তা কোনদিন ভুলবেন না। যাত্রা, কীর্তনের পথ ধরেই তার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে প্রবেশ ও লোকপ্রিয়তা- নির্দ্বিধায় স্বীকার করলেন এই পেশাদার সঙ্গীত সাধক। এক সময়ের পেশাদার যন্ত্রশিল্পী এখন সঙ্গীত প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন নানা প্রতিষ্ঠানে। নিত্যানন্দপুর মিশনস্কুল, মেহেরপুর মিশন, কার্পাসডাঙ্গা মিশন, ভবরপাড়া মিশনে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন এই সঙ্গীত সাধক। ইতোপূর্বে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গীত বিদ্যালয়, গাংনী সন্ধানী স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষার্থীদের গান শিখিয়েছেন। কোন রকম সম্মানী ছাড়াই গাংনী শিল্পকলা একাডেমীতে সঙ্গীত প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করে চলেছেন। কোন ¯^ীকৃতি বা সম্মাননা কপালে জোটেনি এই শ্রমী সঙ্গীত সাধকের। এতে তার ক্ষোভ দুঃখ নেই। গান গেয়ে বা শিখিয়ে তার আনন্দ। চার্চ, আসর, প্রার্থনা সভা, সবখানে গানকেই বেছে নেন আত্মনিবেদনের অবল¤^ন হিসেবে। গানের ঝরনা তলায় কবে যে, তিনি জ্ঞান করেছেন তা নিজেই জানেন না। তবু জীবন সায়হ্নে দাঁড়িয়ে ‘গানে গানে গেঁথে’ বেরান ‘প্রাণের কান্না হাসি’। PROFESSIOR SAMIMশামীম: যে ধ্রুবপদ দিয়াছ বাঁধি বহুমাত্রিক গুণে গুণান্বিত নাট্যাভিনেতা প্রফেসর এ.কে.এম. শামীমের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১০ অক্টোবর মেহেরপুরের আমঝুপি গ্রামে এক সচ্ছল পরিবারে। প্রয়াত ডা. তেছের আলী ও সুন্নতুন্নেছা তার পিতা-মাতার নাম। শামীম মেহেরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে, রাজনীতি তেজুড়িয়ে পড়ার কারণে বাবা তাকে মেহেরপুর ফিরিয়ে আনেন। মেহেরপুর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাস করার পর চুয়াডাঙ্গা কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন পদার্থ বিজ্ঞানে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী। শিক্ষাজীবন শেষে শামীম প্রথমে আমঝুপী উচ্চ বিদ্যালয়ে পরে মেহেরপুর কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ, গোপালগঞ্জ-সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে বিভিন্ন মেয়াদে শিক্ষকতা করে অবসর যাপন করছেন। শামীম বেড়ে ওঠেন এক শিক্ষক ও উদার সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক পরিমন্ডলে। তার অগ্রহ শামসুল হুদা প্রশাসন ক্যাডারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। ডাঃ মোজাহারুল খ্যাতিমান চিকিৎসক; অনুজ সাঈদুর রহমান কলেজের অধ্যাপক। তার সব ভাই ছিলেন একাধারে কৃতী ছাত্র, অভিনেতা, আবৃত্তিকার ও সংস্কৃতি সংগঠক। অগ্রজ শামসুল হুদা ও অভিনেতা লুৎফর রহমানের অনুপ্রেরণায় নাটকের বৈভব মন্ডিত ভুবনে তার প্রবেশ। অগ্রহ শামসুল হুদা ও ডা. মোজাহারুল হান্নানের সঙ্গে টিপু সুলতান নাটকে ময়েজউদ্দীনের চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করেন নাটকের প্রথম পাঠ। আমঝুপি পাবলিক ক্লাবে মঞ্চায়িত অজ¯্র নাটকে তিনি অগ্রজ শামসুল হুদা ও চাচা আজিজুল হকের সঙ্গে শিশু চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়ন কালে অভিনয়, লেখালেখি, আবৃত্তি সহ বিভিন্ন সংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশ নেন। এ সুবাদে তিনি শহীদ আনোয়ার পাশার সাহচর্য লাভ করেন। কলেজ জীবনে আবু হেনা মোস্তফা কামালের সান্নিধ্য পেয়েও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এ সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে এমনভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন যে তিনি বিজ্ঞান শিক্ষার মূল ¯্রােত থেকে খানিকটা পিছিয়ে পড়েন। উচ্চ মাধ্যমিকে ফলাফল বিপর্যয়ের কারণে বাবা তাকে মেহেরপুরে ফিরিয়ে এসে মেহেরপুর কলেজে ভর্তি করে দেন। এখানে এসেও লেখাপড়ার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য, অভিনয়ে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। প্রসেফর আনসার উল হক, প্রফেসর মঞ্জুর হোসেন এর সহযোগিতায় তিনি সতীর্থদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ মুখস্ত করেন। মেহেরপুর কলেজে এক বছর পড়ার পর চুয়াডাঙ্গা কলেজে ভর্তি হয়েছে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি ছাত্র নেতা হিসেবে ছাত্রদের এবং আমঝুপিতে কৃষক সমিতির সদস্য হিসেবে কৃষকদের সংগঠিত করেছেন। সেই তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ উত্তাল দিনেও তিনি নাটক ছাড়েননি। দিনের সব কাজ সেরে রাতে ক্লাবে নাটকের মহড়ায় অংশ নিয়েছেন মঞ্চে উঠেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। এ সময় কালেও তিনি সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হয়েও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রতি সমর্থন প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আমঝুপি ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদে আহবায়ক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তিনি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং আমঝুপি নীটকুঠিতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প গড়ে তোলেন। তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দীন, আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল মান্নান, হাজী নির্দেশে বেতাই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের কাজ করেন। এজন্য তিনি ক্যাম্প থেকে ২০০/- টাকা করে মাসিক ভাতা পেতেন। যুদ্ধের সময় বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সনদ বা স্বীকৃতি পাননি। তার পরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আজও অবিচল রয়েছেন। তার স্বপ্ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বাংলাদেশ একটি শোষণহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠুক। তিনি শুধু অভিনেতা,আবৃত্তিকার, নাট্যকার নন, তিনি একজন দক্ষ সংগঠক। তার উদযোগ ও নির্দেশনায় মেহেরপুর সরকারি কলেজ শওকত ওসমানের ক্রীতদানের হাসি’ ও কল্যাণমিত্রের সাগর সেচামানিক’ মঞ্চস্থ হয়। এ নাটকের কুশীলররা ছিলেন সকলেই কলেজের ছাত্র ছাত্রী। কলেজ শিক্ষকতার পাশাপাশি যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে তিনি কাজ করেছেন। যাত্রার মিউজিক ঠিক রেখে নাটকের কর্মে বিরুপে যাত্রা দাঁড় করাতে উদ্যোগ নেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই সফল হন। যাত্রার মান উন্নয়নে ১৯৭৮ সালে আমঝুপি ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি যে প্রতিযোগিতা আয়োজন করেন তা মেহেরপুর জেলার যাত্রার ইতিহাসের স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৪ টি দলের সমš^য়ে কুষ্টিয়া জেলা ব্যাপী যাত্রা প্রতিযোগিতা সাফল্যের সাথে অনুষ্ঠিত হয় আমঝুপিতে। সফল আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী তাকে আভিনন্দন জানায়। প্রাপ্তি অপ্রান্তির কোন হিসেব নিকাশ করেন না বহুমাত্রিক প্রতিভার ধিকারী এই জনপ্রিয় নাট্যজন শিক্ষক, জীবনে যা পেয়েছেন তা তার কাছে অতুলনীয়। প্রথম যৌবনের গানে যে ধ্রুবপদ বেঁধে নিয়েছেন, তা দিয়ে শেষ করতে চান জীবনের আনন্দ যাত্রা। তবে যাত্রা শেষ করার আগে দেখে যেতে চান সৃষ্টিশীল, শিল্প সংস্কৃতিক আলোকিত বাংলাদেশ। নাসির উদ্দীন মীরু: আলোর পথের যাত্রী Nashir.মানবমুক্তির নহবত শুনে যে জীবনের যাত্রা সে জীবনকে আরো বর্ণাঢ্য ও আলোকিত করে তুলেছিলেন নাসির উদ্দীন মীরু শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্য জগতে পদচারণার মধ্য দিকে। ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথের জন্ম শত বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে সাংগঠনিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ, স্কুলে দেয়ালিকা প্রকাশ, অমর একুশে স্মরকপত্র ও কবিতাপত্র বের করার মধ্য দিয়ে তার সংস্কৃতি জগতে প্রবেশ। এরপর পাঁচ দশক ধরে শিল্প সাহিত্য সাংবাদিকতা রাজনীতির নানাদিক নিয়ে নানা ধরনের কাজ করে চলেছেন। নাসির উদ্দীনের জন্ম ১১ নভেম্বর ১৯৪৬ অবিভক্ত নদীয়ার করিমপুর থানার ফাজিলনগর গ্রামে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে তার পরিবার মেহেরপুর শহরে চলে আসে। তার পিতা নকিব উদ্দীন ছিলেন সচ্ছল কৃষক। নাসির উদ্দীন মেহেরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। মেহেরপুর কলেজ থেকে আই কম ও বিএ ডিগ্রী অর্জন করেন। বাল্য কৈশোর থেকেই নেতৃত্বের গুণাবলি তার ব্যক্তি চরিত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্রমশ বিকশিত হতে থাকে তার সাংগঠনিক দক্ষথা ও সৃজন বৈশিষ্ট্য। স্কুল-কলেজে ছাত্রাবস্থায় ‘সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাজে তিনি ছিলেন অগ্রণী। তাঁর পরিমিতিবোধ, দক্ষতা, শিল্পবোধ, চারিত্রিক, দৃঢ়তা তাকে আকর্ষনীয় ও উদাহরণ তুল্য সংগঠকে পরিণত করে। তিনি ১৯৬২ সালের ====== শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৪ সালে আব্দুল আওয়ালকে সভাপতি সিরাজুল ইসলাম কে সম্পাদক করে মেহেরপুর ছাত্র ইউনিয়নের যে কমিটি গঠিত হয় তাতে নাসির উদ্দীন ছিলেন মূল সংগঠন। এ সময় আবু বক্কর, আহমদ আলী, শাখাওয়াত মুন্সীরা, ভাষানী-ন্যাপ সংগঠিত করছেন। আর আওয়ামী লীগের দায়িত্বে আছেন এ্যাড. আবুল হায়াত, সহিউদ্দীন, মফিজুর রহমান প্রমুখ। ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও সক্রিয় থেকেছেন যুগপৎ। ষাটের দশকে তিনি উদার, প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে ‘মধুচক্র’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। সে সময় এ সংগঠনের উদযোগে অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্র-নজরুল, সুকান্ত জন্ম জয়ন্তী, মধুসূদন উৎসব সহ নানা সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়ে তিনি অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সনদ বা স্বীকৃতি চাননি তিনি। কারণ তার দৃষ্টিতে স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক দালালরা ছাড়া এদেশের সব মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের নৈতিক ===== পীড়িত ও ক্ষুদ করে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালেও তিনি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড থেকে সরে থাকেননি। মেহেরপুরে স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা তিনিই প্রথম প্রনয়ন করেন। নাসির উদ্দীন একজন আপদমস্তক রাজনীতি কর্মী। তবে রাজনীতিকে কখনও ক্ষমতা দখলের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেননি। ১৯৭৮ সালে অধ্যাপক আনসার উল হক, আলী ওবায়দুর রহমান মেরাজ কে নিয়ে তিনি মেহেরপুর থেকে সাপ্তাহিক প্রবাহ বের করতেন। ’৮০ দশকে পত্রিকার ওপর সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন নিষেধজ্ঞা আরোপ করলে, এটি বন্ধ হয়ে যায়। নাসির উদ্দীনের ব্যক্তি জীবন, সংস্কৃতি ভাবনা ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড এক সূত্রে গাঁথা। জীবনের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে তার বসবাস গ্রন্থপাঠ, বিশ্লেষণ ও সে আলোকে কিছু করার ভাবনা থেকে। এ সুযোগ পেয়েছিলেন সরকারি গণ গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করার সুবাদে এবং বিভিন্ন সংগঠনের দায়িত্ব পালনের সূত্রে। তিনি কুষ্টিয়া বসবাসের সময় রবীন্দ্র সঙ্গীত ====== পরিষদের হয়ে কাজ করেছেন, আবার বিজ্ঞান চেতনা পরিষদেও সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করেছেন। আলোর পথের যাত্রী হিসেবে তিনি সারা জীবন আলো দিয়ে আলো জ্বালার কাজটি করে যাচ্ছেন। প্রতিপক্ষকে বুলেটবিদ্ধ না করে যুক্তি ও ভালবাসা দিয়ে জয় করার কথা বলছেন তিনি সব সময়। নিজেই মার্কসীয় ধারার রাজনীতি করেছেন, তথাপি ভিন্ন মতাবল¤^ীদের সখ্য সম্পর্ক রেখেছেন। রাজনৈতিক কারণে কখনও কারো সাথে দ্ব›দ্ব-হানাহানিতে লিপ্ত হননি। তিনি জানতে হিংসা হানাহানিতে কোন সমস্যার সমাধান নেই। তাই মানুষের অন্তনির্হিত শুভ প্রত্যয়ের উজ্জীবনের ওপর জোর দিতেন আর তার সব কর্ম প্রয়াস ও উদযোগ চালিত হয়েছে মানুষকে ঘিরে এবং শুভবোধ উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে। নাসির উদ্দীন লেখালেখি জগতের সাথে থাকলেও নিজে তেমন লেখেননি। পড়াশুনার প্রতিই তার বরাবর আগ্রহ। প্রথম যৌবন মাক্স লেনিন মাও জে দং নিয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং মার্কসীর দর্শনের আলোকে গড়ে ওঠা সমাজকে শ্রেষ্ঠ সমাজ বলে গন্য করেছেন। তবে সমসাময়িক অন্যান্য তাত্তি¡কের মতো গোঁড়ামিরা সংকীর্ণতায় আচ্ছন্ন ছিলেন না। অখন্ড মানবিক দর্শনের পক্ষে সব সময় দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। নাসির উদ্দীন পাশ্চাত্য সাহিত্য-দর্শন নিয়ে যেমন পড়েছেন। তেমনি আফ্রো-ঐশীয় লাতিন আমেরিকার সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। সমকালীন সাহিত্যিকদের লেখা পড়েছেন গভীর মনোযোগে। মেহেরপুরের লোক সাহিত্য, ইতিহাস জীবনে নানা কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছেন। তবে সুস্থ, সাংস্কৃতিবান, আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য করি কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা, চিত্র শিল্পী, সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে কাজ করেছেন বেশি। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী এই শ্রমী পুরুষের সাড়ে ছয় দশকের জীবনে যেমন সাফল্যের গৌরব আছে, তেমনি আছে ব্যর্থতার গ্লানি। সাফল্যের গৌরব প্রাণিত করলেও ব্যর্থতা তাকে পীড়িত বা বিপন্ন করে না। বরং ‘বিপন্ন বিস্ময়’ নিয়ে এগিয়ে যান আঁধার ছেঁড়া সংকল্পে নিঃসংশয়ে নির্ভয়ে। কামরুল হাসান-হীরক : কবিতা যার ভালবাসা Kamrul Hasan Hirokঅগ্রগণ্য আবৃত্তিকার কামরুল হাসান খান হীরকের জন্ম ৭ জুলাই ১৯৪৯ মেহেরপুরের এক সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারে। বাবা প্রয়াত হাশেম আলী খান ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েট এবং আনসার এর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। মা গুলফাম ভালগান গাইতেন এবং আবৃত্তি করতেন। ছোট বোন মরিয়ম খানমের রবীন্দ্র সঙ্গীতের শিল্পী ছিলেন। বাবা ছিলেন ইংরেজি-ফারসি-আরবি ভাষায় সুপণ্ডিত, তার কাছ থেকেই হীরক জেনেছেন বিশ্ব সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ এবং কবিতার সংজ্ঞা। বাবা-মা তাকে শিখিয়েছেনÑ ‘জিহবায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্যশব্দ কবিতা কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা’ বাল্য-কৈশোরেই হীরক কবিতার প্রেমে মজে যান। স্বপ্ন ছিল; কবি হবেন, তার কবিতার পঙক্তিমালা চারদিক আলো ছড়াবে। কিন্তু মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় পাস করার পর এক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে লিখনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে বলা হয় রাইটার্স ক্ল্যামপ বা লেখক দিগের হস্তকম্পন। এরপর থেকে তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখা পড়ার পরিসমাপ্তি ঘটে। বাগেরহাট পিসি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ভর্তি হয়েও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেননি। সাথে সাথে তার কবি হওয়ার স্বপ্নও অপূর্ণ থেকে যায়, মনের গহন গভীরে শব্দাবলী খেলা করে গেলেও তা তাদের কালি কলম দিয়ে গাঁথতে পারেননি। কবি হওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণ থাকলেও কবিতাকে ধ্রুব সখা করে পথ চলেন তিনি আজও। কবিতাতে খুঁজে পান নিরর্মক জীবনকে অর্থময়, স্নিগ্ধ ও স্বপ্ন রঞ্জিত করে তোলার বরাভয় মন্ত্র। কবিতার অভিজ্ঞান দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেন জগৎ, জীবন ও প্রকৃতির রহস্য। কবিতার রসে মন মজা হীরক কবিতা আবৃত্তি শিখতে কত জনের না দ্বারস্থ হয়েছেন যার ইয়ত্তা মেলা ভার। প্রথম যৌবনে আবৃত্তি শিখেছেন প্রফেসর আনসার উল হক কাছে। অভিনেতা মফিজুর রহমান, নাসির উদ্দীন, শিবনারায়ন চক্রবর্তী, অনীল গাঙ্গুলীও তাকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। মফিজুর রহমান তাকে দিয়ে অভিনয় করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবার মত না থাকায় অভিনয়ে তার অংশ নেয়া হয়নি। রবীন্দ্র ভাবাদর্শের একনিষ্ঠ অনুগামী কামরুল হাসান হীরক নানা অনুষ্ঠান, উৎসবে রবীন্দ্রনাথ থেকে আবৃত্তি করেছেন বারবার তার পরিশীলিত কণ্ঠ দিয়ে মধুসূদন, জীবননান্দ দাশ, নজরুল ইসলাম, শামসুর রহমানকেও শুনিয়েছেন শ্রোতদের। তবে রবীন্দ্রনাথ থেকে পাঠ করে তিনি সাচ্ছন্দ্য ও আনন্দ বোধ করতেন বেশি। আনসার উলহক যখনই বলতেন, হীরক রবীন্দ্রনাথের ‘পৃথিবী’ আবৃত্তি কর, তখন তিনি সংযত আবেগে উচ্চারণ করতেন: ‘আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো, পৃথিবী শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে\’ নজরুলের ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সরি’ ও আবৃত্তি করেছেন নানা অনুষ্ঠান। কবিতা প্রেমী হীরকের বিশ্ববীক্ষা, মানব প্রেম, দেশপ্রেম সবই গড়ে ওঠে কবিতা নিহিত নির্যাস পান করে। এই আত্ম নিমগ্ন ভাবুক রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দের কবিতা ভালবেসে স্বদেশ প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও কাজ করেছেন। সেখানে তার লেখা স্ক্রিফট মাঝে মাঝে পাঠ করা হতো। একজন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং স্বদেশপ্রেমের মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত একজন বাঙালি হিসেবে তিনি একাত্তরে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। কিন্তু এজন্য কোন দিন স্বীকৃতি বা সনদ দাবী করেননি। মানুষ ও মানবিকতার স্বার্থে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব নিকাশ কখনো তিনি করেননি। হীরক ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু কখনও ক্ষমতার প্রভাব বলয়ের কাছাকাছি আসতে চাননি। সংস্কৃতি চর্চার নামে দলাদলি কিংবা ক্ষমতার লেজুড়বৃত্তি তিনি সবসময় অপছন্দ করেছেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে নানা কারনেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। তারপরও কবিতা প্রেমী মানুষ তিনি। কবিতাই তার কৌতুহল, কবিতাই তার জীবন। কবিতাই তার প্রেম ও ভালবাসা। কবিতাই তার জীবন জিজ্ঞাসা, কবিতাই তার আত্মার খোরাক, কবিতাই তার অস্তিত্বের শেষ ঠিকানা।
Slider
দেশ
মেহেরপুর জেলা খবর
মেহেরপুর সদর উপজেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
যাবতীয়
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Home
»
Education
» মেহেরপুরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখায় মেহেরপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমী উদ্যোগে ৫ গুণী শিল্পিকে সংবর্ধনা
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News
No comments: