১৯৪৭ সালে ১৪ই ও ১৪ই অগাস্ট ভারত আর পাকিস্তানের স্বাধীনতার দুই দিনে কী করছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন? দিল্লিতে এখন যেটা ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন, ব্রিটিশ আমলে সেটারই নাম ছিল 'ভাইসরয়েস হাউস' – গভর্নর জেনারেল বা বড়লাটের নিবাস। ওই ভবনেই ২৬শে জুলাই, ১৯৪৭ সাল, শনিবার একটি বৈঠকে বসেছিলেন ভারতের শেষ ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তার পুরো নামটা অনেক বড়, সঙ্গে রয়েছে লম্বা পদবী। তাই লুই ফ্রান্সিস অ্যালবার্ট ভিক্টর নিকোলাস মাউন্টব্যাটেন, ফার্স্ট আর্ল মাউন্টব্যাটেন অফ বার্মা' – এই পুরো অলংকারিক নামের বদলে তাকে লর্ড মাউন্টব্যাটেনই বলা হতো। সেবছরই ২২শে মার্চ দিল্লিতে পৌঁছানো এবং ২৪ তারিখে গভর্নর জেনারেল হিসেবে আনুষ্ঠানিক অভিষেক হওয়ার পর থেকে রোজই একের পর এক বৈঠক করতে হয়েছে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে। তার কাঁধে যে গুরুদায়িত্ব পড়েছে – ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার দায়িত্ব।
'রিপোর্ট অন দ্য লাস্ট ভাইস-রয়্যালটি, ২২ মার্চ টু ১৫ অগাস্ট ১৯৪৭' নামে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ব্যক্তিগত দিনলিপি ইউনিভার্সিটি অফ সাউথহ্যাম্পটনে সংরক্ষিত রয়েছে 'মাউন্টব্যাটেন পেপার্স' নামে। ১৯৪৭ সালের ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে অন্য অনেক নথির মধ্যে এই বিশেষ দিনলিপিটি ছিল অপ্রকাশিত এক গোপন নথি। ওই দিনলিপির গোড়ার দিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার অভিষেক অনুষ্ঠান নিয়ে লিখেছিলেন, "অভিষেক সমারোহের সুযোগটা আমি কাজে লাগিয়েছিলাম চিরাচরিত একটা প্রথা ভাঙার জন্য। প্রথম ভাষণ – যা আগে শুধুই ভাইসরয়েস হাউসের দরবার হলে উপস্থিত অভ্যাগতদের উদ্দেশে দেওয়া হতো, আমি চেয়েছিলাম তা আরও বেশি সংখ্যক শ্রোতার কাছে পৌঁছক।" "আমি সবাইকে বোঝাতে পেরেছিলাম যে আমি যে পদে আরোহন করতে চলেছি, তা তো অন্য কোনো ভাইসরয়ের মতো নয় – হিজ ম্যাজেস্টি-র সরকার স্থির করে ফেলেছিল যে ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে।" হাতে সময় কম, তাই পদগ্রহণ করার পর থেকেই প্রচুর বৈঠক করতে হয়েছিল বড়লাটকে। যার শুরুটা হয়েছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে পর পর কয়েকদিন বৈঠক, এরপরে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আরও পরে জওহরলাল নেহরু – তালিকাটা লম্বা। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া, কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের মতানৈক্য, প্রশাসনিক ভাগবাটোয়ারা – সবেতেই মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে হত লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে। দেশভাগের খুঁটিনাটি তখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে এটা স্থির হয়ে গিয়েছিল যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে অগাস্টের ১৪ আর ১৫ তারিখে। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান স্বাধীনতা পাবে ১৪ই অগাস্ট, আর ভারতের স্বাধীনতা হবে পরের দিন, ১৫ই অগাস্ট। দুই নতুন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুষ্ঠানেই হাজির থাকতে হবে তাকে। একদিন যেতে হবে করাচীতে, পরের দিন হাজির থাকতে হবে দিল্লিতে। বড়লাটের ওই সফরসূচি চূড়ান্ত হয় ২৬শে জুলাইয়ের বৈঠকে।দিল্লি থেকে করাচী যে কোনো রাষ্ট্রপ্রধানদের সফরসূচির প্রতিটি মিনিট এখনো যেমন আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে রাখা থাকে, কটা বেজে কত মিনিটি কী করবেন সেই ভিভিআইপি, কার সঙ্গে কথা বলবেন, কার সঙ্গে করমর্দন করবেন - লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ওই সফরসূচিও সেরকমভাবেই তৈরি হয়েছিল। ইউনিভার্সিটি অফ সাউথহ্যাম্পটনে সংরক্ষিত 'মাউন্টব্যাটেন পেপার্স'-এর 'এমএস৬২/এমবি/১/ডি/২৯/১৪' নম্বর নথিতে ওই ২৬শে জুলাইয়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত নথিভুক্ত আছে। সেটি অবশ্য টাইপ করে প্রকাশিত হয়েছিল দুদিন পরে, ২৮শে জুলাই। ওই নথিতে দেখা যাচ্ছে ১৩ই অগাস্ট সাড়ে ১২টার দিকে দিল্লিতে দুপুরের খাওয়া সেরে লর্ড মাউন্টব্যাটেন রওনা হবেন পালাম বিমানবন্দরের দিকে, সেখান থেকে তার বিমান ছাড়বে বেলা দেড়টায়। প্রথাগতভাবে স্ত্রী এডুইনা মাউন্টব্যাটেন অবশ্যই থাকবেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় করাচীতে পৌঁছবে তার বিমান। সফরসূচি ছিল পূর্ব নির্ধারিত। কিন্তু করাচীর বিমানবন্দরে নামার পরের দৃশ্য নিজেই বর্ণনা করে গেছেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। যুক্তরাজ্যর রাজকীয় প্রকাশনা দফতর থেকে প্রকাশিত 'দ্য ট্র্যান্সফার অফ পাওয়ার: ১৯৪২ - ৭' সংকলনের দ্বাদশ খণ্ডে রয়েছে 'ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত রিপোর্ট নম্বর ১৭'। লর্ড মাউন্টব্যাটেন লন্ডনে সেই রিপোর্টটি পাঠিয়েছিলেন ১৯৪৭-এর ১৬ই অগাস্ট। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, "আমি করাচীতে বিদায় সফরে গিয়েছিলাম এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের দিনে দিল্লিতে অবিশ্বাস্য দৃশ্যের সাক্ষীও থেকেছি। "পাকিস্তানকে তার যাত্রা শুরুর শুভেচ্ছা আর বিদায় জানাতে আমি আর আমার স্ত্রী ১৩ তারিখ বিমানে চেপে করাচী যাই। বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর পরে রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে বেশ ভালো সংখ্যক উল্লসিত মানুষের ভিড় ছিল। জিন্নাহ নতুন সামরিক সচিব (কর্নেল বার্নি), যিনি আমাদের সঙ্গেই গাড়িতে ছিলেন, তিনি বলছিলেন যে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে জিন্নাহ আসার দিন যত মানুষ স্বাগত জানাতে ভিড় জমিয়েছিলেন, সে তুলনায় এদিনের ভিড়টা বেশি।" "এটা বিশ্বাস করা আমার পক্ষে কঠিন ছিল, তবে আরও দুয়েকটি সূত্র থেকে একই খবর পেয়ে আমি নিশ্চিত হই। বার্নিই আমাকে জানায় যে পরের দিন যে রাষ্ট্রীয় শোভাযাত্রা হবে, সেখানে জিন্নাহর উদ্দেশে বোমা ছোঁড়ার একটা চক্রান্ত ফাঁস হয়েছে," লিখেছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। দিল্লিতে, ২৬শে জুলাইয়ের বৈঠকে চূড়ান্ত হওয়া বড়লাটের সফরসূচি অনুযায়ী রাত সাড়ে আটটায় ডিনারের উল্লেখ আছে। কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার রিপোর্টে লিখেছেন যে সেদিন বিকালে তিনি পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছিলেন। ওই বৈঠকে ১৯৩৫ সালে পাশ হওয়া ভারত আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে পাকিস্তানের অস্তিত্ব অন্তর্ভুক্ত করে যে অধ্যাদেশ জারি করেছিল ব্রিটিশ সরকার, সেটা পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। এরপরে রাজকীয় ডিনারে গিয়েছিলেন লর্ড এবং লেডি মাউন্টব্যাটেন। লন্ডনে পাঠানো তার রিপোর্টে বড়লাট লিখেছিলেন যে ওই ডিনারে ৬০ জন আমন্ত্রিত ছিলেন।আগে থেকে, সেই ২৬শে জুলাইয়ের বৈঠকেই স্থির করা হয়েছিল যে কোনো ভাষণ দেওয়া হবে না সেখানে আর পানীয়ের গ্লাস হাতে তুলে দুবার 'টোস্ট' করে উদযাপন করা হবে–– একবার 'রাজার নামে', একবার নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের নামে। কিন্তু 'টোস্ট'টা বড়লাট করবেন না কি মি. জিন্নাহ, তা ২৬শে জুলাইয়ের বৈঠকে নিশ্চিত হয়নি। লর্ড মাউন্টব্যাটেন লিখছেন যে ওই ব্যাপারটা চূড়ান্ত হয় সন্ধ্যা সাতটায়। সেখানে কোনো ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল না। "যখন দেখলাম যে জিন্নাহ উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে টাইপ করা গোটা ছয়েক পৃষ্ঠা বার করে বক্তৃতা করার জন্য এগোচ্ছেন, আমি বেশ আতঙ্কিতই হয়ে পড়েছিলাম। শেষমেশ অবশ্য রাজার সুস্থতা কামনা করেন তিনি।" "আমি একটা তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দিয়েছিলাম পাকিস্তানের সুস্থতা কামনা করে। ওই ব্যাঙ্কোয়েটের পরে একটা ভোজসভা ছিল। সেখানে প্রায় দেড় হাজার অভ্যাগত হাজির ছিলেন, যাদের মধ্যে পাকিস্তানের গণ্যমান্যরা যেমন ছিলেন, তেমনই কিছু অদ্ভুতদর্শন 'জংলি' মানুষকেও দেখলাম," লিখেছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তার বসার আসন ছিল মিস জিন্নাহ এবং বেগম লিয়াকত আলী খানের মাঝখানে।১৪ই অগাস্ট, করাচী পরের দিন, ১৪ই অগাস্ট পাকিস্তানের সংবিধান সভায় ভাষণ দিয়েছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তার আগে তাকে সকাল নয়টায় 'গভর্নমেন্ট হাউস' থেকে খোলা গাড়িতে চাপিয়ে আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় 'সংবিধান সভা'য়। সেখানেই ব্রিটিশ ইনফ্যান্ট্রি ও রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি গার্ড অফ অনার দেয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে। সংবিধান সভায় কে কোথায় বসবেন, তা নিয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে একটু মতবিরোধ হয় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর। 'ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত রিপোর্ট নম্বর ১৭'-এ লর্ড মাউন্টব্যাটেন লিখেছিলেন, "সংবিধান সভার প্রেসিডেন্ট হিসেবে মূল আসনটিতে বসতে চান জিন্নাহ, তবে আমি ভাইসরয় হিসেবে নিজের অধিকার ছেড়ে দিতে রাজি হইনি। শেষমেশ তিনি হাল ছেড়ে দেন।" সকাল নয়টা দশ মিনিটে ভাষণ দিতে ওঠেন গভর্নর জেনারেল। তার ভাষণের মধ্যেই ছিল যুক্তরাজ্যের রাজার তরফে পাঠানো শুভেচ্ছা বার্তাও। ১৫ মিনিটে তার ভাষণ শেষ হওয়ার পরে সংবিধান সভার প্রেসিডেন্ট, অর্থাৎ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রত্যুত্তরের মধ্যে দিয়েই সেখানকার কার্যক্রম শেষ হয়। সংবিধান সভা ছেড়ে বেরনোর সময়ে রয়্যাল আর্মি ৩১ বার গান স্যালুট জানায় গভর্নর জেনারেলকে আর গার্ড অফ অনার দেয় রয়্যাল এয়ারফোর্স এবং সাত নম্বর বালুচ রেজিমেন্ট ও চার নম্বর রাজস্থান রাইফেলসের সৈনিকরা। এরপরে হুড খোলা গাড়িতে চেপে করাচী শহরের চার মাইল রাস্তা ঘোরার কথা ছিল লর্ড ও লেডি মাউন্টব্যাটেন, মি. এবং মিস জিন্নাহ ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের। প্রথম গাড়িতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও মি. জিন্নাহ, দ্বিতীয় গাড়িতে লেডি মাউন্টব্যাটেন ও মিস জিন্নাহ এবং পাকিস্তানের চিহ্নিত করে দেওয়া মন্ত্রীরা থাকবেন পেছনের গাড়িগুলোয়। সেই শোভাযাত্রায় উৎসাহী জনতার ভিড়ও হয়েছিল। গভর্নমেন্ট হাউস থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে অবশ্য যে ভিড়টা চোখে পড়েছিল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের, সেটা আগের দিন যখন তিনি করাচী পৌঁছিয়েছিলেন, তার থেকে অন্তত দ্বিগুণ ছিল। "পাকিস্তানের মানুষের কাছ থেকে যে অভ্যর্থনা আমরা পেয়েছিলাম, তা বেশ অভাবিত। মিস জিন্নাহ তো বিদায় জানাতে গিয়ে কেঁদেই ফেলেছিলেন আর আমার স্ত্রীকে বেশ অবাক করে দিয়ে তার দুই গাল চুম্বন করেন তিনি। এমনকি কঠোর মনের মানুষ জিন্নাহও আমাদের বিদায় জানানোর সময়ে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন," লিখেছেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। বেলা সাড়ে ১১টায় করাচী থেকে তাদের বিমান আকাশে উড়েছিল, আর দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে এসে নেমেছিলো বেলা সাড়ে তিনটায়। দিল্লিতে ১৪ই অগাস্টের রাত ১২টা ২০, একটা খালি খাম জুলাইয়ের ২৬ তারিখের বৈঠকে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত হয়েছিল, সেখানে ১৫ই অগাস্ট সকাল নয়টা দশ থেকে কর্মসূচি রাখা ছিল। তবে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৬ই অগাস্ট লন্ডনে পাঠানো "ভাইসরয় হিসেবে শেষ রিপোর্ট"-এ লিখেছিলেন যে ১৪ই অগাস্ট দুপুরে করাচী থেকে ফিরে আসার পরে রাত ১২টা বেজে ২০ মিনিটে ভারতের সংবিধান সভার প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তার সঙ্গে দেখা করেন। তারা জানান যে সংবিধান সভার মধ্যরাতের অধিবেশনে তারা ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়েছেন এবং নেতাদের অনুরোধ নিয়ে এসেছেন তারা যে তাকে (লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে) তাদের প্রথম গভর্নর জেনারেল হতে হবে। "আমার স্টাডি রুমে এসে 'রাজেন বাবু' (ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ) এই বার্তাটি আমায় দেওয়ার পরে সংবাদমাধ্যমকে প্রবেশের অধিকার দেওয়া হয় এবং নেহরু বেশ আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে ঘোষণা করেন, 'আমি কি নতুন মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের দফতরের তালিকা আপনার হাতে তুলে দেওয়ার অনুমতি পেতে পারি?' এরপরে তিনি খুব সুচারুভাবে আমাকে উদ্দেশ করে লেখা একটা খাম আমার হাতে তুলে দেন (তারা চলে যাওয়ার পরে ওই খামটি খুলে দেখি যে সেটা ফাঁকা!"১৫ই অগাস্ট, দিল্লি বড়লাটের বর্ণনায়, "১৫ই অগাস্ট দিনটি ছিল আমার জীবনের সবথেকে স্মরণীয় এবং প্রেরণাদায়ক একটি দিন। বেশ কয়েকজন রাজাসহ প্রায় পাঁচশো অতিথি অভ্যাগতর উপস্থিতিতে সকাল সাড়ে আটটায় দরবার হলে শপথ-গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দিনটা শুরু হয়েছিল।" পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী এরপরে "দরবার হলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে 'মহামান্য'রা সংবিধান সভার উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা। প্রথমে রাজকীয় গাড়িতে থাকবেন মহামান্য (লর্ড ও লেডি মাউন্টব্যাটেন), তাদের এডিসি বা দেহরক্ষী। পরের গাড়িতে মি. নেহরু এবং মি. প্যাটেল (জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেল)। যাত্রাপথে সারিবদ্ধভাবে থাকবে ব্রিটিশ ইনফ্যান্ট্রি, রয়্যাল এয়ারফোর্স, ইন্ডিয়ান ইনফ্যান্ট্রি। মহামান্যরা সংবিধান সভায় পৌঁছবেন নয়টা ১৫ মিনিটে।" লর্ড মাউন্টব্যাটেন ওই যাত্রাপথের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, "যত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদেরও কারও স্মরণকালের মধ্যে এরকম ভিড় কেউ দেখেননি। মানুষ যে শুধু ভবনগুলোর ছাদে বা অন্যান্য সুবিধাজনক জায়গায় ভিড় জমিয়েছি তা নয়, এমনভাবে ঘিরে ফেলছিল জনতা যে শেষমেশ তাদের নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল।" সংবিধান সভায় তার ভাষণে লর্ড মাউন্টব্যাটেন রাজার পাঠানো শুভেচ্ছাবার্তাও পড়ে শোনান। 'ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত রিপোর্ট নম্বর ১৭' লর্ড মাউন্টব্যাটেন উল্লেখ করেছেন যে ফেরার সময়ে তিনি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন যে ভিড় ঠেলে বেরবেন কীভাবে! মি. নেহরু ভবনের ছাদে উঠে জনতাকে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন আর তারপরে সভা-ঘরের দরজা খোলা হয়। সামান্য দূরত্ব হেঁটে গাড়ির কাছে পৌঁছতে তাদের প্রায় আধঘণ্টা সময় লেগেছিল। ভিড়ের এতটাই চাপ ছিল যে মিনিট পাঁচেক তারা এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন লিখেছেন, "সাধারণভাবে যেসব স্লোগান শোনা যায়, 'জয় হিন্দ' বা 'মহাত্মা গান্ধী কি জয়', 'পণ্ডিত নেহরু কি জয়'। সেসবের সঙ্গেই অনেকে বেশ আশ্চর্যজনকভাবে স্লোগান দিচ্ছিল 'মাউন্টব্যাটেন কি জয়', 'লেডি মাউন্টব্যাটেন কি জয়' এবং একাধিকবার তো কানে এলো, 'পণ্ডিত মাউন্টব্যাটেন কি জয়' স্লোগানও। "সন্ধ্যা ছয়টায় নতুন জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানানোর জন্য অনুষ্ঠান ছিল। মূল কর্মসূচিতে ছিল এই সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনিয়ন জ্যাক (যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রীয় পতাকা) নামিয়ে নেওয়া হবে।" "তবে আমি নেহরুর সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করি এবং তিনি একমত হন যে এটা এমন একটা দিন, যেদিন তারা চান সবাই খুশি থাকুক। ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে নেওয়ার ফলে ব্রিটিশদের মনে আঘাত লাগতে পারে, তাই তিনি নিশ্চিত করবেন বলে জানান যে অনুষ্ঠানের ওই অংশটা যেন বাদ থাকে। এমনিতেও তো আরও বেশ কিছুদিন নতুন রাষ্ট্রে ইউনিয়ন জ্যাক উড়বেই," লিখেছেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ওই সন্ধ্যার প্যারেড অনুষ্ঠানে ভারতীয় কর্মকর্তাদের দেওয়া হিসাব উল্লেখ করে লর্ড মাউন্টব্যাটেন লিখেছেন প্রায় ছয় লাখ মানুষ হাজির হয়েছিলেন সেখানে। তবে তার নিজের অনুমান জমায়েত হয়েছিল আড়াই লাখের মতো মানুষের। ওই আনন্দ উৎসবের বর্ণনার মধ্যেই ইউনিভার্সিটি অফ সাউথহ্যাম্পটনে সংরক্ষিত 'মাউন্টব্যাটেন পেপার্সে' রয়েছে পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশের ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও সেনা অফিসারদের নিয়মিত টেলিগ্রাম–– প্রতিদিন দাঙ্গায় কোথায় কত মানুষ নিহত হচ্ছেন, কত জায়গায় হামলা হচ্ছে – সেই সব তথ্যের সঙ্গেই থাকছে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার যে দ্রুত অবনতি হচ্ছে, সেই বার্তাও। আর উদ্বাস্তুদের ঢল ততক্ষণে নেমে গেছে রাস্তায় – পাকিস্তান থেকে ভারতে আসার এবং ভারত থেকে পাকিস্তানের দিকে যাওয়ার পথে – ট্রেনে, গরুর গাড়িতে অথবা পায়ে হেঁটেই মানুষ পাড়ি দিতে শুরু করেছেন নতুন রাষ্ট্রের অজানা ঠিকানার উদ্দেশে।র্যাডক্লিফ লাইনের ঘোষণা পরপর দুদিনে দুটি নতুন রাষ্ট্রর জন্ম হয়ে গেল, তবে তখনও পর্যন্ত সিরিল র্যাডক্লিফের দেওয়া প্রতিবেদন দুই দেশের নেতাদের সামনে আনা হয়নি, অর্থাৎ কোন এলাকা কোন দেশ পাবে, সেই ঘোষণা তখনও চূড়ান্ত হয়নি। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে যোগ দেওয়ার জন্য করাচীর উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে লর্ড মাউন্টব্যাটেন সে কথা দুটি পৃথক, অথচ প্রায় একই বয়ানের চিঠিতে জানিয়েছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও জওহরলাল নেহরুকে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১২ই অগাস্ট শেষমেশ জানতে পারেন যে মি. র্যাডক্লিফ দেশভাগের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে উঠতে পারবেন পরের দিন, অর্থাৎ ১৩ই অগাস্ট। যদিও কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে এবং পৃথকভাবে দেশীয় রাজাদের সঙ্গে লর্ড মাউন্টব্যাটেন আগের কয়েক মাসে বহু বৈঠক করেছেন দেশভাগ নিয়ে। তবে সিরিল র্যাডক্লিফ তখনও তার রায় চূড়ান্ত করে উঠতে পারেননি। ১২ তারিখ বিকালে বড়লাটের হাতে চলে এসেছিল বাংলা-ভাগের চূড়ান্ত প্রতিবেদন, কিন্তু তিনি সেটা খুলে দেখার থেকে বিরত ছিলেন। পরের দিনই তাকে রওয়ানা হতে হবে করাচীতে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানের জন্য। তাই মি. জিন্নাহ ও মি. নেহরুকে বড়লাট লিখলেন যে করাচী যাওয়ার আগে যেহেতু তার হাতে মি. র্যাডক্লিফের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পৌঁছবে না, তাই ১৬ই অগাস্ট দিল্লিতে একটি বৈঠক করা যায় কি না, যেখানে এলাকা ভাগাভাগি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। লর্ড মাউন্টব্যাটেন লিখছেন, "আমি নেহরুকে লেখা চিঠিটা সই করার ঠিক আগেই প্যাটেলের একটা চিঠি পাই আমি।" ওই চিঠিতে লেখা হয়েছিল যে চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল যদি পূর্ব বঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়, অর্থাৎ পাকিস্তানের ভাগে চলে যায়, তাহলে র্যাডক্লিফের সিদ্ধান্ত জোরপূর্বক আটকিয়ে দিতে বাধ্য হবে মানুষ এবং সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারও মানুষকেই সমর্থন করতে বাধ্য হবে। দুই স্বাধীনতা দিবসের আনুষ্ঠানিকতার শেষে ১৬ই অগাস্ট দিল্লিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন দুই নতুন রাষ্ট্রের দুই প্রধানমন্ত্রী – জওহরলাল নেহরু ও লিয়াকত আলী খান, বল্লভভাই প্যাটেল, আব্দুর রহমান, মুহাম্মদ আলি। প্রথমে ঘণ্টা তিনেক ধরে দুই দেশের নেতারা নিবিড়ভাবে পড়ে দেখেন র্যাডক্লিফের 'সীমান্ত কমিশন'-এর প্রতিবেদন। তা নিয়ে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বৈঠক চলে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন লিখেছেন, "যদি ব্যাপারটা এত গুরুতর ও দুঃখজনক না হতো,তা নিয়ে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বৈঠক চলে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন লিখেছেন, "যদি ব্যাপারটা এত গুরুতর ও দুঃখজনক না হতো, তাহলে এদের মধ্যে মধ্যে যে রোষানল দেখছিলাম, তা বেশ উপভোগ্যই হতো। কংগ্রেস, লীগ এবং শিখরা – কোনও পক্ষই সন্তুষ্টও হয় নি আবার তারা যেসব সুবিধা পাচ্ছে তার জন্য কৃতজ্ঞও ছিল না। তারা শুধুই অসুবিধার দিকগুলি তুলে ধরে অভিযোগ জানাচ্ছিল। বেশ অনেকক্ষণ ধরে জোরেশোরে অভিযোগ-প্রতি অভিযোগ তোলার পরে তারা সব পক্ষই বুঝতে পারল যে অন্য পক্ষ যেহেতু অসন্তুষ্ট হচ্ছে, তাই তাদের নিশ্চই কিছু না কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে।" খুব সাবধানে সব পক্ষকে বুঝিয়ে শুনিয়ে প্রায় দু ঘণ্টা পরে ঠিক হয় যে র্যাডক্লিফের এলাকা ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তা কার্যকর করতে হবে দ্রুত। পরের দিন, ১৭ই অগাস্ট ভোর পাঁচটায় লর্ড আর লেডি মাউন্টব্যাটেন মুম্বাই রওনা হন। সেদিনই ব্রিটিশ বাহিনীর প্রথম দলটি জাহাজে চেপে ভারত ছেড়ে যুক্তরাজ্যের দিকে রওনা হয় – তাদেরই বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন বড়লাট। সুত্র:তার বসার আসন ছিল মিস জিন্নাহ এবং বেগম লিয়াকত আলী খানের মাঝখানে। বিবিসি বাংলা, গ্রন্থনা:অধ্যক্ষ মহসীন আলী আঙ্গুঁর ,সম্পাদক ও প্রকাশক, মুজিবনগর খবর ডট কম,মেহেরপুর।Slider
দেশ
মেহেরপুর জেলা খবর
মেহেরপুর সদর উপজেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
যাবতীয়
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Home
»
Education
»
Featured
»
lid news
»
world
» ১৯৪৭ সালে ১৪ই ও ১৪ই অগাস্ট ভারত আর পাকিস্তানের স্বাধীনতার দুই দিনে কী করছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন?
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News

No comments: