মেহেরপুরের সাহিত্য:দীনেন্দ্রকুমার রায় (২৬ আগস্ট ১৮৬৯ – ২৭ জুন ১৯৪৩)- খ্যাতনামা লেখক, পত্রিকা সম্পাদক এবং অনুবাদক সেকালের মেহেরপুর- পর্ব-৩ -:দীনেন্দ্রকুমার রায়
১২৮০ সালের মাঘ মাসে আমরা মুখুয্যে পাড়ার পৈতৃক ভিটা ছাড়িয়ে নুতন বাড়ীতে আসিলাম। যে জমীতে এই বাড়ী নির্ম্মিত হইয়াছিল, তাহা আমাদের পূর্বপুরুষগণের লাখেরাজ | আমার কাকার কাছে নাটোরের প্রাতঃস্মরণীয়া মহারানী ভবানীর নাম-স্বাক্ষরিত একখানি দানপত্র দেখিয়াছিলাম । তাহা হরিদ্রাভ তুলট কাগজে লেখা । তাহার মাথার দিকে 'শ্রীরানী ভবানী' এই স্বাক্ষর ছিল। মোটা মোটা অক্ষর : কতকাল পূর্বের লেখা ; কিন্ত কালী জল জল করিতেছিল । জানি না, নাটোরের এই সম্পত্তি কতদিন পরে কি উপলক্ষে কাশিমবাজার জমীদারীর অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল । আমাদের নৃতন বাড়ীর সীমার মধ্যে অনেকগুলি আম-কাঁটালের গাছ এবং কতকগুলি খেজুরগাছ ছিল । বাড়ীর পর্বব ও পশ্চিম সীমায় কয়েক ঝাড় বাঁশ ছিল। তখন শীতকাল । নবীন বাগ্দী নামক একজন 'গাছী' আমাদের বাড়ীর খেজুর গাছগুলি চাঁচিয়া তাহা হইতে রস সংগ্রহ করিত । নবীন এক একদিন সায়ংকালে আমাদিগকে এক এক ঘটি 'জিরেন কাটে'র রস উপহার দিয়া যাইত । শীতের সন্ধ্যায় সেই রস পান করিয়া আমাদের বুকের ভিতর কাঁপুনী ধরিত। আমরা গৃহকোণে মৃত্প্রদীপের আলোকে পুরু কাঁথায় সব্বাঙ্গ আবৃত করিয়া শয্যায় শুইয়া পড়িতাম । দীর্ঘ শীতের রাত্রি সুখস্বপ্নের ন্যায় কাটিয়া যাইত | এই জীবন-সন্ধ্যায় নিরুদ্বেগ শৈশবের সেই সুখময় সন্ধ্যার কথা স্মরণ হইলে কি এক অব্যক্ত বেদনায় বুক টন্-টন্ করিয়া উঠে। যাঁহাদের ল্লেহে ও আদর-যত্রে মানুষ হইয়া উঠিয়াছিলাম, আজ তাঁহারা কোথায় ? যৌবনে যাঁহাদিগকে লাভ করিয়ছিলাম, তাঁহারাই বা আজ কোথায় ? সকলই স্বপ্ন মনে হয় আমাদের বাসগৃহগুলি ছিল মার্টী-কোঠা ৷ একালে পল্লী-শ্রামের গৃহস্থ-বাড়ীতে সেরূপ মার্টী-কোঠা কদাচিৎ দেখিতে পাই । একালে যাহাদের আর্থিক অবস্থা একটু স্বচ্ছল, তাহারা ছোটখাটো ইস্টকালয়, অভাবে টিনের ঘর নির্ম্মাণ করিয়া বাস করে । মধ্যবিত্ত গৃহস্থের বাড়ীতে উলুখড়ের ছাউনিও প্রায় উঠিয়া গিয়াছে ; কারণ, তাহাতে যথেষ্ট অসুবিধা ছিল। প্রথমতঃ অগ্নিভয় ৷ সেকালে গোপপল্লীতে শীতকালে গরুর ঘরে সীঁজাল দেওয়া হইত । শুষ্ক কাঠ, ঘাস স্তুপীকৃত করিয়া তাহাতে অগ্মি-সংযোগ করা হইত । সেই অগ্নির উত্তাপে গরু-বাছুরের শীত নিবারণ হইত ; দরিদ্র গৃহস্থরা সায়ংকালে সেই অগ্নিকৃণ্ডের চারিদিকে বসিয়া সুখ-দুঃখের গল্প বলিত, এবং কলিকায় 'দা-কাটা' তামাক সাজিয়া তৃপ্তির সহিত ধূমপান করিত । কিস্তু তাহাদের অসতর্কতায় কখন কখন সাঁজালের আগুন গো-শালার বাঁশের বেড়ায় ধরিয়া যাইত, অবশেষে তাহা গো-শালার মট্কায় উঠিয়া বায়ুবেগে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িত, এবং পল্লীর বছ গৃহ ভস্মস্তূপে পরিণত হইত, কখন কখন গৃহস্থ-রমণীরা ধন সিদ্ধ করিতে বসিয়াও এইরূপ বিভ্রাট ঘটাইত | যেখানে ধান সিদ্ধ হইত, তাহার অদূরে পাটকাটীর স্তপ, আশে-পাশে বিচালীর গাঁদা । কৃষক-রমণী কোন কারণে উঠিয়া গিয়াছে, সেই সময় উনানের আগুন পাটকার্টীতে ধরিয়া বিচালীর স্তুপ বিধ্বস্ত করিত, এবং ভ্বলস্ত বিচালী উড়িয়া বাসগৃহের চালে পড়িত, তাহার পর সমগ্র পল্লী অগ্নিময় হইয়া উঠিত । প্রতি বৎসর এই ভাবে বহু সংখ্যক চাষী গৃহস্থকে সর্বস্বান্ত হইয়া পথে বসিতে হইত । ঘরের চালে আগুন লাগিলে তাহাতে শুষ্ক বাঁশের সাজ জ্বলিয়া উঠিত, দুম্দাম্ শব্দে উখো' অর্থাৎ বাঁশের শু রস্থিগুলি ছুটিয়া প্রতিবেশীর গৃহের চালে পড়িত ও “মট্কা'য় সেই আগুন জ্বলিয়া উঠিত। গৃহস্থরা ঘরের চালগুলি অগ্নিমুখ হইতে রক্ষা করিবার জন্য চালের উপর কলাপাতা, মানগাছের পাতা, ভিজা কাঁথা প্রসারিত করিয়া কলসপূর্ণ জল লইয়া ঘর মটকার পাশে বসিয়া থাকিত, তথাপি “উখো'র আগুন হইতে চাল রক্ষা করিতে পারিত না । কাহারও ঘরে আগুন লাগিলে তাহার প্রতিবেশীরা সেই অগ্মি নিব্বাণের চেষ্টা না করিয়া স্ব-স্ব ঘর বাঁচাইবার চেষ্টা করিত ; কিন্তু সম্মিলিত চেষ্টার অভাবে প্রায় কাহারও ঘর অগ্নিমুখ হইতে রক্ষা পাইত না। বিশেষতঃ পাড়ার দুই চারিটা কূপের জলে পল্লীব্যাপী অগ্নি নিব্বাপিত হইত না। চল্লিশ-পঞ্চাশ ঘড়া জল তুলিবার পর কৃপগুলিতে আর ঘড়া ডুবিত না। তখন নিরুপায় পল্লীবাসীরা মাথায় হাত দিয়া কাঁদিতে বসিত। তাহাদের মর্ম্মভেদী ক্রন্দনে পল্লী প্রতিধ্বনিত হইত। গৃহস্থিত আসবাবপত্র ও তৈজসপত্রাদি রক্ষা করিবার জন্য অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল অবস্থাপন্ন গৃহস্থরা মাটীকোঠা নিম্মাণ করিত। মাটীর দেওয়াল, সেই দেওয়ালের উপর কাঠের “আড়া' (কড়ি)। পল্লীগ্রামের গৃহস্থী কাঁটাল-গাছের, জাম বা কড়ুই গাছের গুড়ি চিরিয়া এই সকল 'আড়া' প্রস্তুত করিত । অতি অল্প সংখ্যক গৃহস্থেরই শাল কাঠের আড়া ব্যবহারের সৌভাগ্য ঘটিত; সাধারণতঃ অট্রালিকাতেই শালকাঠের আড়া ব্যবহৃত হইত ; কারণ, পল্লী অঞ্চলে শালকাঠের আড়া দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য ছিল । আমাদের ঘরগুলিতে কাঁটাল-কাঠের আড়া ছিল । মাটীর দেওয়ালের উপর প্রত্যেক ঘরে ছয়টি বা আটটি আড়া প্রসারিত থাকিত, তাহার উপর খাটালে খাটালে আম, জাম, কাঁটাল-কাঠের তক্তা পাতিয়া গৃহের অভ্যন্তর ভাগে দেওয়া হইত | সেই তক্তার উপর কয়েক ইঞ্চি পুরু মা্টীর আবরণ থাকিত | তাহার উপর উলুখড়ের চাল । খড়ের ভিতর অগ্নি প্রবেশ করিতে না পারে, এ জন্য দ্বার-জানালার সমান আকারে “মাটীঝাপা' প্রস্তুত রাখা হইত | কতকগুলি বাঁশের বাখারী পর পর সাজাইয়া সেগুলি রজ্জুবন্ধ করা হইত, এবং তাহার উপর পুরু করিয়া মাটী লেপিয়া তাহা শুকাইয়া রাখা হইত । পল্লীর কোন বাড়ীতে অগ্নিকাণ্ড হইলে “মার্টী কোঠা'র মালিক সেই সকল “মাটীঝাঁপা' দ্বারা রুদ্ধ দ্বার-জানালা আচ্ছাদিত করিত এবং তাহাদের কিনারাগুলি কাদা দিয়া ছার-জানালার প্রান্তবর্তী দেওয়ালের সঙ্গে আঁটিয়া দিত | ঘরের চাল ও চালের নিম্নস্থিত বাঁশের সাজ ভম্মীভূত হইলেও ঘরের ভিতরে কোন সামন্ত্রী নষ্ট হইত না। অগ্নিকাণ্ডের পর দ্বার-জানালা হইতে “মার্টীঝাঁপা' অপসারিত হইত, এবং মাটীকোঠার উপর পুনব্বরি বাঁশের সাজ দিয়া, উলুখড় দ্বারা তাহা ছাইয়া লওয়া হইত | সেই সকল বাঁশের সাজ গর্তের জলে পচাইয়া লওয়ায় সেগুলি দীর্ঘস্থায়ী হইত এবং তাহাতে সহজে ঘুন ধরিত না। এই সকল মাটী-কোঠায় কাঠের খুটি ব্যবহৃত হইত | কাঠের খুটি ব্যয়সাধ্য বলিয়া অনেকে বাঁশের মোটা খুটি ব্যবহার করিত ; কিন্তু বাঁশের খুটি মধ্যে মধ্যে পরিবর্তনের প্রয়োজন হইত | খড়ের চালের অন্য অসুবিধাও ছিল ; প্রবল ঝড়ে তাহ উড়িয়া যাইত, বষকালে অধিক বৃষ্টি হইলে খড়গুলি পচিয়া যাইত ; উই পোকাতেও চাল নষ্ট করিত | খড়ের ঘরের এইসকল অসুবিধা ছিল বলিয়া অনেক গৃহস্থ বহু কষ্টে কিছু কিছু অর্থ সঞ্চয় করিয়া দুই একখানি “পাকাঘর' নিম্মাণ করিত । এইরূপে গত কয়েক বৎসরের মধ্যে আমাদের গ্রামে বহুসংখ্যক অট্টালিকা নির্মিত হইয়াছে । নবীন বাগ্দী শ্বীতকালে গুড় প্রস্তুত করিবার জন্য শতাধিক খেজুরগাছ 'কাটিত' । গৃহস্থ প্রত্যেক গাছের খাজানা স্বরূপ দুই সের খেজুর গুড় পাইত । সেই দুই সের গুড় দিয়া সে কার্তিক মাস হইতে ফাল্গুনের শেষ পর্যন্ত রস লইত | তিন দিন রস গ্রহণের পর তিন দিন গাছকে বিশ্রাম বা “জিরেন' দেওয়া হইত । চতুর্থ দিন যে রস সঞ্চিত হইত, তাহাই “জিরেন কাটে'র রস। সেই রস অতি মধুর | খেজুরের চারা-গাছের রস অপেক্ষা পরিণত বয়স্ক বৃক্ষের রস অনেক অধিক মিষ্ট ; তাহার পরিমাণও অধিক হইত । কোন কোন সতেজ গাছে এক রাত্রিতে প্রায় এক ঠিলি রস সঞ্চিত হইত । নবীন শীতকালে বেলা প্রায় তিনটার সময় গাছ বাঁধিতে আসিত | একগাছ৷ মোটা দড়ি মালার মত তাহার দুই কাঁধে ঝুলিত ; মনে হইত, তাহার উভয় স্কন্ধ বেষ্টন করিয়া একটা “দাঁড়াস' (টোঁড়া) সাপ ঝুলিতেছে। সে মালকৌচা আঁটিয়া কাপড় পরিত এবং অদ্ধহস্ত বিস্তৃত লোমাবৃত ছাগচম্ম কোমর-বন্ধের মত কোমরে জড়াইত ; তাহাতে আবদ্ধ চর্ম্মনি্মিত একটি থলি তাহার পশ্চাতে ঝুলিত । সেই থলির ভিতর বক্রমুখ তীক্ষধার কাটারী ও দুই চারিটি কঞ্চির নলি থাকিত । কঞ্চি চিরিয়া পাঁচ ছয় ইঞ্চি দীর্ঘ এক একটি নলি প্রস্তুত করা হইত । উক্ত থলির সঙ্গে কাষ্ঠনিম্মিত একটা বাঁকা 'ছুক' থাকিত ; নবীন খেজুরগাছে যে বিলি বাঁধিত, সেই বিলির গলার দড়ি সেই হুকে বাধাইয়া সে গাছে উঠিত কিন্তু গাছে উঠিবার সময় দুই হাত লম্বা একটি বংশদণ্ড তৎসংলগ্ন দীর্ঘরজ্জু তাহার সঙ্গে থাকিত । তাহার পর কাঁধে যে মোটা দড়ি থকিত, তাহা কাঁধে লইয়াই সে গাছে উঠিত : তাহার পর দুই হাত দীর্ঘ বংশদণ্ডটি গাছের সঙ্গে আড় করিয়া বাঁধিয়া তাহার দুইপাশে দুই পা রাখিয়া দাঁড়াই, এবং সেই মোটা দড়ি দিয়া গাছের সঙ্গে শরীর আবদ্ধ করিত ; সেই সময় সে পশ্চাতে ঈষৎ হেলিয়া পড়িত ও সেই ভাবে দাঁড়াইয়া ঠোঙ্গা হইতে কাটারী বাহির করিয়া গাছের হুক অপসারিত করিত । কিছুকাল চাঁচিবার পরস্থল “চৌচা অপসারিত হইলে ক্ষতস্থানে বিন্দু বিন্দু রস দেখা যাইত ; তখন সে বাঁশের নলিটি ঢালু করিয়া তাহাতে বিধাইয়া দিত । অতঃপর চামড়ার ঠোঙ্গাসংলগ্প আংটা হইতে মাটীর ঠিলি খুলিয়া লইয়া রজ্জুদ্বারা তাহা নলির নীচে ঝুলাইয়া দিত । নলি দিয়া রস গড়াইয়া বিন্দু বিন্দু করিয়া তাহা সারারাত্রি সেই ঠিলিতে সঞ্চিত হইত । ঠিলিটি নলির মুখ হইতে কোন কারণে সরিয়া যাইতে পারে, এই আশঙ্কায় সে খেজুর গাছের পশ্চাঘর্তী শাখা টানিয়া সম্মুখে আনিয়া তাহা চিড়িয়া তন্দ্ারা ঠিলির গলা গাছের সঙ্গে বাঁধিয়া রাখিত । তাহার ঠোঙ্গায় কখন কখন চাকা চাকা করিয়া কাটা মানকচু থকিত ; সে তাহা কোন কোন ঠিলির ভিতর ফেলিয়া রাখিত । সন্ধ্যার পর খ্রামের দুষ্ট ছেলেরা কোন খেজুর গাছে উঠিয়া রস চুরি করিত ; কিন্তু ঠিলিতে মানকচু থাকিলে কেহ সেই রস চুরি করিত না । মানকচু-সিক্ত রস পানের অযোগ্য | তাহা পান করিলে গলা কুট্কুটু করে। নবীন রাত্রিশেষে অন্ধকার থাকিতেই খেজুর গাছ হইতে ঠিলি খুলিয়া লইয়া যাইত । একখানি বাঁশের বাঁকের দুই ধারে রসপূর্ণ ঠিলিগুলি ঝুলাইয়া লইয়া সে তাহার “বাইনে' উপস্থিত হইত | সে ঠিলি সংগ্রহের জন্য গাছে উঠিবার সময় তাহার “ইউনিফত্্' সঙ্গে রাখিত না কেবল গাছ কাটিবার বা ঠেঁচিবার সময় এ সকল সরঞ্জাম সঙ্গে রাখিবার প্রয়োজন হইত । সে বাঁকের দুই দিকে দশ বারোটা ঠিলি ঝুলাইয়া লইতে পারিত । রস-সংগ্রহের জন্য এই সময় তাহাকে দুই একটি এপ্রেন্টিস বা সহকারী রাখিতে হইত ; তাহরাও ঠিলি পাড়িয়া বাইনে লইয়া আসিত, পারিশ্রমিক স্বরূপ কিছু কিছু গুড় পাইত । তাহারা নানাভাবে নবীনকে সাহায্য করিত । আমরা তখন বালকমাত্র ; নবীনের বাইনের টাট্কা গুড়ের লোভ সংবরণ করিতে পারিতাম না । বেলা আটটা না বাজিতেই আমরা পাড়ার একপাল ছেলে শীতবস্ত্রে সববঙ্গি আচ্ছাদিত করিয়া নবীনের বাইনে উপস্থিত হইতাম । তখনও সুলভ মূল্যের 'র্যাপার' বা রেল যারা পানিলা দা রেস ররর ছল না। নবীন একখানি জীর্ণ অনুচ্চ খড়ের ঘরে বাস করিত । তাহার ঘরে মাটীর প্রাচীর ছিল না ;প্রাচীরের পরিবর্তে চারিদিকে কঞ্চির বেড়া, তাহার উপর গোবর-মিশ্রিত মাটীর প্রলেপ । এই কুটারের এক পাশের চাল-সংলগ্ন একখানি পর-চালা । সেই “পরচালা'খানি তাহার“টেকিশালা' ব “টিসকেল' ।-_সে চাবী গৃহস্থ ; দুই এক বিঘা জমী চষিত, তাহাতে যে ধান পাইত, তাহা হইতে চাউল প্রস্তুত করিবার জন্য তাহার বাড়ীতে টেকি না রাখিলে চলিত না । তাহার আঙ্গিনাখানি ধূলাবর্জিত পরিচ্ছন্ন । তাহারই এক প্রান্তে উনন, সেই উননে ধান সিদ্ধ হইত : বন্ধনের কাজও চলিত | আঙ্গিনার এক পাশে বাঁশের খুটিতে শিমের প্টাল' | তাহার শিমগাছে প্রচুর শিম ফলিত । অদূরে একটি গ্লেপে গাছ, কয়েকটা লঙ্কা-মরিচের গাছ, এক ঝাড় বাঁশ, একটা কাঁটালগাছ । তাহার বাড়ীর চারিদিকে জামাল-কোটার বেড়া ৷ সেই বেড়া ধেসিয়া তাহার গুড়ের 'বাইন' | গুড় প্রস্তুতের স্থানটির নাম বাইন | একটি বড় গর্ত খুঁড়িয়া রস জ্বাল দেওয়ার জন্য সেই 'বাইনে' উনন করা হইয়াছিল । বাইনের চারিদিকে বাঁশের খুটি, তাহার উপর খর্জুর-পত্রের আচ্ছাদন । উননের একপাশে রসের ঠিলিগুলি শ্রেণীবদ্ধভাবে সাজাইয়া রাখা হইত । নবীন উননে একখানি বৃহৎ মাটীর 'খোলা' চাপাইয়া তাহাতে সকল ঠিলির রস ঢালিয়৷ দিত তাহার পর শুক আস্যাওড়া, ভাট, কালকাশিন্দা প্রভৃতি আগাছা ছারা রস জ্বাল দিত । এই গুলপগুলি সে নানা স্থান হইতে কাটিয়া আনিয়া শুকাইয়া বাইনে সঞ্চিত রাখিত । রস অগ্রির উত্তাপে ঈষৎ ঘন ও লোহিতাভ হইলে তাহাকে “তাতরসা' বলা হইত । পল্লীরমণীদের অনেকে ঘটী আনিয়া নবীনের নিকট হইতে সেই রস চাহিয়া লইয়া যাইত । উহা ছ্বারা উৎকৃষ্ট পায়স হয়। শীতকালে অনেকেই রসের পায়স রাঁধিত। দুই ঘণ্টার মধ্যে খোলার রস ঘন গুড়ে পরিণত হইত । গুড় ঘন হইলে নবীন খোলা নামাইয়া তাহার ভিতর গুড়ের 'বীজ' দিত । এ 'বীজ' শুষ্ক গুড় ভিন্ন অন্য কিছুই নহে। খেজুর-শাখার দণ্ড ছ্বারা সেই শু গুড় খোলার গায়ে মাড়িয়া খোলার গুড়ের সহিত তাহা মিশ্রিত করিলে খোলার গুড় বেশ ঘন হইত | তখন নবীন ঠিলিগুলির মুখ একখানি ময়লা কাপড় দিয়া ঢাকিয়া এক এক হাতা গুড় ঠিলির মুখের কাপড়ের উপরে ঢালিয়া দিত, কয়েক মিনিটের মধ্যে তাহা জমিয়া শক্ত হইত | বাতাসার আকার-বিশিষ্ট সেই গুড় “সরাগুড়' বা 'গুড়মুচি' নামে প্রসিদ্ধ । নবীনের গুড় ভ্বাল দেওয়া শেষ হইলে সে আমাদের পাতা আনিতে বলিত ; আমরা জামাল-কোটার পাতা সংগ্রহ করিয়া তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইতাম । সে প্রত্যেক পাতায় অল্প-পরিমাণ গুড় দান করিত | আমরা পরম তৃপ্তির সহিত তাহা লেহন করিতে করিতে বাড়ী ফিরিতাম । নবীন তাহার “সরাগুড়' গুলি “কুলোয়' বা ডালায় তুলিয়া রাখিয়া রস সংগ্রহের ঠিলিগুলি সেই উননের চারিদিকে উপুড় করিয়া সাজাইয়া রাখিত । ঠিলিগুলি এইভাবে তাতাইয়া লইলে সঞ্চিত রস ভাল থকে । নবীন সরাগুড়গুলি কুলোয় সাজাইয়া লইয়া বাজারে বিক্রয় করিতে যাইত । প্রত্যেকখানির মূল্য এক পয়সা । তাহার গুড় ফরসা হইত, স্বাদও ভাল হইত ; এ জন্য তাহার “সরাগুড়' গুলি শীঘ্রই বিক্রয় হইত । কোন কোন 'গাছী' গুড় ভ্বাল দেওয়ার সময় তাহাতে সোডা মিশাইয়া গুড় ফরসা করিত ; কিন্তু তাহাতে গুড়ের স্বাদ বিকৃত হইত | নবীন গুড়ে সোডা মিশাইত না । কখন কখন মশলা-চুর্ণ মিশাইত । আমাদের বাড়ীর কয়েক শত গজ উত্তরে কালী-বাজার | গ্রাম্য দেবতা মা কালীর বাসগৃহ এই বাজারের পূর্বেব সংস্থাপিত | তীহারই নামানুসারে বাজারটি “কালী-বাজার নামে পরিচিত | সাহেব জমীদার-কোম্পানী এই বাজারের মালিক। জমীদার-কোম্পানী প্রতি বৎসর স্থানীয় কোন লোককে বাজার ইজারা-বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া থাকেন। যাহারা বাজারে শাকশজী ও মাছ তরকারী বিক্রয় করে, তাহাদের নিকট হইতে বহু লোক তোলা আদায় করে। জমীদারের “ইজারাদার, তোলা লইয়া প্রস্থান করিলে বাজার-পরিষ্কারক মেথর তোলা লইয়া গেল; তাহার পর আসিলেন- -কালীমন্দিরের সেবাইত' (পুরোহিত) ; মা কালীর প্রাপ্য তোলায় তাঁহারই অধিকার | তিনি তাহা বিক্ষয় করিয়া মা কালীর পৃজার উপাদান সংগ্রহ করেন । শনি-মঙ্গলবারে মা কালীর পৃজা উপলক্ষে বহু দূরবর্তী গ্রাম হইতে অনেক ভক্ত নর-নারীর সমাগম হইয়া থাকে ; তাহারা নির্জলা দুধ, নানা প্রকার ফল-মূল, ছানা, ক্ষীর, চিনি, সন্দেশ দিয়া মা কালীর পূজা দিয়া যায়। তাহা বিক্রয় করিয়া পরমসুখে পুরোহিত মহাশয় পরিবার প্রতিপালন করিয়া আসিতেছেন । তাঁহার তোলা লওয়া শেষ হইলে আসিলেন “সাতালয়ের-দরগার' ফকির । পীরের দরগায় সিড়ি দেওয়ার জন্য তাঁহারও তোলা তুলিবার অধিকার আছে । শুনিয়াছি, আরও দুই একজন গায়ের জোরে তোলা লইয়া যায়। বাজারে তাহাদের জুলুম চলে । এই কালী মন্দিরের অদূরে মহাদেবের এক মন্দির আছে । সেই মন্দিরস্থিত শিবলিঙ্গ নাকি বহুদিন পূর্বের বর্গীবা (মারাঠা দস্যুরা) প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন । নবাব আলিবর্দী খার আমলে বর্গীরা মেহেরপুর লুঠ করিতে আসিয়াছিল-__এইরূপ জনশ্রুতি প্রচলিত আছে; কিন্ত তাহাদের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত কবির কি প্রয়োজন হইয়াছিল, তাহা কেহ বলিতে পারে না। কথিত আছে, বহুকাল পূর্বে মুরশিদাবাদের কোন নবাব শিকার উপলক্ষে নদীপথে মেহেরপুর আসিয়াছিলেন । মেহেরপুরের প্রান্তবাহী ভৈরবের অবস্থা তখন শোচনীয় হয় নাই ; ভৈরব তখন বিশাল আকারে ভৈরব ছিল | নবাবের বজরাগুলি ভৈরব তটে নঙ্গর করা হইলে রাত্রিকালে সহসা এরূপ ঝড়-বৃষ্টি ও দুর্যোগ আরস্ত হইল যে, নবাব পারিষদ-বর্গ সহ বজরায় বাস করা নিরাপদ মনে করিলেন না। প্রচণ্ড ঝটিকায় বজরা ডুবিবার উপক্রম দেখিয়া নবাব বাহাদুর সদলে বজরা ত্যাগ করিয়া তীরে উঠিলেন। নদীতীরে কিছুদূরে এক ঘর সমৃদ্ধ গৃহস্থের বাস ছিল । গৃহস্বামিনীর নাম রাজু ঘোষানী । এই গোপাঙ্গনার খোঁয়াড়ে বিস্তর গো-মহিষ ছিল । দুগ্ধের ব্যবসায়ে তাহার আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল হইয়াছিল । সে অতিথিবৎসল ছিল এবং নিরাশ্রয় গরীব-দুঃখীকে অন্ন বিতরণ করিত | মা কমলা তাহার প্রতি প্রসন্না ছিলেন । সেই ঘন-ঘোর রাত্রিতে দারুণ দুর্যোগের মধ্যে নবাব বাহাদুর রাজু ঘোষানীর গৃহদ্বারে উপস্থিত হইয়া আশ্রয় প্রার্থনা করিলে, রাজু নবাবের পরিচয় জানিতে না পারিলেও পরম সমাদরে অতিথি-সংকার করিয়াছিল । উৎকৃষ্ট সরু ধানের সুগন্ধযুক্ত চিড়া, “শুকো” দই, পাকা মর্তমান কলা এবং সুস্বাদু গুড় দ্বারা সে নবাব ও তাঁহার অনুচরবর্গের ক্ষুধা-নিবৃত্তি করিয়া সেই রাত্রিতে তাহাদিগকে তাহার গৃহে আশ্রয় দান করিয়াছিল । বিপন্ন নবাব রাজু ঘোষানীর গৃহে অতিবাহিত করিয়া পরিতৃপ্ত ঘোষানীরকে পুরস্কার দানের জন্য তাঁহার আগ্রহ হইল। নবাব বাহাদুর পরদিন প্রভাতে দেখিলেন, ঝড়-বৃষ্টি বন্ধ হইয়াছে, আকাশ নির্মল, আর কোন দুর্যোগের আশঙ্কা ছিল না । নবাব রাজুর নিকট বিদায় গ্রহণের সময় রাজুকে নিজের পরিচয় দিয়া তাহার উপকার করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন । এ কাল হইলে রাজু তাহার সহৃদয়তার পুরস্কার স্বরূপ হয়ত একখানি “সার্টিফিকেট অফ অনর' বা তাহার পুত্র “রায় বাহাদুর অথবা এরকম খেতাব ছাড়া সম্বর্ধিত হইত ; কিন্তু সে কালের নবাব-বাদশাহদের বুদ্ধি কিছু স্থুল ছিল, তাঁহাদের পুরস্কার দানের প্রণালীও বিভিন্ন রকম ছিল । নবাব বাহাদুরের আদেশ শুনিয়া রাজু ঘোষানী করজোড়ে নিবেদন করিল, তাহার পরম সৌভাগ্য যে, সে এক রাত্রি নবাব বাহাদুরের সেবা করিয়া ধন্য হইতে পারিয়াছিল ; সে গৃহস্থের কর্তব্য পালন করিয়াছিল । সে সাধারণ গৃহস্থ রমনী, নবাব বাহাদুরের মর্যাদা রক্ষা করিতে পারে, সে শক্তি তাহার নাই ; এ জন্য সে কুষ্ঠিত। সে কোনরূপ পুরস্কার গ্রহণে সম্মত হইল না। যাহা হউক, অনেক পীড়াপীড়ির পর সে অবশেষে বলিল, তাহার বিস্তর গরু-বাছুর ও মহিশ আছে, কিন্তু সেগুলিকে সে চরাইতে পারে, এরূপ বিস্তৃত গোচারণ ক্ষেত্র নাই । নবাব ইচ্ছা করিলে তাহাকে গোচারণের উপযুক্ত কিছু জমী দান করিতে পারেন । সেই জমীতে তাহার গরুর পাল চরিয়া বেড়াইবে । * অতঃপর নবাব বাহাদুরের আদেশে রাজু ঘোষানীর গো-চারণের জন্য বিনা করে একটি বৃহৎ পরগণা প্রদত্ত হইল ; রাজু ঘোষানীর নামানুসারে এখন সেই পরগণা “রাজপুর পরগণা' নামে পরিচিত । রাজু ঘোষানী বিনা করে এই সুবিস্তীর্ণ ভূসম্পত্তি পাইয়া অল্পদিনে বহু অর্থের অধিকারিণী হইল । তাহার আর্থিক অবস্থা পূর্বেই স্বচ্ছল ছিল, এইবার সে রাজার মত সমারোহে বাস করিতে লাগিল । রাজু ঘোষানীর মৃত্যুর পর তাহার উত্তরাধিকারীরা “গোয়ালা চৌধুরী' নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন । তাঁহারা মেহেরপুরে একটি গড় নির্ম্মাণ করেন । সেই গড় এখন বর্তমান নাই, কিন্তু যে স্থানে সেই গড় নির্মিত হইয়াছিল, সেই স্থান এখনও “গড়বাড়ী' নামে পরিচিত । তাহা “গড়ের পু্করিণী' নামে পরিচিত এবং এখন তাহা মিউনিসিপালিটার সম্পত্তি, “রিজার্ভড ট্যাঙ্ক' । রাজু ঘোষানীর উত্তরাধিকারীরা দস্যুভয়-নিবারণের জন্য এই গড়ের নীচে একটি 'পাতালঘর' নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন ; সেই পাতালঘর কিরূপ দীর্ঘ ও কতদূর বিস্তৃত ছিল, তাহা জানিবার উপায় নাই। আমাদের বাল্যকালে এই গড়ের কিয়দংশ খুড়িয়া দেখা হইয়াছিল । শুনিয়াছিলাম, সেই সময় মেহেরপুরের কোন ইংরাজ সিভিলিঘান ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে এই কার্যা আরম্ভ হইয়াছিল ; কিন্তু তিনি সেই কাজটি শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই । তিনি কে, মিঃ এফ, এ, শ্যাক. কি, জে, ডি, এগু্ারসন-_তাহা স্মরণ নাই ; মিঃ এগুারসন বঙ্গসাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন ; তিনি ইন্দ্র সেন” বলিয়া নিজের নাম স্বাক্ষর করিতেন এবং ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরিত্যগ করিয়া অক্সফোর্ডে আমাদের দেশীয় ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হইয়াছিলেন ৷ তিনি সদাশয় ও দেশীয়দের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন রাজ-পুরুষ ছিলেন। আমরা বাল্যকালে গড়-বাড়ীর ভূগর্ভস্থ অংশ কিছু কিছু পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছিলাম | ছোট ছোট পাতলা ইট বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল । তাহা দেখিয়া পাতালঘরের ছাদ বলিয়াই মনে হইয়াছিল, কিন্তু ছাতের নীচে যে অংশ ছিল, তাহা কোন দিন খুঁড়িয়া দেখা হয় নাই। দীর্ঘকাল তাহা একই ভাবে পড়িয়াছিল। এতকাল পরে তাহা খুড়িয়া দেখিলে পাতালঘরের অনাবিষ্কৃত অংশের সন্ধান হইতে পারে ; কিন্তু সে জন্য আর কেহ কোন চেষ্টা করেন নাই । বর্তমান মিউনিসিপাল অট্রালিকার অদূরে 'কালাচাঁদ মেমোরিয়াল' হলের পূর্বে যেখানে এখন একটি ছোটখাট কাঁটাল বাগানের অস্তিত্ব বিরাজিত, এবং যাহার ছায়ায় মিউনিসিপালিটীর অনুগ্রহে একটি ক্ষুদ্র উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছে, সেই স্থানে মাটীর নীচে উল্লিখিত পাতালঘরের অস্তিত্ব বর্তমান ছিল | এখন তাহা সমভূমিতে পরিণত হইয়াছে । রাজু ঘোষানীর বংশধররা দীঘি খনন করাইয়া তাহার পশ্চিম পার্থে পাতালঘর নির্ম্মাণ করাইলেও তাঁহারা সেখানে সর্বদা বাস করিতেন না; প্রায় তিন মাইল দক্ষিণে অবস্থিত আমদহ নামক গ্রামে তাঁহারা প্রাসদোপম বাসভবন নির্ম্মাণ করাইয়া সেই স্থানে বাস করিতেন । এখন সেখানে তাঁহাদের বাস্তৃভিটার চিহ্নমাত্র নাই : একটা জলাশয়ের ধারে একটি উচ্চ টিপি সেই অট্টালিকা অস্তিত্বের স্মৃতি বহন করিতেছে; কিন্তু প্রায় দুইশত বৎসর পূর্বে যেখানে প্রাসাদোপম অক্টালিকা ছিল-_সেই স্থানের অবস্থা দেখিয়া তাহা অনুমান করা কঠিন । কৃষকরা এখন সেখানে ধান্য এবং অরহর, সর্ষ, ছোলা প্রভৃতি রবিশস্যের আবাদ করে | আমার ভ্রাতা শ্রীমান সুরেন্দ্রনাথ সেই টিপির ভিতর হইতে বিস্তর অনুসন্ধানের ফলে দুইখানি ইঞ্টক আবিষ্কার করিয়াছিলেন ; তাহাতে দেবনাগরী হরপে কাহারও নামের আদ্যক্ষর লিখিত ছিল । এই সকল স্থান প্রত্ুতত্ববিদ্গণের গবেষণার যোগ্য । শুনিয়াছি, গোয়ালা চৌধুরীদের আমদহের এই বাসভবনের সহিত মেহেরপুরস্থ উক্ত পাতালঘরেব যোগ ছিল । তাঁহারা সুড়ঙ্গপথে তাঁহাদের বাসভবন হইতে অন্যের অদৃশ্য ভাবে গড়ের পাতালঘরে যাইতে পারিতেন । দস্যুর আক্রমণ হইতে ধন-সম্পত্তি রক্ষা করিবার জন্য তাহারা তাঁহাদের টাকা, মোহর ও অলঙ্কারাদি উক্ত পাতালঘরে লুকাইয়া রাখিতেন । বিপদের সম্ভাবনা দেখিলে তাঁহারা সপরিবার সুড়ঙ্গপথে পাতালঘরে আশ্রয় গ্রহণ করিতেন, এরূপ কিংবদস্তীও বাল্যকালে শুনিতে পাইতাম । নবাব আলিবদী খাঁর রাজত্বকালে বর্গীর দল তাহাদের অন্যতম অধিনায়ক ভাস্কর পণ্ডিত দ্বারা পরিচালিত হইয়া পুনঃ পুনঃ বঙ্গদেশ আক্রমণ করিয়াছিল ; তাহারা দক্ষিণ বঙ্গের বনু পল্লী লুঠিত ও বিধ্বস্ত করিয়াছিল-_ইহা কাল্পনিক কাহিনী নহে । “ছেলে ঘুমুলো, পাড়া জুড়ুলো, বর্গী এল দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে ?”__ ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়াইবার এই ছড়া বাল্যকালে বহু পল্লীগৃহিনীর মুখে সর্বদাই শুনিতে পাইতাম । আমাদের গ্রামে এই ছড়ার প্রভাব একটু বেশীই ছিল । মেহেরপুর অঞ্চলেও বর্গী দস্যুর শুভাগমন হইয়াছিল । তাহাদের আগমন-সংবাদ পাইয়া রাজু ঘোষানীর বংশধররা তাঁহাদের সঞ্চিত ধনসম্পত্তি সহ আমদহের বাসভবন হইতে পৃবেবাক্তি সুড়ঙ্গ পথে মেহেরপুরের গড়ের পাতালঘরে পলায়ন করিয়া সেই স্থানেই আশ্রয় গ্রহণ করেন । দস্যুরা তাঁহাদের বাসগ্ৰহের বিভিন্ন অংশ খুঁজিতে খুঁজিতে পাছে সুড়ঙ্গ-পথ দেখিতে পায় ও সেই পথে পাতালঘরে প্রবেশ করে, এই আশঙ্কায় তাঁহারা সেই পথ বন্ধ করিয়াছিলেন । মেহেরপুরস্থ গড়বাড়ীতে পাতালঘরে প্রবেশের ও তাহা হইতে বাহির হইবার একটি দ্বার ছিল । গৃহস্বামী পরিজনবর্গ সহ পাতালঘরে আশ্রয় গ্রহণ করিলে তাঁহাদের একজন বিশ্বস্ত ভৃত্য সেই দ্বার বাহির হইতে রুদ্ধ করিয়া গড়ের সন্নিহিত একটি প্রাচীন ও সুবৃহৎ তেতুলগাছে উঠিয়া লুকাইয়া থাকে । বর্গীরা তাঁহাদের আমদহের বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া জন প্রাণীকেও দেখিতে পাইল না, ধনাগারে ধনরত্বাদি কিছুই ছিল না । তাহারা অনুসন্ধানে জানিতে পারিল, মেহেরপুরের গড়ে তাঁহাদের যে বাড়ী আছে, তাঁহারা সেই স্থানে আশ্রয় লইয়াছেন । বর্গীর দল আমদহ হইতে মেহেরপুরে আসিয়া গোয়ালা চৌধুরীদের গড় আক্রমণ করিল ; কেহই তাহাদিগকে বাধা দিল না। কিন্তু তাহারা গড়ের ভিতর প্রবেশ করিয়া কোন গৃহে পুরবাসীদের সন্ধান পাইল না। অগতা তাহারা বিফলমনোরথ হইয়া মেহেরপুর ত্যাগ করিল । কিন্তু দুই একজন বর্গী দস্যু তখনও গড়ের সন্নিহিত বনের ভিতর ঘুরিতে লাগিল । যে বিশ্বস্ত ভৃত্য তেতুলগাছের ডালে বসিয়া গড়ের চারিদিক বর্গীদের দাপাদাপি ও লাফালফি লক্ষ্য করিতেছিল, সে যখন দেখিল, বর্গীরা বিফল মনোরথ হইয়া চলিয়া গিয়াছে, তখন সে ঠেতুলগাছ হইতে নামিয়া প্রভৃকে সুসংবাদ জানাইতে গড়ের দিকে অগ্রসর হইল | গ্রন্থনা:অধ্যক্ষ মহসীন আলী আঙ্গুঁর ,সম্পাদক ও প্রকাশক, মুজিবনগর খবর ডট কম,মেহেরপুর।Slider
দেশ
মেহেরপুর জেলা খবর
মেহেরপুর সদর উপজেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
যাবতীয়
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News
No comments: