Sponsor



Slider

দেশ

মেহেরপুর জেলা খবর

মেহেরপুর সদর উপজেলা


গাংনী উপজেলা

মুজিবনগর উপজেলা

ফিচার

খেলা

যাবতীয়

ছবি

ফেসবুকে মুজিবনগর খবর

» » · মেহেরপুরের সাহিত্য:দীনেন্দ্রকুমার রায় - পর্ব-১




x h t 1 ·

মেহেরপুরের সাহিত্য:দীনেন্দ্রকুমার রায় (২৬ আগস্ট ১৮৬৯ – ২৭ জুন ১৯৪৩)- খ্যাতনামা লেখক, পত্রিকা সম্পাদক এবং অনুবাদক ------------------------------------------------------------ সেকালের মেহেরপুর- পর্ব-১ -:দীনেন্দ্রকুমার রায় আমাদের বাসপল্লী মেহেরপুর নদীয়া জেলার উত্তর প্রান্তস্থিত মহকুমা । ইহার উত্তরসীমা পদ্মা নদীর দক্ষিণ তটভূমি পর্যাস্ত প্রসারিত সন্কীর্ণকায়া স্রোতন্বিনী জলঙ্গী বা খ'ড়ে নদী মুর্শিদাবাদ জেলা হইতে নদীয়াকে পৃথক করিয়াছে । পদ্মার সহিত জলঙ্গী নদীর সংযোগস্থলে, মুর্শিদাবাদ জেলার পূর্ববসীমা প্রান্তে জলঙ্গী নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রাম আছে। গ্রামখানি বহু প্রাচীন । এই গ্রামের নাম হইতে জলঙ্গী নদীর নামকরণ হইয়াছিল কি না জানি না। কিন্তু জলঙ্গী নদী যেখানে পদ্মার সহিত মিলিত হইয়াছে, বছদিন পূর্বে্ব সেই স্থানটি পলি পড়িয়া এরূপ ভরাট হইয়াছিল যে, সেখানে নদীর মোহনার চিহৃমাত্র ছিল না| কৃষকরা সেই পলিমাটির উপর লাঙ্গল দ্বারা চাষ দিয়া ধান্য রোপণ করিত । নদীর উভয় দিকের উচ্চ পাড় দেখিয়া বুঝিতে পারা যাইত, এক সময় সেখানে নদী ছিল । কিন্তু কয়েক মাইল দূরে এখনও জলঙ্গী নদীর ক্ষীণ জলধারা দেখিতে পাওয়া যায় । বর্ষকালে তাহাতে পদ্মার জল প্রবেশ করে। এই জলঙ্গী বা খড়ে নদীর অবশিষ্টাংশে বর্ষা ব্যত্ভীত বৎসরের অন্যান্য সময়েও জল থাকে ; সেই জলধারা আঁকিয়া-বাঁকিয়া বহু সংখ্যক গ্রাম, প্রান্তর, শস্যক্ষেত্রের প্রান্ত দিয়া নদীয়ার স্বরূপগঞ্জের নিকট ভাগীরথীর জলম্তরোতের সহিত মিশিয়াছে। কৃষ্ণনগরের অদূরে, মুর্শিদাবাদ রেললাইনের একটি সেতু এই নদীর উপর নির্মিত হইয়াছে । এই বন্ধনে জলঙ্গী নদীর অবস্থা অধিকতর শোচনীয় হইয়াছে । 'রেল-পথের উপর সেতু নির্মিত হওয়ায় বাঙ্গালার অধিকাংশ নদীর স্রোতের বেগ ও বিস্তার হ্থাস প্রাপ্ত হইয়াছে । সে দিন কায্যেপিলক্ষে রাজশাহী যাইতে হইয়াছিল; বহুদিন পরে পদ্মার লৌহ-শৃঙ্খল 'হাডিং ব্রীজ' বা 'সাঁড়ার পুল' দেখিলাম | উহার দক্ষিণ তীরে নদীয়ার ভেড়ামারা স্টেশন, উত্তরতীরে পাবনা জেলার পাক্জী ষ্টেশন । উভয় স্টেশনের মধ্যবর্তী 'ব্রীজ' পার হইতে তিন ১ মিনিট সময় লাগিল । কিন্তু পুলের নীচে বিশালকায়া পদ্মার অবস্থা দেখিয়া ক্ষোভে হৃদয় পূর্ণ হইল । বহুদূর-প্রসারিত চর স্থানে স্থানে সংকীর্ণ জলরেখা বুকে লইয়া কঙ্কালসার মৃতদেহের ন্যায় পড়িয়া আছে। নদীচরে অগণ্য বাবলাগাছ। এই সাঁকো নিম্মার্ণের সময় শ্রমজীবী ও কর্মচারিগণের বাসের জন্য যে নগর বসিয়াছিল, এখন তাহা বাবলার একটি বিস্তীর্ণ অরণ্যে পরিণত হইয়াছে; দূরে দূরে কচিৎ দুই একথানি পর্ণ-কুটীর । সুবিস্তীর্ণ পুলের উপর গাড়ী উঠিলে পুলের অতিকায় বহুদুর-বিস্তৃত চরের দিকে চাহিয়া সে-কালের কথা মনে পড়িল। প্রথম যৌবনে বরোদায় যাইবার বছরপূর্ধ্বে রাজশাহীতেই আমার কর্ম্ম জীবন আরম্ভ। সেই সময়ে মেহেরপুর হইতে দুইটি ভিন্ন পথে রাজশাহী যাওয়ার উপায় ছিল । একটি পথ গরুর গাড়ীর সোজা পথ । মেহেরপুরে গরুর গাড়ীতে চড়িয়া ১৫ ক্রোশ দূরবর্তী পদ্মাতীরবর্তী আলাইপুর স্টীমার-স্টেশনে উপস্থিত হইতাম, এবং বেলা ১২টা বা ১টার সময় আই'জি. এস. এন. কোম্পানীর স্ীমারে চাপিয়া অপরাহ্ন ৪টা বা ৫টার সময় রাজসাহীর স্টীমার-স্রেশন “আখড়ার ঘাটে” পৌঁছিতাম । কখন কখন মেহেরপুর হইতে ৯ ক্রোশ দূরবর্তী চুয়াডাঙ্গা ষ্টেশনে ট্রেনে চাপিয়া দামুকদিয়া ঘাটে নামিতাম, সেখানে প্রভাতে ৮টার সময় আই. জি এস: এন কোম্পানীর স্টীমার ধরিতাম | একবার স্টীমার ষ্টেশনে স্টীমার পাইলাম না । শুনিলাম, পদ্মার চরে স্টীমার দুইদিন হইতে “ইন্টার্নড' ! অগত্যা দামুকদিয়া ঘাটে রেলের স্টীমার 'আলিগেটর' কি 'ক্রোকোডাইল' ঠিক স্মরণ নাই, অবলম্বন করিয়া সারা স্টেশনে উপস্থিত হইলাম । তাহার পর নাটোর, এবং নাটোর হইতে গো-শকটে চৌদ্দ ক্রোশ দূরবর্তী প্রত্যাগমন ! সেই সময় পদ্মার যে বিস্তার তরঙ্গরাশির যে উদ্দাম নৃত্য, যে লীলাভঙ্গী নিরীক্ষণ করিয়াছিলাম, এখন পদ্মার অবস্থা দেখিয়া তাহা স্বপ্ন বলিয়াই মনে হইল! কিন্তু তথাপি পদ্মাকে বিশ্বাস নাই; কে জানে, মানুষ তাহাকে শৃঙ্খলিত করিয়া. রাখিতে পারিবে কিনা ? অনেকের ধারণা, পুলের নীচে যে চর পড়িতেছে, তাহা ক্রমশঃ ভরাট হইবে, নদী বাঁকিয়া অন্য দিকে চলিয়া যাইবে ; জলস্রোত অন্য খাদে বহিবে, এবং পুল যেখানে দাঁড়াইয়া আছে, সেইখানে অকর্মপ্যভাবে দাঁড়াইয়া দূর হইতে নবপথগামিনী পল্লার অঙ্গ ভঙ্গ নিরীক্ষণ করিবে ! তখন হয়ত পদ্মার উপর আর একটি পুল নির্ম্মাণ করিবার প্রয়োজন হইবে, এবং সে জন্য গৌরীসেনের অক্ষয় ভাণ্ডারে টাকার অভাব হইবে না। কথাটা মিথ্যা বা কল্পনার বিকার বলিয়া মনে হয় না, কারণ পদ্মার গতি এইরূপই বিচিত্র ! মনে পড়ে, শৈশব-কালে জলঙ্গী গ্রামে মামার বাড়ী যাইতাম । মামার বাড়ীর অট্টালিকার ছাদ হইতে পূর্বদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বহুদূর মুক্ত প্রান্তর এবং তাহার প্রান্তভাগে মসীলেখাবং একটা কালো দাগ দেখিতে পাইতাম ; শুনিতাম, উহাই পদ্মা ৷ এখন পল্মা সেখানে নাই; কয়েক বৎসরে তিন চারি ক্রোশ সরিয়া আসিয়া জলঙ্গী গ্রামখানি গ্রাস করিয়াছে । জলঙ্গীর অট্টালিকা শ্রেণী, সুবিস্তীর্ণ আম-কাঁঠালের বাগান, _পু্ষ্করিণী, থানা, রাজার, জেলা-বোর্ডের সুপ্রশস্ত পথ এবং পথপ্রাস্তবর্তী প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বট-পাকুড়ের গাছ পদ্মাগর্ভে বিলীন হইয়াছে ; এখন আবার সেখানে চর পড়িতেছে। গত চল্লিশ বৎসরের মধ্যে এই পরিবর্তন ! আরও চল্লিশ বৎসর পরে হাডিং সেতুর কি অবস্থা হইবে__কে বলিতে পারে ? সেই পলাশী আমাদের মেহেরপুর মহকুমার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত | পলাশীর প্রাস্তবাহিনী ভাগীরথীর তীর পর্যন্ত এই মহকুমার সীমা প্রসারিত ৷ ভাগীরথীর পশ্চিম পারে মুর্সীর্দাবাদের সীমানা ; কিন্তু সিরাজের সহিত ক্লাইভের যুদ্ধের সময় পলাশীক্ষেত্রে যে আম্রকানন ছিল, তাহার চিহ্নমাত্র নাই। শুনিয়াছি, পলাশীক্ষেত্রে মহাযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ একটি অনুচ্চ স্মৃতিস্তম্ভ আকাশের দিকে অঙ্গুষ্ঠ উত্তোলিত করিয়া মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ও সিরাজের শোচনীয় পরাজয়ের বার্তা বিঘোধিত করিতেছে । যুদ্ধক্ষেত্রে সেই যুদ্ধের আর কোন নিদর্শন বর্তমান নাই ; তবে কয়েক বৎসর পূর্বেও পলাশীর মাঠে “কি হ'লো রে জান! পলাশীর ময়দানে নবাব হারালো পরান”"--_-এই করুণ গান গাহিয়া গ্রাম্য কৃষককরা হল কর্ষণ করিতে করিতে মাঁটীর নীচে কামানের দুই একটি গোলা পাইয়াছিল। কিন্তু এখন আর তাহা পাওয়া না। এখন ভাগীরতীর উভয় তীরে রেলের লাইন; পূর্ববতীরে পূর্বববঙ্গ-রেল পথের বহরমপুর, কাশিমবাজার প্রভৃতি ষ্টেশন; পশ্চিমতীরে ই আর ব্রেলপথের খাগড়াঘাট স্টেশন । এখন বেলা ৯টার সময় আহারাদি শেষ করিয়া বহরমপুরে ট্রেনে চাপিলে বেলা ৪টার পূর্বে কলিকাতায় উপস্থিত হওয়া যায় ; কিন্তু সেকালে বহরমপুর হইতে কলিকাতায় আসিবার পূর্বে অনেকে উইল করিয়া কলিকাতায় যাত্রা করিতে হইত ! আমাদের মেহেরপুর হইতে গরুর গাড়ীতে দুই দিনে খাগড়ায় আসিতে হইত । সেকালে ও একালে কত প্রভেদ। কিন্ত “তে হি নো দিবসা গভা।” | আমাদের গ্রামে সেকালে দুই ঘর বড় জমীদার ছিলেন । এক ঘর ব্রাহ্মণ, তাঁহারা“মুখোয্যেবাবু” নামে পরিচিত ; আর এক ঘর-__মল্লিকবাবুরা বৈদ্য ৷ এখনও এই দুই ঘর বর্তমান ; কিন্তু বঙ্গের অধিকাংশ প্রাচীন জমীদার-বংশের যে অবস্থা, এখন তাঁহাদেরও সেই অবস্থা । বহু শরিকে বিভক্ত হওয়ায় উভয় বংশই দুর্ব্বল ও হৃত গৌরব । তাঁহাদের পূর্ব্ব প্রতিষ্ঠাও ম্লান হইয়াছে। আমাদের বাল্যকালে এই মুখোপাধ্যায়-বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ স্বর্গীয় দীননাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা সর্বদাই শুনিতে পাইতাম | তিনি সরল প্রকৃতি সদাশয় ব্যক্তি ছিলেন । তাঁহার দোতলা বৈঠকখানার দক্ষিণ পারে একটি অপ্রশস্ত ভূমিখণ্ডে প্রায় দেড় বিঘা জমীর উপর আমাদের বসত বাড়ী ছিল । সেই বাড়ীতেই আমি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলাম । বাড়ীতে মৃৎপ্রাচীর বিশিষ্ট চারিখানি ঘর ছিল ; তাহাদের চাল ছিল উলু-খড়ের | প্রতি বৎসর বধরি পূর্বে আমার পিতামহ উলুখড় কিনিয়া ঘরের চালগুলি নৃতন করিয়া ছাইয়া লইতেন । পিতৃদেব কৃষ্ণনগরে জমীদারী সেরেস্তার চাকরী করিতেন ; আমার দুই কাকা তাঁহার নিকট থাকিয়া কৃষ্ণনগর কলেজে লেখা পড়া করিতেন; ছোটকাকা হুগলীর নর্ম্মাল স্কুলে ত্রৈবার্ষিক পড়িতেন । আমার পিতামহ বাড়ীতেই থাকিতেন এবং সংসারের কর্তৃত্ব করিতেন। বাল্যকালে মুখোয্যে জমীদারবাবুর দোতলার বৈঠকখানায় গীতবাদ্য ধ্বনি শুনিতে পাইতাম | জমীদারবাবু পারিষদ্বর্গে পরিবৃত হইয়া সঙ্গীতালোচনা করিতেন । তাঁহার দোতলা হইতে আমাদের অন্দরমহল দৃষ্টিগোচর হইত, এ জন্য আমার পিতামহ আমাদের বাড়ীর উত্তরদিকে, জমীদারবাবুর দোতলার দক্ষিণদিকের দ্বার, জানালার সমান উচ্চ করিয়া দরমার বেড়া দিয়াছিলেন । স্বর্গীয় দীননাথবাবুর পরিবারবর্গের সহিত আমাদের পরিবারের সম্ভাবের কখন অভাব হয় নাই; তাঁহাদের অবস্থা যখন অপেক্ষাকৃত উন্নত ছিল, সেই সময় আমার স্বর্গীয় পিতামহ এই বংশের পদস্থ কর্মচারী ছিলেন । এ জন্য তিনি এই পরিবারকে প্রভুর ন্যায় সম্মান করিতেন, এবং তাঁহারা উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ও আমরা শূদ্র হইলেও আমাদের সহিত আত্মীয়বৎ ব্যবহার করিতেন । অধিক কি, এই পরিবারে যাঁহারা আমার স্বর্গীয় পিতৃদেবের প্রায় সমবয়ষ্ক ছিলেন, তাঁহাদিগকে “কাকা”বলিয়া ডাকিতাম, এবং নিজের কাকার মত সম্মান ও ভক্তি করিতাম | একালের ছেলেরা পিতার সহোদরকেও সেরূপ ভক্তি শ্রদ্ধা বা ভয় করে না। তখন হিন্দুয়ানীর সদাচারনিষ্ঠা একাল অপেক্ষ৷ অনেক অধিক ছিল ; তথাপি স্মরণ হয়, জম়ীদার বাড়ীর ছেলেদের সঙ্গে তাহাদের রান্নাঘরে একসঙ্গে বসিয়া ভাত খাইয়াছি। অবশ্য একাল হইলে ইহাতে বিস্ময়ের কারণ থাকিত না; কারণ, একালে হিন্দুধর্মের প্রহরিম্বরূপ সুপ্রসিদ্ধ মাসিকপত্রের প্রবীণ সম্পাদকবাবু সত্তরের কোঠায় আসিয়াও তাঁহার রচিত ভ্রমণ কাহিনীতে স্পষ্টাক্ষরে ঘোষণা করিয়াছেন, তিনি খড়গপুর ষ্টেশনে রেঁস্তোরা গাড়ীর পরম মুখরোচক অন্ন ব্যঞ্জন তৃপ্তির সহিত গলাধঃকরণ করিয়াছিলেন ! যে সময় অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রবলবেগে সংগ্রাম চলিতেছে, সে সময় একথা স্বীকার করিলে যথেষ্ট “মরাল করেজ' প্রদর্শিত হয় কিন্তু হিন্দু ধর্মমরক্ষিণী সভার বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করিবার সময় কোন স্পষ্টবাদী গোঁড়া হিন্দু এরূপ ব্যবহারের প্রতিবাদ করিলে আত্মসমর্থনের উপায় থাকে কি? আমার বাল্যকালে স্বর্গীয় দীননাথবাবু প্রৌঢেত্বের সীমায় পদার্পণ করিয়াছিলেন ; কিন্তু তিনি সেকালের বাবুগিরির আদর্শ কিছু কিছু বজায় রাখিয়াছিলেন । শুনিয়াছি, তিনি সোনার গড়গড়ায় দিল্লী, লক্ষ প্রভৃতি স্থান হইতে আনীত মুল্যবান্ তান্তরকূটের ধূম পান করিতেন, এবং গড়গড়ার গুরুগম্ভীর গর্জন তাঁহার কর্ণ-কুহরে প্রবেশ করিয়া কর্ণপীড়া উৎপাদন করে, এই আশঙ্কায় গড়গড়াটি একতলায় রাখিয়া, তাহার সুদীর্ঘ নলের সাহায্যে দোতলায় বসিয়া ধূমপান করিতেন | তাঁহার শয়ন-কক্ষের অদূরে তাঁহাদের খিড়কির সীমায় দুই একটি তালগাছ ছিল । একটি তালগাছের নীচে একখানি পর্ণ কুটীরে একটি চণ্ডালিনী বাস করিত ; তাহার নাম ইচ্ছা । আমাদের বালাকালে ইচ্ছা বৃদ্ধা হইয়াছিল, কিন্তু তাহার একটিও চুল পাকে নাই বা দাঁত পড়ে নাই । ইচ্ছার মত ঝগড়াটে স্ত্রীলোক দেখা দূরের কথা, নাট্যকারের কল্পনা করাও কঠিন ! ঝগড়া করিবার লোক না পাইলে সে বাতাসের সঙ্গে ঝগড়া করিত ! তালপাতা বায়ুপ্রবাহে কম্পিত হইত, সন্-সন্ শব্দ করিত, সেই সঙ্গে ইচ্ছার মাথা গরম হইত ; সে তালগাছ ও বাতাসকে গালি দিত ! সুতরাং বলা-বাহুল্য, পাড়ার স্ত্রীলোকদের সহিত সামান্য কারণে বা অকারণে তাহার ঝগড়া লাগিয়াই থাকিত । প্রত্যুষ হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাহার কর্কশ কণ্ঠের বিরাম ছিল না। দীননাথবাবু তাহাকে বহুবার ঝগড়া করিতে নিষেধ করিয়াও তাহার কণ্ঠরোধ করিতে পারেন নাই : তাঁহার যেরপ প্রবল প্রতিপত্তি ছিল, তিনি ইচ্ছা করিলে ইচ্ছাকে তাহার কুটীর হইতে বিতাড়িত করিতে পারিতেন, তাঁহার অমোঘ আদেশে পাঁট মিনিটের মধ্যে তাহার ক্ষুদ্র কুটীরখানি বিধ্বস্ত হইতে পারিত ; কিন্তু তিনি এইভাবে তাহার ক্ষতি না করিয়া তাহাকে জব্দ করিবার জন্য এক বিশেষ শক্তি 'অর্ডিনান্স' জারি করিলেন ; তাহা সম্পূর্ণ “অরিজিনাল', এবং তাহার ফল এরূপ অব্যর্থ যে, পুলিসের দারোগাবাবুদেরও তাহা অনুকরণের অযোগ্য নহে । তাঁহার আদেশে তাঁহার পাইক ইচ্ছার স্বজাতি লোহারাম সদ্দরি একটা প্রকাণ্ড আড়াইমনী বস্তা আনিয়া, ইচ্ছার হাত পা বাঁধিয়া তাহাকে তাহার ভিতর নিক্ষেপ করিল ; তাহার পর একটা প্রকাণ্ড মদ্দাঁ বিড়াল ধরিয়া আনিয়া, সেটাকে সেই বস্তায় পুরিয়া বস্তার মুখ দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া রহিল । বিড়ালটা পলায়নের পথ না পাইয়া ইচ্ছাকে আঁচড়াইয়া কামড়াইয়া অস্থির করিয়া তুলিল । ইচ্ছা গলা ছাড়িয়া যতই চীৎকার করে, লোহারাম, ততই বলে, “চ্যাঁচা মাগী, আরও জোরে ! বিড়াল যত্তক্ষণ তোর টুঁটি ছিড়ে মুখ বন্ধ না করায়, ততক্ষণ বস্তার মুখ আলগা করছিনে ।"- অবশেষে সে বস্তার ভিতর অতিষ্ঠ হইয়া প্রতিজ্ঞা করিল আর সে কাহারও সঙ্গে ঝগড়া করিবে না; বাবু আর কোনদিন তাহার গলার আওয়াজ শুনিতে পাইবেন না।--তখন লোহারাম বস্তার মুখ আল্গা করিল । সেইদিন হইতে ইচ্ছা চাঁড়ালনীর কলহ-প্রবৃত্তির কোন পরিচয় পাওয়া যায় নাই; কিন্তু তাহার গালে, কপালে ও দেহের বিভিন্ন অংশে বিড়ালের সুতীক্ষ দত্ত নখরের চিহ্ন বর্তমান ছিল । কেহ কেহ ইচ্ছাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “ইচ্ছে, আর যে তোর গলার আওয়াজ শুনতে পাইনে ?” --ইচ্ছা বলিয়া ছিল, দীনুবাবু বলেছে-“এবার আর বিড়াল নয়, বস্তার মধ্যে আমাকে পুরে কুকুর ছেড়ে দেবে ।” বিড়াল ইচ্ছার পরিধেয় বন্ত্রখানি আঁচড়াইয়া ছিড়িয়া দেওয়াতে বাবু তাহাকে একখানি নূতন কাপড় বকশিস্ দিয়াছিলেন ; ইহাতেই তাহার ক্ষতিপূরণ হইয়াছিল ; কিন্ত সে আর কোন দিন নৃতন বস্ত্র লোভ করে নাই। এই মুখোয্য-বংশের মধ্যে যিনি সর্ব্বাপেক্ষা অধিক খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন, তাঁহার নাম ছিল বাবু মথুরানাথ মুখোপাধ্যায় ৷ সে সময় মেহেরপুর অঞ্চলে নীলকর সাহেবদের প্রবল প্রতাপ । বাবু মথুরানাথকে বা তাঁহার সুযোগ্য পুত্র চন্দ্রমোহনবাবুকে দেখি নাই। মথুরানাথ এই জমীদার-বংশকে উন্নতির সর্ব্বচ্চ সোপানে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন । তিনি এরূপ সমারোহে দুগেথিসব করিতেন যে, সেই সময় কোন কবির দলের ওস্তাদ উৎসবের আসরে গান করিতে আসিয়া পূজার ঘটা দেখিয়া গাহিয়াছিলেন__ “সত্য যুগে সুরথ রাজা করেছিলেন দেবীর পুজা, ব্রেতা যুগে রাম । কলিযুগে মথুরানাথে সদয় হলেন ভবানী, হায় কি পূজোর ঘটা-__ মেহেরপুরে মহিষমদ্দিনী 1” এহ ছড়াটা কিছুদিন পূর্বেবও মেহেরপুরের প্রাচীন অধিবাসীদের মুখে শুনিয়াছি। এখন তাঁহারা সকলেই পরলোকগত ! মেহেরপুর কাশিমবাজারের জমীদারীর অন্তর্গত ছিল । কথিত আছে, মথুরাবাবু কাশিমবাজারের স্বর্গীয় রাজা কৃষ্ণনাথের নিকট হইতে মেহেরপুরের জমীদারী পত্তনী লইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন ; কিন্তু নিশ্চিন্তপুর কানসার্নের নীলকর ম্যানেজার সাহেব অনেক কৌশলে রাজা কঞ্চনাথকে বশীভূত করিয়া যথৎসামান্য অর্থব্যয়ে এই জমীদারী ইজারা লইয়াছিলেন | মথুরাবাবু তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক অর্থব্যয় করিতে প্রস্তুত ছিলেন; কিন্তু সাহেবী চাতুর্য ও কৌশলের নিকট তাঁহাকে পরাজিত হইতে হইয়াছিল । বাঙ্গালীর ভাগ্যে এরূপ পরাজয় বহুবারই ঘটিয়াছে । মুরানাথ মেহেরপুরের জমীদারী হস্তগত করিতে না পারিলেও তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, এই অঞ্চলের নীলকর সাহেবদের সঙ্গে সমান তেজের সহিত প্রতিদ্বন্দিতা সিএ একবার মথুরানাথের পুত্র চন্দ্রমোহনবাধু কৃষ্ণনগরের সদর হইতে পাল্কীযোগে মেহেরপুর আসিতেছিলেন, সেইসময় কোন নীলকুঠীর ম্যানেজার লাঠিয়াল পাঠাইয়া তাঁহার পাল্কী আটক করিয়া অপমান করিয়াছিল। এই সংবাদ শুনিয়া মথুরানাথ এক রাত্রিতে সহস্রাধিক লাঠিয়াল সংগ্রহ করিয়া এই অঞ্চলের সকল নীলকুঠী আক্রমণ করিয়াছিলেন এবং কুঠীয়ালদিগকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়াছিলেন । পথের ধারে মথুরানাথের অষ্টালিকার দেউড়ি ছিল; শুনিয়াছি, এই অঞ্চলের নীলকর সাহেবরা সেই দেউড়ির সম্মুখ দিয়া যাইবার সময় ঘোড়া হইতে নামিয়া দেউড়ি পার হইতেন । একালে ইহা উপকথার ন্যায় অবিশ্বাস্য ! কিন্তু চন্দমোহন অত্যন্ত তেজস্বী পুরুষ ছিলেন ; একে ব্রাহ্মণ, তাহার উপর জমীদার, গ্রামের কোন সাধারণ লোক তাঁহার সম্মুখ দিয়া যাইবার সময় অবনত-মস্তকে তাঁহাকে অভিবাদন না করিলে তাহার লাঞ্ছনার সীমা থাকিত না। আমি যে সময়ের কথা লিখিতেছি, তাহার বহু পূর্বে যখন মেহেরপুরে জমীদার চন্দ্রমোহনের পরাক্রম দুর্দমনীয়, সেই সময় মেহেরপুরে বলরামচন্দ্র নামক একজন ধর্ম-সংস্কারকের আবির্ভাব হইয়াছিল । তিনি যে সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন, তাহাদের নাম “বলরামী সম্প্রদায় ।' স্বর্গীয় অক্ষয়কুমার দত্ত রচিত “ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়' নামক গ্রন্থে এই বলরামী সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেখিতে পাওয়া যায় । বলরাম মেহেরপুরের মালো-পাড়ায় অস্পৃশ্য হাড়ীর বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন ; কিন্তু হাড়ীর ঘরে জন্মিয়াও পূর্ববজন্মের সুকৃতির ফলে শৈশবেই তাঁহার হৃদয়ে ধর্মভাব অঙ্কুরিত হইয়াছিল । হিন্দুধর্মে তাহার প্রবল অনুরাগ ছিল। তিনি যৌবনকালে মল্লিক জমীদারদের গৃহ-বিগ্রহ আনন্দবিহারীর দেবায়তনের রক্ষী নিযুক্ত হইয়াছিলেন । এই চাকরী পাইয়া বলরাম আনন্দিত হইয়াছিলেন | তিনি বিগ্রহের বাসগুহে প্রবেশ করিতে না পাইলেও দূরে থাকিয়া ভক্তিভরে আনন্দবিহারীর পূজার্চনা করিতেন । আনন্দবিহারীরর সব্বাঙ্গে বহুমূল্য স্বণলিঙ্কার, মস্তকে শিখিপুচ্ছ-শোভিত রত্ব-মুকুট ও চরণযুগলে সোনার নুপুর ছিল ; বলরামের প্রতি এই সকল অলঙ্কার রক্ষার ভার অর্পিত হইয়াছিল । বলরামচন্দ্র এই কার্যের সম্পূর্ণ যোগ্য ছিলেন । কারণ, সে সময় আমাদের নদীয়া জেলার জমীদারবর্গের বরকন্দাজ, পাইক বা সিপাই-শান্ত্রীদলের মধ্যে বলরামের মত সুদক্ষ তীরন্দাজ আর একজনও ছিল না। সেকালের প্রাচীন গ্রামবাসীরা বলিতেন, সেই সময় নদীয়া বহরমপুরে সুপ্রসিদ্ধ দস্মুদল-নায়ক বিশে গ্োয়ালার অত্যাচারের সীমা ছিল না। একালের মত সেকালের পুলিশের শক্তি ও শৃঙ্খলার তেমন পরিচয় পাওয়া যাইত না। তাহার উপর পুলিসের দারোগা, জমাদার প্রভৃতি কর্মচারীরা সাধারণতঃ তেমন কর্তব্যনিষ্ঠ ছিল না এবং যে কোন উপায়ে অথোপপার্জনই তাহাদের অনেকের লক্ষ্য ছিল । “চোরকে বলে চুরি করতে, গৃহস্থকে বলে সাবধান হ'তে'__এই সর্ববজন বিদিত উক্তি তাহাদের অনেকেরই সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইতে পারিত । এজন্যে বিশে গোয়ালা বিশ্বনাথবাবু, এই নামগ্রহণ করিয়া নিঃশঙ্কচিত্তে সদলে দস্যুবৃত্তি করিত | সে বড় বড় জমীদারদের পত্র লিখিয়া তাহাদের বাড়ী ডাকাতী করিতে যাইত | সে পাল্কীতে যাইত, তাহার অনুচররা সশস্ত্র তাহার অনুসরণ করিত । পরাক্রাস্ত জমীদাররা পর্যাস্ত তাহার ভয়ে কাঁপিতেন | সে যেখানে ডাকাতী করিতে যাইত, সেই স্থান হইতে অকৃতকার্য্য হইয়া ফিরিতে না ; কোন জমীদারের লাঠীয়াল বা পাইক-বরকন্দাজরা তাহার গতিরোধ করিতে পারিত না ।' গ্রন্থনা:অধ্যক্ষ মহসীন আলী আঙ্গুঁর ,সম্পাদক ও প্রকাশক, মুজিবনগর খবর ডট কম,মেহেরপুর।






«
Next
Newer Post
»
Previous
Older Post

No comments:

Leave a Reply