(১৮৬৯ –১৯৪৩) বৃটিশ আমলে মেহেরপুর গড়ের পুকুরে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদ গড়বাড়ীতে 'বাসস্তী মেলা' প্রতিষ্ঠিত হইয়া যেরূপ মহা সমারোহে তাহা সুসম্পন্ন হয়েছিল (উনআশি পর্ব) আমাদের বয়স যখন আট দশ বৎসর মাত্র, সেই সময় গ্রামস্থ প্রধান প্রধান ব্যক্তির উদ্যোগে, বিশেষতঃ স্বর্গীয় শ্রীকৃষ্ণবাবুর আন্তরিক চেষ্টায় গোয়ালা চৌধুরীদের উক্ত গড়বাড়ীতে 'বাসস্তী মেলা' প্রতিষ্ঠিত হইয়া যেরূপ মহা সমারোহে তাহা সুসম্পন্ন হয়-_এই দীর্ঘকাল পরেও তাহা বিস্মৃত হইতে পারি নাই । এখনও স্মরণ আছে এই মেলাক্ষেত্রের উত্তরাংশে একটি বৃহৎ মণ্ডপ নির্মিত হইয়াছিল, এবং কৃষ্ণনগরের শিল্পীরা আসিয়া দ্রৌপদীর বিবাহ-সভার আদর্শে বহু পুত্তলিকা নির্ম্মাণ করিয়াছিল । সভাস্থলে যে বিশাল গ্যালারী নির্মিত হইয়াছিল, তাহার এক দিকে গান্ধার হইতে জলধিসীমা ; ভারতের বিভিন্ন প্রকার রাজ-পরিচ্ছদেও তাহাদের স্ব-স্ব দেশের বিশেষত্ব সূচক শিরক্ত্রাণে মন্ডিত হইয়া শ্রেণীবদ্ধ ভাবে উপবিষ্ট, অন্য দিকে নানা দেশের ব্রাহ্মণ ; তাঁহারা নিমস্ত্রিত হইয়া দ্রৌপদীর স্বয়ংবর দেখিতে আসিয়াছেন । কাহারও মুখ গম্ভীর, কেহ বিস্ময়-বিস্ফারিত-নেত্রে রূপ-লাবণ্যবততী দ্রৌপদীর দিকে চাহিয়া আছেন, গভীর বিস্ময়ে মুখ-বিবর ঈষৎ উন্মুক্ত ; কেহ অর্জুনের মুখের দিকে চাহিয়া বিকট মুখভঙ্গী করিতেছেন, মুখ দেখিলে মনে হয়, তিনি যেন অর্জুনকে লক্ষ্যভেদের চেষ্টা করিতে দেখিয়া মনে মনে বলিতেছেন “এ কি তোমার সাধ্য ? কেন বাপু, লোক হাসাইতে আসিয়াছ ?” গ্যালারীর সম্মুখে সমতলভূমিতে কয়েকটি মূর্তি ;-_ প্রথমেই নীলাভবর্ণ অর্জুনের দীর্ঘদেহ অবনত মুখের প্রতি দর্শকগণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় । অর্জুনের পদপ্রান্তে একটি আধারে জল, তিনি সেই জলে উ্ধস্থিত মৎস্যের প্রতিবিম্ব নিরীক্ষণ করিতেছেন, তাঁহার উভয় বাছু উদ্ধে উৎক্ষিপ্ত, এক হাতে ধনু, অন্য হস্তে “তিনি আকর্ন পূরিয়া' জ্যা আকর্ষণ করিয়া তীর ছারা লক্ষ্যভেদের চেষ্টা করিতেছেন, মুখে গান্তীর্য ও দৃঢ়তা পরিস্ফট, দেখিলেই কবিবর কাশীরাম দাসের সেই বর্ণনাটি মনে পড়ে__ “দেখ দ্বিজ মনসিজ জিনিয়া মূরতি,
পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি । অনুপম, তনুশ্যাম, নীলোৎপল আভা, মুখরুচি, কত শুচি করিয়াছে শোভা ।”-_ইত্যাদি কিছু দূরে পদ্মপলাশনেত্রা, সব্বলিষ্কার ভূষিতা, পষ্টবন্ত্র মণ্ডিতা, অপরূপ রূপলাবণ্যবততী পাঞ্চালী ;-_এক হাতে ফুলের মালা, অন্য হস্তে দধিভাণ্, যেন 'পার্থেরে বরিতে যান দ্রুপদের বালা' | তাহার পশ্চাতে ধৃষ্টদ্যুন্ন, ভগিনীকে সভাস্থলে পরিচালিত করিতেছেন । কাশীরাম দাসের মহাভারত তখন পড়িতে আরস্ভ করিয়াছি, ভ্রৌপদীর স্বয়ংবরের এই দৃশ্য দেখিয়া স্থান, কাল, নিজের অস্তিত্ব পর্য্যস্ত বিস্তৃত হইতাম । পৌরাণিক যুগের এক গৌরবময় দৃশ্য মানস-নেত্রের সম্মুখে উজ্জ্বল হইয়া উঠিত। এই মণ্ডপের বিপরীত দিকে-_দক্ষিণে আর একটি মণ্ডপ ; সেখানেও মৃদ্ময় মূর্তির নানা দৃশ্য । প্রায় পঞ্চানন ছাপান্ন বৎসর পুর্ব্বের কথা-_সকল দৃশ্য ঠিক স্মরণ নাই । এক স্থানে দাবা-খেলার দৃশ্য, দুইজন দাবার, একজন বিকট মুখভঙ্গী করিয়া বড়ে টিপিতেছে, পরিধেয় বস্ত্র ক্লথ, কাছা খুলিয়া গিয়াছে । তাহার প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে ডাবা হুকা, সে গন্তীর ভাবে তামাক টানিতে টানিতে প্রতিযোগীর চাল নিরীক্ষণ করিতেছে; পাশে একজন দর্শক উপবিষ্ট. সে লুন্ধ নেত্রে ইহার দিকে চাহিয়া হাত বাড়াইতেছে, ছ্কাধারীর পশ্চাতে একটি দুষ্ট বালক—সে তাহার সম্মুখোবিষ্ট দাবারুর মাথার সুদীর্ঘ শিখাটি বাঁ হাতের দুই আঙ্গুলে আয়ত্ত করিয়া ডান হাতের কাঁচি দিয়া শিখার মূল স্পর্শ করিয়াছে, বালকের মুখ প্রফুল্ল, চক্ষুতে দু্টুমীপূর্ণ হাসি । এই দৃশ্যের পার্শ্বেই নবীন-এলোকেশীর মুন্ময় মূর্তি । এই সময়ের কিছু দিন পূর্বে তারকেশ্বরের মোহাস্ত মাধব গিরি কর্তৃক এলোকেশী-ধর্ষণের মামলা শেষ হইয়াছিল । গ্রামে গ্রামে এলোকেশী-মোহাস্ত-ঘটিত কাহিনী লোকের মুখে মুখে আলোচিত হইতেছিল। বসন্তমেলায় তাহারই সং | এলোকেশীর স্বামী নবীন ধটী উচাইয়া এলোকেশীকে কাটিতে উদ্যত, এলোকেশী সভয়ে দুই হাত উদ্ধে তুলিয়া মাথা বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছে : পাশে 'তেলী বৌ, বামন পিসী" এবং 'মুক্তকেশী' দাঁড়াইয়া আছে, কেহ আতঙ্কে বিস্ময়ে গালে হাত দিয়া, নারী-হত্যা অপরিহার্য বুঝিয়া দাঁত দিয়া জিভ কাটিতেছে, কেহ নবীনের হাতের ধটী কাড়িয়া লইবার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াইতেছে | নবীনের অঙ্গে ডবল-্রেষ্ট সার্ট, মুখে গৌফ, মাথায় বাঁকা টেরী, চক্ষু হইতে ক্রোধ ফুটিয়া বাহির হইতেছে ।__কিছু দূরে মা্টীর ঘানীগাছ, মাধবগিরি মোহান্ত কয়েদীর জাঙ্গিয়া পড়িয়া কাঠের খড়ম পায়ে দিয়া ঘানী টানিতেছে। ঘানীর এক পাশে একটি নল, সেই নলের নীচে মৃৎকলস | সেই নল দিয়া ঘানীর তেল কলসীতে পড়িতেছে, এই ভাবে কলসীটি সংরক্ষিত । কিছু দূরে আর একটি মণ্ডপের অভ্যন্তরে জগৎ সিংহের সহিত ওসমানের অসি যুদ্ধ চলিতেছে । আহত ওস্মানের জানু দিয়া শোণিতস্তরোত প্রবাহিত হইতেছে; অদূরে নবাব-দুহিতা আয়েষা দাঁড়াইয়া উভয়ের যুদ্ধ-কৌশল নিরীক্ষণ করিতেছে ।__এই দৃশ্য প্রদর্শনের একটু কারণ ছিল । এই মেলায় থিয়েটারের “ষ্টরেজ' বাঁধা হইয়াছিল এবং স্থির হইয়াছিল--সেই রঙ্গমঞ্চে “দুর্গেশনন্দিনী' নাটকাকারে অভিনীত হইবে । কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনীর খ্যাতি তখন পল্লী অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে পবিব্যাপ্ত হয় নাই । এই থিয়েটারের সাহাযো কিছু অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল, এই উদ্দেশো সাধারণের কৌতুহল উদ্রেকের জন্যই এই সং-এর অবতারণা | ইহা দুর্গেশনন্দিনীর অভিনয়ের বিজ্ঞাপন মাত্র । মেলার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইয়াছিল । এই থিয়েটারের জনা মেলার পরাচলকবর্গকে যথেষ্ট অর্থ ব্যায় করিতে হইয়াছিল । কারণ, তাহারা গ্রামস্থ সখের থিয়েটার দ্বারা দর্শকগণকে সস্তুষ্ট করিবার চেষ্টা না করিয়া বায়সাধ্য আয়োজনে প্রবন্ত হইয়াছিলেন । আজকাল যেমন গ্রামে গ্রামে দুই একটি সখের থিয়েটারের দলের এবং লাইব্রেরীর আবির্ভাব হইয়াছে.পঞ্চাশ ষাট বওসর পূর্বে পল্লী অঞ্চলে তাহাদের অভাব ছিল | এই মেলায় যে থিয়েটার হইয়াছিল, তাহাই আদর্শ করিয়া অনেক দিন পরে মেহেরপুরে একটি 'এমেচিয়র থিয়েটারের' প্রতিষ্ঠা হয়, তাহার পূর্বেব এই খেয়াল কাহারও মস্তিষ্কে স্থান পায় নাই । মেহেরপুরের 'বসন্ত মেলা' উপলক্ষে যে থিয়েটারের দল আনীত হইয়াছিল, তাহা অপূর্বব, এবং মেহেরপুরের ন্যায় সুদূর মফঃস্বল পল্লীর পক্ষে তাহা অসাধারণ ব্যাপার । কেবল মুখোযোবাবুদের চেষ্টায় উহা সম্ভবপর হইয়াছিল । আমি পূর্ব্বে জমীদার স্বগীয় বাবু চন্দ্রমোহন মুখোপাধায় মহাশয়ের পরিচয় দিয়াছি । তিনি যে কেবল প্রবল প্রতাপ তেজস্বী জমীদার ছিলেন, এরূপ নহে, কলিকাতার সন্ত্রস্ত সমাজের সহিত তীহার যথেষ্ট সন্ভাব ও আনুগতা ছিল । কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ ধনী স্বীয় আশুতোষ দেব অর্থাৎ 'ছাতুবাবু'র সহিত তাহার বন্ধুত্ব ছিল । বাঙ্গালা ১২৬২ সালের মাঘ মাসে ছাতুবাবুর মুত্যু হয়, চন্দ্রমোহনবাবু তাহার কিছুদিন পরেই প্রাণতাগ করেন : মনে হয়, উভয়েই প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন । সম্ভবতঃ উভয় পরিবারের বন্ধুত্ববন্ধন সুদৃঢ় ছিল | আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় ছাতুবাবুর কনিষ্ঠ দৌহিত্র স্বর্গীয় বাবু শরৎচন্দ্র ঘোষ কলিকাতার খ্যাতনামা অভিনেতা ;কলিকাতায় সখের রঙ্গমঞ্চে তিনি শকুস্তলার ভূমিকা গ্রহণ করিয়া প্রভূত খাতি অর্জন করিয়াছিলেন, এবঃ পরে দুর্গেশনন্দিনীর অভিনয়ে জগংসিংহের ভূমিকা লইয়া অভিনয়ের যে উৎকর্ষ প্রদর্শন করিয়াছিলেন, বঙ্গীয় নাটকাভিনয়ের ইতিহাসে তাঁহার সেই গৌরব চিরস্মরণীয় । শরৎবাবুর সহিত স্বর্গীয় চন্দ্রমোহনবাবুর জোষ্ঠপূত্র স্বগীয় মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বন্ধুত্ব থাকায় তাঁহার অনুরোধে শরৎবাবু মেহেরপুরে আসিতে সম্মত হইয়াছিলেন, এবং সদলে দুর্গম মেহেরপুরে পদার্পণ করিয়া “বাসন্তী মেলা'র 'স্টেজে' দুর্গেশনন্দিনী এবং পরুবিক্রম নাটকের অভিনয় করিয়াছিলেন ।”বৃটিশ আমলের খ্যাতনামা লেখক, দীনেন্দ্রকুমার রায়: গ্রন্থনা:অধ্যক্ষ মহসীন আলী আঙ্গুঁর ,সম্পাদক ও প্রকাশক, মুজিবনগর খবর ডট কম,মেহেরপুর।Slider
দেশ
মেহেরপুর জেলা খবর
মেহেরপুর সদর উপজেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
যাবতীয়
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Home
»
Education
»
Featured
»
others
» ১৮৬৯ –১৯৪৩) মেহেরপুর গড়ের পুকুরে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদ গড়বাড়ীতে 'বাসস্তী মেলা' প্রতিষ্ঠিত হইয়া যেরূপ মহা সমারোহে তাহা সুসম্পন্ন হয়েছিল ( উনআশি পর্ব)
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News
No comments: