Sponsor



Slider

দেশ

মেহেরপুর জেলা খবর

মেহেরপুর সদর উপজেলা


গাংনী উপজেলা

মুজিবনগর উপজেলা

ফিচার

খেলা

যাবতীয়

ছবি

ফেসবুকে মুজিবনগর খবর

» » আগমনী -দীনেন্দ্রকুমার রায়




মেহেরপুরের সাহিত্য:দীনেন্দ্রকুমার রায় (২৬ আগস্ট ১৮৬৯ – ২৭ জুন ১৯৪৩)- খ্যাতনামা লেখক, পত্রিকা সম্পাদক এবং অনুবাদক ------------------------------------------ আগমনী -দীনেন্দ্রকুমার রায় মামা প্রাণগোপাল সুভাষিণীকে নিজের মেয়ের মতই ভালবাসিতেন । সুভাষিণীর বয়স দশ বৎসর | সে বড় অভাগিনী । সাত বৎসর বয়সে সে মাতৃহীনা হয়, তাহার পর এই তিন বৎসর বলরামপুরে তাহাব মামার বাড়ীতে আশ্রয় লইয়াছ্ছে। মাতামহী মাতৃহীনা দৌহিত্রীকে এক বৎসর পরম ন্ষেহে ও যত্তে প্রতিপালিত করিয়া কৃতান্তের আহানে পরলোকে প্রস্থান করিলে, সুভাষিণীর মুখের দিকে চাহে, এমন স্ত্রীলোক সংসারে কেহই রহিল না । কেবল মামা প্রাণগোপালই বিশ্বসংসারে তাহার একমাত্র অবলম্বন হইয়া রহিলেন। সুভাষিণীর পিতা হরিশ চাটুষ্যে মহা কুলীন ; তাঁহার পিতামহ গোকুল চাটুয্যে একশত আটটি এবং পিতা গোবদ্ধন চাটুয্যে পয়ষ্রিটি মাত্র কুলীনমহিলার পাণিগ্রহণ করিয়া বংশের গৌরব অক্ষুণ্ন রাখিয়াছিলেন ! হরিশ পিতার কুপুত্র, একটিমা বিবাহ করিয়া তিনি কুলীনের নাম কলক্ষিত করিতে কুঠিত হন নাই ; এজন্য অনেক কুলীন-বৃদ্ধের নিকট তাহাকে বিস্তর গঞ্জনা সহ্য করিতে হইয়াছিল । এই চাটুয্যে-বংশ চিরকাল মাতুলাম্নে প্রতিপালিত ৷ তাঁহাদের আদি নিবাস্ কোন্ জেলায, এবং কোন্ গ্রামে, হরিশ তাহাও জানিতেন কি না সন্দেহ । উপবৃক্ষের মত তাঁহারা বংশানুক্রমে মাতুলের স্কন্ধ আশ্রয় করিয়া আসিতেছেন। হরিশ এখন মাতামহের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ; কয়েক বিঘা জোত জমি, উতের ক্ষেত, আম-কীঠালের বাগান ও কয়েক ঘর শিষ্য, তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন । এক পত্রী বর্তমানে হরিশকে কেহ বহুবিবাহে সম্মত করিতে পারে নাই বটে, কিন্তু সাধবী পত্তবী হরিপ্রিয়া দেবী সাত বৎসরের শিশু কন্যা সুভাষিণীকে রাখিয়। চিরনিদ্রায় অভিভূত হইলে, সাতান্ন বৎসর বয়সে হরিশের পত্বীশোক অসহনীয় হইয়া উঠিল । বৎসর ঘুরিতে-না-ঘুরিতে তিনি একটি কিশোরীর পাণিগ্রহণ করিয়া সেই শোক সম্বরণ করিলেন । সেইদিন হইতে তাঁহাকে নূতন করিয়া কালা-পেড়ে ধুতি পরিতে ও মাথায় টেড়ী কাটিতে দেখা গেল ! খবরের কাগজ হাতে পড়িলেই তিনি চোখে চশমা আঁটিয়া চুলের কলপের বিজ্ঞাপন খুঁজিতেন। এতত্িন্ন যে সকল পল্লীবাসী শ্রাম-সম্পর্কে তাঁহাকে 'দাদা' বলিয়া ডাকিত, এই দ্বিতীয় সংসারের আবিভাঁবের পর হইতে তাহারা তাঁহাকে “দাদা বলিলেই তিনি চটিয়া লাল হইতেন ; এবং তাঁহার অপেক্ষা দশ বৎসরের ন্যুনবয়স্ক কোনও লোক তাঁহাকে “ভায়া” বলিয়া ডাকিলে তিনি তাহাকে তাঁহার চণ্তীমণ্ডপে বসাইয়া চারি আনা সেরের “অন্বুরী' তামাকে পরিতৃপ্ত করিতেন ।_ বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে তাঁহার তামাক-খরচ দিন দিনই বাড়িয়া উঠিল! তখন অনেকেই বলিল, হরিশ মনুষ্যচম্মবৃত একটি গর্দভ মাত্র ! কুলীনের মেয়ে পিতার স্কন্ধের ভারম্বরূপ । আজকাল হিন্দু গৃহস্থমাত্রেরই কন্যা পিতার জীবনের অভিশাপস্বরূপ । মেয়ে হইয়াছে শুনিলে গৃহে বিষাদের ছায়া পড়ে ; পিতার মনে অনুতাপ উপস্থিত হয়, প্রসূতি আপনাকে মহা দুভাঁগিনী মনে করেন । কিন্তু যে সর্বনিয়ন্তা বিশ্বদেবতার মঙ্গলময় ইচ্ছায় কন্যার জন্ম, তাঁহার সৃষ্ট মায়ার বন্ধনেই বালিকার জীবন-রক্ষা হয় । হরিশ সুভাষিণীকে গলগ্রহ মনে করিতেন, এবং সন্ধ্যার পর যখন তিনি ঘরের বারান্দায় একখানি অদ্ধছিন্ন * 'মাদুরে'র উপর বসিয়া ময়লা বালিশে ঠেস দিয়া ডাবা হুকায় অন্বুরী তামাক টানিতেন, এবং আফিংয়ের মৌতাতে তাঁহার চক্ষু দু'টি নিমীলিত হইয়া আসিত, তখন তিনি কিরূপে কন্যাদায় হইতে উদ্ধার লাভ করিবেন, এই চিস্তায় আকুল হইয়া উঠিতেন । কোন কোন দিন তাঁহার মনে হইত, বিধাতাপুরুষ বড় ভুল করিয়া ফেলিয়াছেন: স্্ীটিকে না লইয়া যদি তিনি কন্যাটিকে সরাইতেন, তাহা হইলেই বিচারটা ঠিক হইত কিছুদিনের মধ্যেই হরিশ বিধাতা-পুরুষের এই ভ্রম প্রকারান্তরে সংশোধিত করিলেন । তিনি সুভাষিণীকে তাহার মামার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলেন । সুভাষিণীর মাতামহী জীবিতা ছিলেন ; তিনি দৌহিত্রীটিকে ফেলিতে পারিলেন না। প্রাণগোপাল ইহাতে কোন আপত্তি করেন নাই বলিয়া প্রাণগোপালের স্ত্রী নয়নতারা একবেলা অনশনে ও তিন দিন ধরাসনে কালযাপন করিয়াছিলেন ; সপ্তাহকাল স্বামীর সহিত বাক্যালাপবন্ধ ছিল | প্রাণগোপালের পক্ষে ইহা শাপে বর হইযাছিল । দিবারাত্রি প্রেমময়ী ভাষ্যরি বচনসুধা-পানে তাঁহার উদর এরূপ পূর্ণ হইয়াছিল যে, কয়েক দিনের রোমস্থন ভিন্ন তাহা জীর্ণ হইবার আশা ছিল না । কিন্ত তথাপি তাঁহাকে সুভাষিণীর ভার লইতে হইল | তাঁহার মা ভাবিতেন, “পুত্র প্ৈণ, দায়ে পড়িয়া ভাগিনীটিকে লইয়া আসিয়াছে বটে, কিন্তু মুখে একটা মিষ্ট কথা নাই !”- স্ত্রী ভাবিত, “মিন্সে মায়ের কেনা গোলাম, আমার উপর তার এক বিন্দু মায়া-মমতা নাই । নিজের ছেলে মেয়ের চেয়ে ভাগিনীর উপরেই বেশী দরদ !”___দেখিয়া শুনিয়া প্রাণগোপাল হাল ছাড়িয়া দিলেন ; মাতা ও স্ত্রী উভয়কেই যত দূর পারিতেন পরিহার করিয়া চলিতেন। সুভাষিণী কিছুদিনের মধ্যেই মামার প্রিয়পাত্রী হইয়া উঠিল । প্রাণগোপালের কন্যা আহাদীর মত দুষ্টু মেয়ে ভূমগুলে বোধ হয় অল্পই আছে । দুষ্টুমি তাহার সহজাত-সংস্কারের মত | তাহাকে যাহা বলা হইত, সে তাহার উল্টা করিত ! আহ্রাদীর বাবহারে পাড়ার লোক জ্বালাতন হইয়া উঠিয়াছিল । তাহার অনুগ্রহে কাহারও টালে, শশা কি শিম থাকিত না! মধু বেণে তাহার পিতার বয়সী, মশলার দোকান করিয়া সংসার-যাত্রা নিব্বহি করিত | আহাদী একদিন তাহার দোকানে গিয়া হাজির ! বলিল, “মধু দাদা, আমাকে একমুঠো ছোট এলাচ দাও ।” মধু বলিল, “যা, পয়সা আন্গে ; বিনি-পয়সায় একমুঠো এলাচ খায় না!” আহাদী মধূকে উভয় হস্তের বৃদ্ধাঙ্গষ্ঠ দেখাইয়া নাচিতে নাচিতে বলিল-_ “মোদো খায় খোদোর বিচি, নীলমণি খায় ফ্যান, নাচচে কোলা ব্যাঙ !” মধু রাগিযা আগুন !-__মধুর স্ত্রীর সহিত আহ্াদীর মার সে দিন স্নানের ঘাটে যেরূপ কলহ আরম্ভ হইল, কংগ্রেসের কলহও তাহার নিকট লজ্জা পায় ! একদিন দুই ক্রোশ দূরবর্তী জমীদার-বাড়ী হইতে ফিরিয়া আসিয়া প্রাণগোপাল বলিলেন, “আহ্াদী, এক গেলাস জল আন্তো মা !” আহ্াদী একটা শশা চিবাইতে চিবাইতে বলিল, “কে এখন গেলাস খুজে বেড়ায় ?” সুতাষিণী নিকটে দাঁড়াইয়াছিল ;+--সে বলিল, “ছি, আহ্াদী, মামার তেষ্টা পেয়েছে, এমন কথা কি বলে ?--আমি তোমাকে জল এনে. দিচ্ছি মামা !” সুভাষিণী গামছা পরিয়া তাড়াতাড়ি তাহার দিদি-মার কলসী হইতে এক গেলাস জল আনিয়া মামাকে দিল ।-_ তাহার পর তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “মামা, তুমি বড্ড ঘেমেছ যে !-_একটু বাতাস করবো ?” কথাটা মামীর কাণে গেল | সে বলিল, “ও বাবা ! এইটুকু মেয়ের এত শয়তানী ? কলিতে আরও কত দেখবো ! এখনই মামাকে ভুলোনার চেষ্টা ? হারামজাদী দেখ্চি আমার আহ্াদীকে পর করে দেবে !” প্রাণগোপাল সুভাষিণীর কথায় ও ব্যবহারে ক্রমে তাহার প্রতি যত আকৃষ্ট হইতে লাগিলেন, গৃহিণীর আক্রোশ দিন দিন ততই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল । মেয়ের দুষ্টামীর জন্য প্রাণগোপাল আহ্রাদীকে গালি দিতেন ; আহ্রাদীর মা মনে করিত, “মেয়েটাকে ও দু'চক্ষে দেখ্তে পারে না, একচোখা মিন্সে !” কিন্তু প্রাণগোপালের উভয় চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি সমান ছিল । তিনি আহ্াদীকে ও সুভাষিণীকে কাপড় চোপড়, পুতুল, জামা সমান ভাবে দিতেন । তিনি বলিতেন, “আহা ! মেয়েটা বড় হতভাগা । মা নেই, বাপ থাকৃতেও নেই ; আমি যদি ওর মুখের দিকে না চাইব, তবে ওর গতি কি হবে?” গৃহিণী বলিত, “ও আর আনহ্রাদী সমান ? ইচ্ছা করে, তোমার সংসার ছেড়ে দিনকতক মায়ের কাছে গিয়ে থাকি |” প্রাণগোপাল একটা তীব্র বিদ্রুপের প্রলোভন সম্বরণ করিতে পারিলেন না, বলিলেন/তার পরদিন তোমার মা আমার কাছে ছুটে আস্বেন । তাঁর সঙ্গে আবার চাল ডাল পাঠাতে হবে ত?” নয়নতারার পিতৃগৃহের অবস্থা এইরূপ সচ্ছল ছিল। “কি ! আমার মায়ের ঘরে ভাত নেই ? তুমি তাঁকে চিরদিন ভাত কাপড় দিয়ে পুষ্চো ! ও মা! ঘেন্নায় মলাম যে ! আমি গালে-মুখে চড়িয়ে মরবো । আমার মা বাপের খোঁটা 1”- প্রাণগোপালের প্রাণাধিক নয়নতারা ফৌৎ-ফৌৎ শব্দে নাক ঝাড়িতে লাগিল । অশ্রুধারায় অবগুষ্ঠন (কারণ শাশুড়ী নিকটে ছিলেন) ভিজিয়া গেল । সাধবী শাঁখা ভাঙ্গিতে উদ্যত হইলে, প্রাণগোপালের মাতা অনেক মিষ্ট কথায় বধুকে নিরস্ত করিলেন । মধ্যাহকালে প্রাণগোপাল বিশ্রামার্থ শয়ন করিলে আহ্রাদী একখানি কঞ্চি ল্ইয বাতাবি নেবুর গাছ ঠেঙ্গাইতে লাগিল ; সুভাষিণী তাহার মামার মাথার কাছে বসিয়া পাকা চুল তুলিতে তুলিতে বলিল, “মামা, তুমি যে 'নিলেশ্বরী'খান দিয়েছ, ও আমি পরবো না ।__আমাকে একখানা মোটা কাপড় এনে দিও । মামীমা বলেন, আমি বাপে-খেদানো মেয়ে, ও রকম ভাল কাপড় আমাকে মানায় না।” প্রাণগোপাল বলিলেন, “তোর মামীমার যেমন কথা !” প্রাণগোপালের মা যতদিন বাঁচিয়া ছিলেন, ততদিন সুভাষিণী মায়ের অভাব জানিতে পারে নাই । দিদিমার মৃত্যুর পর তাহার বুক যেন খালি হইয়া গেল । সে ভাবিল, "সকলেরই মা আছে, আমার মা নাই কেন ?-_-সবারই বাপ মেয়েকে আদর করে, ভালবাসে ; আমার বাবা কখন আমাকে দেখতেও আসেন না ।”-_ সংসারে সকলের অবস্থা সমান নয় কেন, বালিকা এ সমস্যা বুঝিতে পারিত না। হইতে লাগিলেন, গৃহিণীর আক্রোশ দিন দিন ততই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল । মেয়ের দুষ্টামীর জন্য প্রাণগোপাল আহ্রাদীকে গালি দিতেন ; আহ্রাদীর মা মনে করিত, “মেয়েটাকে ও দু'চক্ষে দেখ্তে পারে না, একচোখা মিন্সে !” কিন্তু প্রাণগোপালের উভয় ৮ক্ষুর দৃষ্টিশক্তি সমান ছিল । তিনি আহ্াদীকে ও সুভাষিণীকে কাপড় চোপড়, পুতুল, জামা সমান ভাবে দিতেন । তিনি বলিতেন, “আহা ! মেয়েটা বড় হতভাগা । মা নেই, বাপ থাকৃতেও নেই ; আমি যদি ওর মুখের দিকে না চাইব, তবে ওর গতি কি হবে?” গৃহিণী বলিত, “ও আর আনহ্রাদী সমান ? ইচ্ছা করে, তোমার সংসার ছেড়ে দিনকতক মায়ের কাছে গিয়ে থাকি |” প্রাণগোপাল একটা তীব্র বিদ্রুপের প্রলোভন সম্বরণ করিতে পারিলেন না, বলিলেন/তার পরদিন তোমার মা আমার কাছে ছুটে আস্বেন । তাঁর সঙ্গে আবার চাল ডাল পাঠাতে হবে ত?” নয়নতারার পিতৃগৃহের অবস্থা এইরূপ সচ্ছল ছিল। “কি ! আমার মায়ের ঘরে ভাত নেই ? তুমি তাঁকে চিরদিন ভাত কাপড় দিয়ে পুষ্চো ! ও মা! ঘেন্নায় মলাম যে ! আমি গালে-মুখে চড়িয়ে মরবো । আমার মা বাপের খোঁটা 1”- প্রাণগোপালের প্রাণাধিক নয়নতারা ফৌৎ-ফৌৎ শব্দে নাক ঝাড়িতে লাগিল । অশ্রুধারায় অবগুষ্ঠন (কারণ শাশুড়ী নিকটে ছিলেন) ভিজিয়া গেল । সাধবী শাঁখা ভাঙ্গিতে উদ্যত হইলে, প্রাণগোপালের মাতা অনেক মিষ্ট কথায় বধুকে নিরস্ত করিলেন । মধ্যাহকালে প্রাণগোপাল বিশ্রামার্থ শয়ন করিলে আহ্রাদী একখানি কঞ্চি ল্ইয বাতাবি নেবুর গাছ ঠেঙ্গাইতে লাগিল ; সুভাষিণী তাহার মামার মাথার কাছে বসিয়া পাকা চুল তুলিতে তুলিতে বলিল, “মামা, তুমি যে 'নিলেশ্বরী'খান দিয়েছ, ও আমি পরবো না ।__আমাকে একখানা মোটা কাপড় এনে দিও । মামীমা বলেন, আমি বাপে-খেদানো মেয়ে, ও রকম ভাল কাপড় আমাকে মানায় না।” প্রাণগোপাল বলিলেন, “তোর মামীমার যেমন কথা !” প্রাণগোপালের মা যতদিন বাঁচিয়া ছিলেন, ততদিন সুভাষিণী মায়ের অভাব জানিতে পারে নাই । দিদিমার মৃত্যুর পর তাহার বুক যেন খালি হইয়া গেল । সে ভাবিল, "সকলেরই মা আছে, আমার মা নাই কেন ?-_-সবারই বাপ মেয়েকে আদর করে, ভালবাসে ; আমার বাবা কখন আমাকে দেখতেও আসেন না ।”-_ সংসারে সকলের অবস্থা সমান নয় কেন, বালিকা এ সমস্যা বুঝিতে পারিত না। মায়ের মৃত্যুর পর প্রাণগোপাল সুভাষিণীর সুখন্বচ্ছন্দতার উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখিয়াছিলেন ; কিন্তু নয়নতারার উৎপীড়ন হইতে ভাগিনেহীকে রক্ষা করেন_ তাঁহার এরূপ শক্তি ছিল না। যেখানে রমণীর অধিকার অক্ষুপ্র সেখানে পুরুষের শক্তি পরাহত । সুভাষিণী অল্পবয়সেই তাহার দুভাগ্যের কথা বুঝিতে শিখিয়াছিল | সে যদি আত্রাদীর মত দুরস্ত হইত, তাহা হইলে সংসারে তাহার স্থান হইত না । সমস্ত দিন মামীমার “ফরমাস' খাটিয়া রাত্রে সে মেঝের এক পার্থে একখানি জীর্ণ মাদুর পাতিয়া শুইয়া পড়িত। মামী-মার শয্যাপ্রান্তে সুভাষিণীর স্থান ছিল না।-_প্রাণগোপাল একদিন রাত্রে স্ত্রীকে বলিলেন, “সুভা ছেলে মানুষ, নীচে একা শুতে পারে না, চৌকীতে ওকে একটু জায়গা দিলে দোষ কি ” নয়নতারা নথ ঘুরাইয়া বলিল, “দোষ ত কিছুতেই নেই,_-এঁ একখানা ছোট চৌকীতে ছেলে মেয়ে দু'টি নিয়ে আমারই জায়গা হয় না ৷ “আপনি শুতে ঠাঁই পায় না, শঙ্করাকে ডাকে !” ভাগ্নীর “দুঃখু' দেখে এত কষ্ট হয়ে থাকে তো একখান নূতন চৌকী এনে দাও না।” প্রাণগোপাল বলিলেন, “অপরাধ হয়েছে, এমন কথা আব বল্বো না।” নয়নতারা ছাড়িবার পাত্রী নহে, সে গর্জন করিয়া বলিল, “না, যত অপরাধ-_সব আমার !-_ইচ্ছে করে. এমন সংসারের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে যেদিকে দুই চোখ যায়, চলে যাই ।” প্রাণগোপাল অন্তিম সাহসে নির্ভর করিয়া বলিলেন, “না, তুমি চলে যাবে কেন ? তোমার অত্যাচারে আমাকেই বিবাগী হ'য়ে চলে যেতে হবে ।-_-মেয়েটা যেন তোমার চক্ষুঃশুল !” প্রাণগোপাল আর ক্ষণমাত্র সেখানে অপেক্ষা না করিয়া খড়ম পায়ে দিয়া ছকা লইয়া চশ্তীমণ্ুপে চলিলেন । বালক ভূত্য গৌরে বাগ্দী বিচালীর বালিশে মাথা রাখিয়া বারান্দায় পড়িয়া নাক ডাকাইতেছিল । কত্তরি খড়মের শব্দে সে “ধুড়মুড়' করিয়া উঠিয়া বসিল ; তাহার পর উভয় চক্ষু ডলিতে-ডলিতে উঠিয়া দাঁড়াইল | প্রাণগোপাল বলিলেন “শীগৃগির এক ছিলিম তামাক সাজ ।--আলোটা নিব্লো কেমন করে রে? বেগুনগাছে ও শাকের ক্ষেতে জল দিয়া গৌরের শ্রান্তিবোধ হইয়াছিল, তাই সে বিচালীর বালিশ মাথায় দিয়া মুদিতনেত্রে নাসাগর্জনসহকারে শ্রান্তি দূর করিতেছিল । প্রদীপপটা ভ্বালিয়া বাড়ীর ভিতর হইতে তাহাতে যে একটু তেল আনিয়া দিবে, সেটুকু বিলম্বও সহে নাই । কিন্তু সে কৈফিয়তে চুকিল না, বলিল, “আজ্ঞে কত্ত, একটা জোনাই পোকা 'পিদিমে' পড়বার যো “হয়েল', তাই “পিদিমণ্টা নিবিয়ে দিয়েছি । আপুনি যে কর্তা বুলেছিলেন, জোনাই পোকা 'পিদিমে' পড়া দোষ !” প্রাণগোপাল বলিলেন, “বেশ করেছিস, এখন আলো জ্বাল ।” গৌরে বলিল, “তা হ'লে কর্তা, মেচ-বাক্সোটা মা ঠাগ্রুণের কাছ থেকে নিয়ে আসি ।” প্রাণগোপাল তাড়াতাড়ি বলিলেন,“তার আর দরকার নেই ; তোর চকমকি বের কর।” গৌরে বলিল, “আজ্ঞে কত্ত, শোলাখানা পুড়ানো নেই, আর আহ্রাদী বিড়াল তাড়াতে পাথরখানা কোথায় ফেলে দিয়েছে, খুজে পাইনি ।” প্রাণগোপাল বলিলেন, “তবে থাক্ তামাক | আমার খোল্খান পাড় | দেখিস্, যেন ফেলে ভাঙ্গিস্নে ; যদি ভাঙ্গিস্, তবে তোকেও গুড়ো করবো ।” গুড়া হইবার ভয়ে্গৌরে অতি সাবধানে খোল্খানি দেয়ালের “দাণ্ডি' হইতে পাড়িয়া প্রাণগোপালের হাতে দিল । প্রাণগোপাল সতরঞ্চিতে বসিয়া খোলে মুদু আঘাত কবিয়া সঙ্কীর্তন ধরিলেন,_ “আজু বৃন্দাবনে এ কি শোভা নেহারি ।” মৃদ্ঙ্গধবনি শুনিয়া পাড়ার পাচ জন হরিসঙ্কীর্তনে যোগদানের জন্য প্রাণগোপালের বৈঠকখানায় সমাগত হইল । তখন জোরে-জোরে খোল বাজিতে লাগিল ; খোল ও করতালের শব্দে নৈশ পল্লীপ্রকৃতি প্রতিধবনিত হইযা উঠিল । নৃতন করিয়া গান আরম্ভ হইল, “সঙ্কীর্তন মাঝে আমার গৌর নাচে “ ভৃত্য গৌর তখন গোয়ালঘরে পা কাছে গিয়া সাঁজালের আগুনে কিরে তারিন সে মামামামীর প্রেমালাপ শুনিয়াছিল, চক্ষুর জলে তাহার বালিশ ভিজিয়া গেল । মামী ডাকিল, “সুভা ওঠ, কুয়ো থেকে এক ঘটী জল তুলে আন্ ।” সুভাষিণী ভয়ে জড়সড হইয়া উঠিয়া বসিল :--বলিল, “মামীমা, বাইরে বড় আঁধার, একা যেতে ভয় করে ” নয়নতারা কঠ সপ্তমে চড়াইয়া বলিল, “ভয় করে ? কচি খুকী !_উনি জল তুলতে যাবেন, একজন বাঁদীকে ওর সঙ্গে পাহাবায় পাঠাতে হবে ! এত সুখে আর কাজ নেই; যা, শীগ্ণির জল নিয়ে আয় ।--আহাদী ভাত খেয়েছে, এটোটা এখনও পরিষ্কার করা হয়নি - প্রদীপ জ্বাল্তে-না-স্বাল্তে ঘুম ?” সুভাষিণী ঘটী লইয়া কুয়ায় জল তুলিতে গেল । কুয়া সেখান হইতে অনেক দূরে ; পাশে শশার টাল, দুটো ইদুর টালের উপর “কিচির মিচির' করিয়া উঠিল । ভয়ে সুভার বুকের মধ্যে কাঁপিয়া উঠিল ।-_-সে কোনও রকমে এক ঘটী জল তুলিয়া ঘরের দিকে আসিয়াছে, এমন সময় বাড়ীর পাশের প্রকাণ্ড বকুল গাছের ডালে বসিয়া একটা হুতুমপ্যাঁচা অত্যন্ত গশ্ভীরস্বরে ডাকিল, “তু-থুলি !” সুভাষিণী ভয়ে দৌড়াইতে গিয়া একখানি ইটে বাধিয়া পড়িয়া গেল । ঘটার সমস্ত জল তাহার কাপড়ে ঢালিয়ে পড়িল, খোলায় তাহার কপাল কাটিয়া রক্তের স্রোতে বহিল; সে কষ্টে বলিল, “মা গো !” যে মাতৃহীন, সেও অসময়ে মাকে ডাকে । শব্দ শুনিয়া নয়নতারা উগ্রচণ্তামূর্তিতে দীপ-হস্তে বাহিবে আসিল ; সে সুভাকে না তুলিয়া--সে জল ফেলিয়া দিয়াছে বলিয়া তীব্র কটুক্তি প্রয়োগ করিতে লাগিল, এবং পরদিন তাহার ভাত বন্ধ করিবে বলিয়া রায় প্রকাশ করিল । গোলমাল শুনিযা হুকা ফেলিয়া গৌরে সেখানে আসিল । গৌরে এই মাতৃহীনা বালিকাকে স্েহ করিত | ঘরে যাহার আহা বলিবার কেহ নাই, পরে তাহার বেদনায় হাত বুলাইয়া দেয় । গৌরে সুভাষিণীর হাত ধরিয়া তুলিল, ন্যাকড়া ভিজাইয়া তাহার কাপলে জলপন্রী বাঁধিয়া দিল । তাহার পর তাহাকে শয়নকক্ষের দ্বারে রাখিয়া আসিল : সে বাগদীর ছেলে, শয়নকক্ষে তাহার প্রবেশাধিকার ছিল না। নয়নতারা হাঁকিল, “বাগদীকে ছুঁয়েছিস্, ও কাপড় না ছেড়ে ঘরে ঢুকতে পাবিনে সুভাষিণী চালের 'বাতা” হইতে একখানি জীর্ণ মলিন বস্ত্র টানিয়া লইয়া তাহাই পরিয়া ঘরে শুইতে গেল । চক্ষুর জলে সে পথ দেখিতে পাইল না; কেবল অভ্যাস ছিল বলিয়া টলিতে-টলিরে কোনও রকমে সে তাহার মাদুরখানার উপর গিয়া পড়িল । কপালের বেদনায় সমস্ত রাত্রি বালিকা ঘুমাইতে পারিল না। গভীর রাত্রে পিপাসায় কাতর হইয়া সে ক্ষীণকণ্ঠে মামীমার নিকট একটু জল চাহিল !- কিন্তু তাহার কোনও সাড়াশব্দ পাইল না। তখন সে অতি কষ্ট্রে উঠিয়া কলসী হইতে এক “পাউলি' জল লইয়া তৃষ্ণা নিবারণ করিল । নয়নতারা বলিল, “এই রাত দুপুরে পেটে সাগর ঢুকেচে ! ধন্য মেয়ে বাবা, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারলে । কত পাপ করেছিলাম, তাই এমন আবাগের বেটীকে ভাত-কাপড় দিয়ে পুষ্তে হচ্ছে !” ক্রমে পূজা আসিল । সপ্তমীপূজার দিনে প্রাণগোপাল গ্রাম্য বাজার হইতে দুইখানি প্লেয়াজ-রঙ্র শাড়ী আনিয়া একখানি আহ্াদীকে ও অন্যখানি সুভাষিণীকে প্রদান করিলেন । আহ্াদী বায়না ধরিল, “ও দু'খান কাপড়ই আমি নেব ।” নয়নতারা বলিল,সুভা তোর কাপড়খান আহ্থাদীকে দে । তোর অনেক কাপড় আছে, তাই পবে' পুজো দেখিস: নতুন শাড়ী না হলেও পুজো দেখা যায় |” সুভাষিণী বিনা-প্রতিবাদে শাড়ীখানি মামীমার হাতে দিল : তাহার পর সে একটি দীর্ঘনশ্বাস ত্যাগ করিয়া বাসন মাজিতে গেল । সংসারের যত বাসন, সমস্তই তাহাকে প্রত্যহ পরিষ্কার করিতে হইও । সন্ধ্যার সময় প্রতিবেশী গাঙ্গুলীবাড়ীতে ঢাক ঢোল বাজিয়া উঠিল ; মা দুগরি আরতি আরম্ত হইল । ধূপের সৌরভে চারিদিক পূর্ণ হইল । গ্রামের স্ত্রী পুরুষেরা দলে দলে গ্রাম্পথে পূজাবাড়ীতে আরতি দেখিতে ছুটিল | নয়নতারা আহ্াদীকে লইয়া আরতি দেখিতে চলিল ; সুভাষিণীকে ডাকিল না, সে-ও তাহার সহিত যাইবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিল না। মামীমার এতদিনের দুর্ববহারে__উপেক্ষায় ও বিরাগে বালিকার শিশুহৃদয ক্ষতবিক্ষত হইয়াছিল ; কিন্তু আজ তাহাকে ফেলিয়া আহাদীকে লইয়া পূজা দেখিতে যাওয়ায় তাহার যত কষ্টু হইল, মামী-মার অন্য দিনের নানাপ্রকার কঠোবতর ব্যবহারেও তাহার তত কষ্ট হয় নাই | _সুভাষিণী ঘরেব বারান্দার একপাশে বসিয়া দুই হাতে মুখ গুজিয়া ফুলিয়া-ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল । তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছিল | শারদ-সপ্তমীর খণ্ড চন্দ্র মধ্যাকাশে বসিয়া রজতকিরণধারায় ধরাতল প্লাবিত কবিতেছিল | শবতের নির্গলিতান্ব গর্ভ শুভ্র মেঘগুলি চন্দ্রকরোজ্ত্বল অন্বরপথে অতি ধীরে ভাসিয়া যাইতেছিল ৷ বকুল বুক্ষেব নিবিড় পল্লবরাশির অস্তরালে বসিযা একটা পাখী মধ্যে মধ্যে “চোখ-গেল' 'চোখ গেল' শব্দে নৈশ-প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিতেছিল ৷ গৃহপ্রাস্তবন্তী ডোবার ধারে অযত্রসস্তুত রজনীগন্ধার ঝাড় হইতে সদ্যো-বিকশিত রজনীগন্ধাস্তবকের মুদুগন্ধ সুশীতল নৈশ-সমীরণপ্রবাহে ভাসিয়া চতুদ্দিক সৌরভাকুল কারতেছিল ৷ পুজাবাড়ীতে আরতির ঢাক তুমুল শব্দে বাজিয়া-বাজিয়া তখন থামিয়া গিয়াছিল ; কেবল ভূ-বিববমধ্যবর্তী ঝিল্লীর অশ্রান্ত তানপুরা তখনও নীরব হয় নাই। দূর বান কদাচিৎ দুই একটা নিশাচর পক্ষীর বিকট কণ্ঠস্বর রজনীর গাস্তীর্যা বদ্ধিত করিতেছিল ; এবং গ্রাম্য-নরনারীগণ আরতি দেখিয়া গৃহে ফিরিতেছিল । বালক-ভৃত্য গৌরে গরুব জাবনা মাখিয়া দিয়া হাত ধুইয়া তাহার নৃতন 'ফোতা' (চাদর)-খানি মাথায় বাঁধিল : তাহার পর তৈলপন্ক বাঁশের লাঠিখানি লইয়া পুজা দেখিতে বাহির হইবে, এমন সময় রুদ্যমানা সুভাষিণীর প্রতি তাহার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল | সে তৎক্ষমাৎ তাহার সম্মুখে আসিয়া সহানুভূতিভরে জিজ্ঞাসা করিল, “কে ? সুভা দিদি না কি? তুমি পুজা দেখ্তে যাওনি " সুভাষিণী কোনও কথা না বলিয়া কাঁদিতে লাগিল ৷ গৌরেরও মা ছিল না, সে সুভাষিণীর মনের কষ্ট বুঝিতে পারিল । সে তাহার হাত ধরিয়া বলিল, “মা ঠাক্রুণ তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যায়নি ? কেদ না দিদি ! চল, আমি তোমাকে ঠাকুর দেখিয়ে আনি । আরতির সময় লোকের ভিড়ে “পিত্তিমে-দর্শন' হয় না, তাই আমি এতক্ষণ যাইনি, গাই কটাকে জাব্না দিচ্ছিলাম `এখন আর বেশী ভিড় নেই, চল, তোমাকে দেখিয়ে আনি ” সুভাষিণী মলিন-বস্ত্রেই গৌরের সঙ্গে প্রতিমা-দর্শনে চলিল। গাঙ্গুলী-বাড়ীতে প্রতিমার সোনালি সাক্ত । দেওয়ালগিরি ও ঝাড়ের আলোকরাশি ডাকের সাজে ও প্রতিমার মুখে প্রতিফলিত হইতেছে । দশপ্রহরণ্-ধারিণী মা দুগরি নথশোভিত মুখের কি প্রশান্ত ভাব ! সুভাষিণীর গদয় শক্তিতে, আনন্দে পূর্ণ হইল ; সে 'ঠাকুর-দালানে' উঠিয়া দেবীচরণে ভক্তিভরে প্রণাম করিল ; মনে মনে বলিল, “মা, তুমি এত গহনা পোরে ছেলে মেযেদের সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ী এসেছ,__তুমি সকলের মা, আমার দুঃখ তবে দূর কর না কেন £ আমারও তা বাবা আছেন, তিনি একবারও আমার খোঁজ নেন না । এই পূজার সময় বাপে মেয়েদের কত ভাল ভাল কাপড় জামা গহনা দিয়াছেন আর আমার বাবা আমাকে ভুলে আছেন ! মা, আমাকে তুমি আমার বাপের কাছে পাঠিয়ে দাও, মামীমার কাছে আর আমি থাকৃতে পারচিনে ।”-_অভিমানিনী বালিকার অসশ্রুপ্রবাহে তাহার দৃষ্টি অবরুদ্ধ হইল ! মামীমার বকুনির ভয়ে সুভাষিণী সেখানে অধিক বিলম্ব করিতে পাবিল না । দুর্গতিনাশিনী মা দুগাঁকে তাহার কাতর প্রার্থনা জানাইয়া গৌবের সঙ্গে বাড়ী ফিরিয়া আসিল । প্রাণগোপাল তখনও পূজা দেখিয়া গৃহে প্রত্যাগমন করেন নাই । চণ্তীমগ্ডপে একটা প্রদীপ জ্বলিতেছিল, অদূরে একখানি জলচৌকীর উপর বসিয়া এক জন লোক রোধ হয় গৃহস্বামীর প্রতীক্ষা করিতেছিলেন । সুভাষিণীকে অস্তঃপুরে প্রবেশোদ্যতা দেখিয়া আগন্তক ডাকিলেন, “কে যায় ? সুভা না কি?" সুভাষিণী চলিতে-চলিতে থমকিয়া দাঁড়াইল, তাহার পর ফিরিয়া বলিল, কে ? বাবা !” হরিশ চাটুয্যে দুই বৎসর পরে আজ সপ্তমীর রাত্রে শ্বশুরালয়ে আসিয়াছেন । দুই বৎসর পরে পিতা-পুত্রীতে সাক্ষাৎ ! সুভাষিণী পিতার কোলে মুখ লুকাইয়া কাঁদিতে লাগিল ; হরিশ নীরবে কন্যার মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন । তিনি কি বলিয়া অভিমানিনী কন্যাকে সাস্তবনা দান করিবেন, তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। অনেকক্ষণ পরে সুভাষিণী মুখ তুলিয়া কোমলদৃষ্টিতে পিতার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “বাবা, তবে তুমি আমাকে ভুলে যাও নি ? আমাকে বাড়ী নিয়ে যাবে, বাবা ?” হরিশ গাঢ়স্বরে বলিলেন, “হী মা, আমি তোমাকেই নিতে এসেছি । এবার ভিক্ষে-শিক্ষে করে' মা জগদন্বাকে ঘরে এনেছি ; কিন্তু কাল রাত্রে মা আমাকে স্বপন দিয়েছেন, “তুই তোর মেয়েকে অনাহারে পরের বাড়ী ফেলে রেখে আমাকে ঘরে এনেছিস্ ! তোর মত নিষ্ঠুর বাপের পূজা আমি গ্রহণ করবো না। যদি আমার পূজা ক'রতে চাস্ ত তোর মেয়েকে ফিরিয়ে আন্ ।”_-তাই মা ! এই পাঁচক্রোশ পথ হেঁটে, তোকে তাড়াতাড়ি নিতে এসেছি । চল্, বাড়ী যাই, গাড়ী ঠিক হয়েছে; আর আমি আমার মাকে কাছ-ছাড়া করবো না।” প্রাণগোপাল গৃহে ফিরিয়া ভগিনীপতির মুখে সকল কথা শুনিলেন । তিনি বিষণ্মনে ভাগিনেয়ীটিকে বিদায় দিলেন ।---আপদ গেল, ভাবিয়া নয়নতারা হাঁস ছাড়িয়া বাঁচিল। সুভাষিণী বাড়ী আসিয়াই চণ্তীমণ্ডপে উঠিয়া ভক্তিভরে মা দুগাকে প্রণাম করিল ; বালিল, “মা, তুমি বছরে-বছরে আমাদের বাড়ী এসো, তা হ'লে আমি বাবার কাছে থাকতে পাব ।” লেখাটি দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পল্লীকথা গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। দীনেন্দ্রকুমার রায় (২৬ আগস্ট ১৮৬৯ – ২৭ জুন ১৯৪৩)- : খ্যাতনামা লেখক, পত্রিকা সম্পাদক এবং অনুবাদক । দীনেন্দ্রকুমারের জন্ম ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে আগষ্ট বৃহস্পতিবার ( ১২৭৬ বঙ্গাব্দের ১১ই ভাদ্র ) মেহেরপুর শহরে। বাবা ব্রজনাথ কর্মরত ছিলেন কৃষ্ণনগরের জমিদারের সেরেস্তায়। পিতার কাছে কৃষ্ণনগরেই পড়াশোনা; কিন্তু স্কুলের পাঠ শেষ করলেও গণিত শাস্ত্রে তার ভীতি তাকে উচ্চতর পাঠক্রমে পড়ায় উৎসাহিত করে নি। বহু লোক দীনেন্দ্রকুমারকে শুধু রবার্ট ব্লেকের স্রষ্টা এবং গোয়েন্দা কাহিনীর রচয়িতা বলেই জানেন। কিন্তু পল্লীচিত্র ও পল্লীসমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে তার রসস্নিগ্ধ রচনা পড়ে বিস্মিত হতে হয়। এই রচনাগুলিতে তার চিন্তার ব্যাপ্তি, সাহিত্য প্রতিভা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখনী চালনার সহজাত ক্ষমতাকেই তুলে ধরে। তার লেখনী সৃষ্ট পল্লীচিত্র, পল্লীবৈচিত্র, পল্লীকথা প্রভৃতি গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত বিবিধ রচনা অসাধারণ বৈচিত্র ও বর্ণময়তায় ভরপুর। ‘সাহিত্য’ সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি স্বয়ং তার পল্লীকথা গ্রন্থের ‘প্রুফ’ সংশোধন করে দিযেছেন; আর পল্লীজীবনকে তুলে ধরার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাকে লিখেছেন ‘বাংলা দেশের হৃদয় হইতে আনন্দ ও শান্তি বহন করিয়া আনিয়া আমাকে উপহার দিয়াছেন। ও অনেক পাঠক পল্লীসমাজের বিভিন্ন দিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে রচনাকে তার গোয়েন্দা কাহিনীর থেকে বেশি উপভোগ্য বলে মনে করেন। পল্লীজীবনের অন্তর্নিহিত সত্তাকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। সম্ভবতঃ মুর্শিদাবাদ, মহিষাদল ও রাজশাহীতে থাকা কালীন গ্রাম বাংলা ও পল্লী জীবনের সঙ্গে তার একাত্মতা গড়ে ওঠে। একই সঙ্গে তার লেখনী গোয়েন্দা কাহিনীর জটিল ঘটনা প্রবাহ ও যুক্তিজালের ঘেরাটোপে আবার পল্লীগ্রামের সরলতা ও সজীবতার মুক্ত আঙিনায় কি করে বিচরণ করেছিল ভাবলে আশ্চর্য্য হতে হয়। শেষ জীবনে মেহেরপুরে তার বাসস্থানের কাছে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি ছাপাখানা; এখান থেকেই তার লেখা দ্রুত গতিতে ছাপা হয়ে বেরোত। দীনেন্দ্রকুমার ‘মুকুল’, ‘শিশুসাথী’, ‘সখা ও সাথী’, ‘মৌচাক’ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। ছোটদের জন্যও তিনি লিখেছেন। তার রচিত ‘মজার কথা’, ‘লোহার বাক্স’, ‘তালপাতার সিপাই’ ইত্যাদি বহুবিধ রচনা কখনও মজার কখনও হাস্যরসে পূর্ণ। গোয়েন্দা কাহিনী বাদে তার রচিত কিছু গ্রন্থ : বাসন্তী (১৩০৫), হামিদা (১৮৯৯), পট(১৩০১), মজার কথা (১৯০৩), পল্লীচিত্র (১৯০৪), পল্লীবধূ (১৯২৩), তালপাতার সিপাই (১৯২৩), পল্লীকথা (১৩২৪), নায়েবমশাই (১৩৩১), অরবিন্দ প্রসঙ্গ (১৩৩০), সোনার পাহাড় (১৯২৯), নানাসাহেব (১৯২৯), নারীর প্রেম, পল্লীবৈচিত্র্য (১৩১২), কলির কালনেমি, আরব্য উপন্যাস (১৯০২), নেপোলিয়ন বোনাপার্টি (১৯০৩), মহিমময়ী, ঢেঁকির কীর্তি (১৩৩১), আরব্য রজনী (১৩৪২) ইত্যাদি। এ ছাড়া কাশিমবাজার রাজবাটি থেকে প্রকাশিত ‘তিলি পত্রিকা’ এবং সাপ্তাহিকী ‘হিন্দুরঞ্জিকা’ পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তার উপর। তার রচনা উদ্ধার করে কিছু পুণঃপ্রকাশিত হয়েছে, আরও হয় ত হবে। জানি না ব্যস্ততা ও চাহিদায় জর্জরিত এই সময়ে ক’জন তার লেখা পড়তে আগ্রহী হবেন। -দীপক সেনগুপ্ত। গ্রন্থনা:অধ্যক্ষ মহসীন আলী আঙ্গুঁর ,সম্পাদক ও প্রকাশক, মুজিবনগর খবর ডট কম,মেহেরপুর।






«
Next
Newer Post
»
Previous
Older Post

No comments:

Leave a Reply