মেহেরপুরের পিরোজপুর ইউনিয়নের সিংহাটি গ্রামের মরমী সাধক ও গায়ক আফসার উদ্দীন ফকিরের গানে আল্লাহ তত্ত্ব, নবিতত্ত্ব, মুর্শিদ তত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্বের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ( সাতষট্টি পর্ব )
আর্থিক সচ্ছলতা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত অনাগ্রহ, উদাসীনতা, গানের নেশার কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রাথমিক বিদালয়ের গন্ডিতেই পরিসমাপ্তি ঘটে। আফসার ফকিরের সিংহাটি গ্রাম-মেহেরপুর, গাংনী, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ঐ সমস্ত অঞ্চল মরমী সাধনারও কেন্দ্রস্থল। বেহাল শাহ, খোদা বকসো শাহ, আরজান শাহ, আজাদ শাহ, গোলাম ঝড়ু শাহ‘ ও অন্যান্য বাউল সাধকদের বসবাস ও সাধনক্ষেত্র এই অঞ্চলে। এদের প্রভাবে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গায় অসংখ্য বাউল সাধক ও মরমি কবির উদ্ভব হয়। এসব মরমি সাধক ও বাউল সংস্পর্শ আফসার উদ্দীনকে মরমি ভাবনায় উজ্জীবিত করে।অধ্যাত্ম সাধক, সুগায়ক, পদকর্তা ,আফসার উদ্দীন ফকিরের জন্ম উনিশ শত বিয়াল্লিশ সালে মেহেরপুরের পিরোজপুর ইউনিয়নের সিংহাটি গ্রামে। পিতা আহাদ আলী মন্ডল ছিলেন প্রভাবশালী জোতদার। এছাড়াও লালনশাহ, দুদ্দু শাহের গান তাকে শাস্ত্রাচার ও প্রথাগত ধর্মবিমুখ করে তোলে এবং খুঁজতে থাকেন নতুন জীবন দর্শনের সন্ধান। অচেনাকে চেনা, অজানাকে জানা এবং নব জীবনের সন্ধান করতে গিয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন কুষ্টিয়ার মীরপুর উপজেলাধীন শাকদহচর গ্রামের আকবর আলী শাহের। আফসার উদ্দীনের গুরু আকবর আলী ফকির একজন লালন ঘরানার সাধক এবং সুগায়ক। গুরুর অনুপ্রেরণায় তিনি লালনের গান ও মরমি দর্শনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তবে বাল্যকাল থেকেই তিনি ধর্ম বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু ও সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন। যাত্রাগান-হরিকীর্তন-বাউল গানের আসরে তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল। প্রথম যৌবনে তিনি চুয়াডাঙ্গা মিলনী অপেরায় পেশাদার শিল্পী হিসেবে যুক্ত হন। একটি পয়সা, অশ্র“ দিয়ে লেখা প্রভৃতি পালায় অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তীকলে যাত্রা ছেড়ে দিয়ে ধর্ম, শাস্ত্র, তত্ত্ব, দর্শন সম্পর্কে চর্চা ও সাধনায় নিমগ্ন হন। কিন্তু সমাজ ও সংসার তঁাঁকে এসব কাজে স¦ীকৃতি জানায় না, এমনকি স্ত্রী ও তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এসব থেকে তার মধ্যে বৈরাগ্য ভাবের উদয় হয় এবং গভীরভাবে লালন চর্চায় নিজেকে যুক্ত করেন। লালনের গানে তিনি খুঁজে পান আত্মার খোরাক এবং এতে খুঁজে পান জীবন-জগৎ সম্পর্কিত নানা প্রশ্নের সমাধান। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত দুই হাজার সয় সালে সালের -বারো ডিসে¤¦র আন্তর্জাতিক মেলায় গান গাইতে পারা তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে এই সাধক গায়ক মনে করেন। শক্তিনাথ ঝা, আবুল আহসান চৌধুরী, পূর্ণদাস বাউল, খেজমত খামারু তাঁর গানের প্রশংসা করেন। তিনি যখন একতারা, ডুগি বাজিয়ে ভরাট কন্ঠে লালনের গান শোনাচ্ছিলেন, তখন মঞ্চের সামনে বসেছিলেন শামসুজ্জামান খান, ফাদার মারিনো রিগন, সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়, যতীন সরকার, মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী সহ দুবাংলার প্রখ্যাত বাউল সাধকেরা। নাগরিক মঞ্চে গান গাওয়ার চেয়ে সাধুসঙ্গে গান গেয়ে আনন্দ পান বেশি। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান লালনসাঁই বটতলা মধুপূর্ণিমা সাধুসঙ্গ-১৪১৬ তে গান গাইতে পারা তাঁর জীবনে অনন্য পাওয়া বলে মনে করেন আফসার ফকির। আফসার ফকির কেবল গায়ক নন, পাশাপাশি তিনি একজন বলিষ্ঠ সাধক ও মরমি কবি। তিনি বেশ কিছু গান লিখেছেন, এসব গানে আল্লাহ তত্ত্ব, নবিতত্ত্ব, মুর্শিদ তত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্বের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আফসার ফকির নিজেকে এবং লালন সাঁইকে বাউল হিসেবে গন্য করতে নারাজ, তিনি লালনকে চিশতিয়া ধারার মরমি সাধক বলে মনে করেন। আফসারের গান বাউল তত্ত্বের চেয়ে মুর্শিদ-মারফত তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত। তার গানকে বাউল গান বলা যায় না, কারণ তাঁর গানে বাউল-বৈষ্ণবদের সহজিয়া ভাবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। রাধাকৃষ্ণ পদাবলীর উপমা এমনকি শতদল, সহস্রদল, ইড়া, পিঙ্গলা, সুষমা ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারও নেই। তবে তাঁর গানে রয়েছে উদাসী ও বৈরাগ্যের সুর। তার একটি গানে আছেঃ ‘দয়াল ডাকি তোমারে পড়ে অকূল পাথারে পার করো এ ভব তুফানেরে। তুমি তো দয়াল বন্ধু আমি অতি হীন। ডাকি তোমায় সকাতরে বসে নিশিদিন, তুমি দাও হে দেখা আমায় ওহে দয়াময়, পারের খেয়া লাগাও কিনারে।’ আত্মরূপের সন্ধানই বাউল বা মরমি সাধনার মূল কথা।‘মান আরাফা নাফসাহু, ফাকাত আরাফা রাব্বাহু’-এর মধ্যে মূলতঃ আত্মতত্ত্বের মর্মকথা অন্তর্নিহিত আছে। রূপ-স¦রূপের ভেদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আফসার ফকির একটি গানে বলেন: দিব্যজ্ঞানী নইলে কী তা দেখতে পাই, আব আতস খাক বাতের ঘরে, খোদে খোদা বারাম দেয়। নিরাকার নাম ধরে যে, আকার-সাকার রূপ ধরে সে, থাকে সে আদমে মিশে, কোরানে তার প্রমাণ রয়। আর নূরেতে ছিনা পয়দা, করিলেন মাবুদ খোদা, বাদ রূপেতে পীরে সেথা, চেতন করিল সাঁই। মান আরাফা নাফসাহু, ফাকাদ আরাফাত রাব্বাহু, নবিজির হাদিস লিখন, আফসার বলে মিথ্যা নয়। বাঙালির ধর্ম-সাহিত্য সংস্কৃতিতে নারী নানারূপে প্রকাশিত হয়েছে। বাঙালি নারী অবরোধবাসিনী হলেও তার প্রয়োজনীয়তাকে অস¦ীকার করা হয় নি কখনো। মধ্যযুগ থেকেই কবিরা নারীকে বিভিন্ন রূপে কল্পনা করেছেন। নারীর রূপ ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কালজয়ী গান, কবিতা ও পদ। বাউল ও সূধি সাধনায়ও নারীকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ মনে করা হয়। তারা নারীকে প্রকৃতি হিসেবে গন্য করেন। প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনের মধ্য দিয়ে সাধকেরা সাঁই নিরঞ্জন এর সন্ধান করেন। কিন্তু অনেক নারীই সমাজ সংসার সংস্কারের চাপে‘কুলের বউ’ হয়ে ঘরে দিন কাটায়।‘ঘোমটা ফেলে চল না’ বলে স¦ামীর সাথে সাধনসঙ্গী হয়ে সাধবাজারে যেতে পারে না, যেমন পারেননি আফসার ফকিরের স্ত্রী। মনের বেদনা একটি গানে প্রকাশ করেছেন এভাবে: ‘মাজা সরু দীঘল কেশী, নাকটি তোমার বাঁশের বাঁশি, ও রূপ হেরি সদাই দিবানিশি, দিবসে দেখি স¦পন।। কে দেখবে তোর রূপের বাহার, পুরুষ বিনে গতি নাই তোমার, সুঁপে দাও দেহ মন প্রাণ, করোরে স¦ামীর ভজন।। যৌবন জোয়ারের পানি, ভাটায় পড়লে শুকনা জমি, আকবর শাহ কয় আফসার তুমি বুঝলে না প্রেমের করণ।’ বাউলেরা প্রচলিত ধর্মের আনুষ্ঠানিক আচারকে কখনোই মানেন না। ধর্মের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ব্যাখ্যাকে মানলেও আনুষ্ঠানিক আচারকে গ্রাহ্য করেন না। মসজিদ-মন্দিরে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না বলেই তাদের বিশ্বাস। প্রচলিত ধর্ম বাউল ফকির-সাধকেরা মানে না বলে তারা নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছে।‘নাড়ার ফকির’ বে-শরা ফকির, ‘মুতখেকো ফকির’, পথভ্রষ্ট বলে সামাজিকভাবে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ফকিরদের সম্পর্কে বিরূপ সমালোচনার জবাব আফসার ফকির গানে গানেই দিয়েছেন: ‘ফকির ফকির বলিব না মন, ফকির ধরে করো সাধন। ফকির হয় দ্বীনের মোস্তফা, শোনরে ভাই বন্ধুগন। ফকির ছিল হযরত আলী, ফকির ফাতেমা জননী, ফকির হয় ওয়াস কুরুনী, পেলরে নবির বসন।’ সম্প্রদায়গত ধর্ম, উপাসনালয় মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, সেই সাথে রুদ্ধ করেছে মানুষের মুক্তির সকল সম্ভাবনা। কিন্তু আফসার ফকির সাম্প্রদায়িক ধর্মের প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসা মুক্ত বিশ্বের মুক্ত মানব। তাঁর ধর্ম অখ- মানব, তাঁর সাধনা মনুষ্যত্বের সাধনা। তিনি লোক দেখানো নামায মানেন না। তাই তো তিনি লালনের ভাষায় সকলকে জানান দেন: ‘বীণার নামায তারে তারে আমার নামায কন্ঠে গাই।’ -লেখক ও গবেষক: আবদুল্লাহ আল আমিন,অেধ্যক, মেহেরপুর সরকারী মহিলা কলেজ,মেহেরপুর :: গ্রন্থনা:অধ্যক্ষ মহসীন আলী আঙ্গুঁর ,সম্পাদক ও প্রকাশক, মুজিবনগর খবর ডট কম,মেহেরপুর।Slider
দেশ
মেহেরপুর জেলা খবর
মেহেরপুর সদর উপজেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
যাবতীয়
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Home
»
Education
»
others
»
politics
» মেহেরপুরের পিরোজপুর ইউনিয়নের সিংহাটি গ্রামের মরমী সাধক ও গায়ক আফসার উদ্দীন ফকিরের গানে আল্লাহ তত্ত্ব, নবিতত্ত্ব, মুর্শিদ তত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্বের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ( সাতষট্টি পর্ব )
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News
No comments: