Sponsor



Slider

দেশ

মেহেরপুর জেলা খবর

মেহেরপুর সদর উপজেলা


গাংনী উপজেলা

মুজিবনগর উপজেলা

ফিচার

খেলা

যাবতীয়

ছবি

ফেসবুকে মুজিবনগর খবর

» » মেহেরপুরের সাহিত্য:দীনেন্দ্রকুমার রায় - পর্ব-২




মেহেরপুরের সাহিত্য:দীনেন্দ্রকুমার রায় (২৬ আগস্ট ১৮৬৯ – ২৭ জুন ১৯৪৩)- খ্যাতনামা লেখক, পত্রিকা সম্পাদক এবং অনুবাদক সেকালের মেহেরপুর- পর্ব-২ -:দীনেন্দ্রকুমার রায় মল্লিকবাবুরা একদিন বিশ্বনাথবাবুর নিমন্ত্রণ পত্র পাইলেন । সে লিখিল, কোজাগর পূর্ণিমার রাত্রিতে সে তাহাদের গৃহে সদলে উপস্থিত হইবে, যদি ইহাতে তাঁহাদের অনিচ্ছা থাকে, তাহা হইলে অমুক মাঠে রাত্রি এক প্রহরের সময় কোন পাইক মারফত তাহাকে দুই হাজার টাকা সেলামী পাঠাইতে হইবে ; সেই টাকা পাইলে সে সদলে সেই স্থান হইতে ফিরিয়া যাইব, নতুবা তীহাদের মঙ্গল নাই। মল্লিকবাবুদের বাড়ীর কত্ত বিশ্বনাথবাবুর এই পত্র পাইয়া প্রমাদ গণিলেন, বিনা-মেঘে তাঁহার মস্তকে বজ্রাঘাত হইল । তিনি প্রাণ ভয়ে ও মানসম্মান নষ্ট হইবার আশঙ্কায় ব্যাকুল হইয়া তাহার নিদ্রাত্যাগ করিলেন, দুগেতিসবের অব্যবহিত পরে নগদ দুই হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়া তাহার নিকট পাঠাইবারও সুবিধা হইল না। প্রভুর অরস্থা দেখিয়া তাঁহার বিশস্ত অনুচর বলরামের হৃদয় সহানুভূতিতে পূর্ণ হইল। তিনি বিশ্বনাথবাবুকে ও তাহার অনুচরগণকে একাক যুদ্ধে পরাস্ত করিয়া ফিরাইবার জন্য তাঁহার অনুমতি প্রার্থনা করিলেন । বলরামের প্রভুভক্তিতে যুদ্ধ হইলেও এই কার্য তাঁহার অসাধ্য মনে করিয়া তিনি বলরামের প্রার্থনা পূর্ণ করিতে কুন্ঠিত হইলেন । কিন্তু বলরাম তাঁহার সংকল্প ত্যাগ করিলেন না ; জমীদারবাবুকে অবশেষে অনিচ্ছার সহিত অনুমতি দিতে হইল । বলরাম ধনুঃশর মাত্র সম্বল করিয়া “রণ পা"য়ের' (একজোড়া সুদীর্ঘ বংশদণ্ড, তাহার গ্রন্থিতে পা রাখিয়া দসূরা দ্রুতবেগে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিত) সাহায্যে মেহেরপুরের প্রায় তিন ক্রোশ দূরবর্তী প্রান্তরে উপস্থিত হইয়া বিশ্বনাথবাবুর প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন । কোজাগর-পূর্ণিমার রাত্রি | রাত্রি এক প্রহরের পূর্বেই সেই প্রাস্তরের সীমা প্রান্তে বিশ্বনাথবাবুর পাক্কীর বেহারাদের কণ্ঠোচ্চারিত হুম্ হুম্ হুক্কা, হুম্ হুম্ হুক্কা”ধবনি বলরামের কর্ণগোচর হইল ; সঙ্গে সঙ্গে তাহার অনুচরবর্গের ভীষণ হুস্কার ।-_-বলরাম চক্ষুর নিমেষে বিশ্বনাথবাবুর পাঙ্কীর বেহারাদের গতিরোধ করিলেন । বিশ্বনাথ ডাকাত বিস্মিতভাবে পাক্কী হইতে নামিয়া তরবারি কোষমুক্ত করিল । বলরামের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিল--তিনি মল্লিকবাবুদের দ্বারবান । বিশ্বনাথ অবজ্জাভরে বলিল, “তোদের জমীদারবাবুকে যে দু'হাজার টাকা সেলামী পাঠাতে লিখেছিলাম-_-তা এনেছিস ?” বলরাম মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “এক পয়সাও আনি নি । আমি বেঁচে থাকতে তুমি আমার মনিবের বাড়ীতে ডাকাতী করবে ? তা হবে না বাবু, তুমি আর তোমার দলের লোক আমার সঙ্গে লড়াই ক'রে আমাকে হঠাও-_-তারপর মেহেরপুরে ডাকাতী করতে যেও ।” বিশ্বনাথ তাচ্ছীল্যভরে বলিল, “তুই ত একটা ফড়িং রে, তোকে সাবাড় করতে কতক্ষণ ? কিন্তু তুই একা, আমরা সকলে মিলে তোকে খুন করবো বিশ্বানাথবাবু সে রকম কাপুরুষ নয় । শুনেছি, তুই ভালো তীরন্দাজ, তোর শক্তির পরিচয় দে ।-_এ দ্যাখ, পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে আকাশে কতকগুলা বুনো হাঁস উড়ে যাচ্ছে, যদি তীর দিয়ে ওদের একটাকে বিধে মাটীতে ফেলতে পারিস, তা হ'লে বুঝবো, তুই সত্যই বাহাদুর ; আমি পরাজয় স্বীকার ক'রে ফিরে যাব । যদি না পারিস, তা হ'লে আজ মেহেরপুরে গিয়ে তোর মনিবের সর্বস্ব লুঠ করবো, কেউ তাকে রক্ষে করতে পারবে না।”বলরাম উধ্বকাশে দৃষ্টিপাত করিলেন । কাজাগরী পূর্ণিমার শুভ্র জ্যোৎস্নালোকে চরাচর প্লাবিত । সেই আলোকে বহুশত গজ উদ্ধে একপাল বুনো হাঁস, যেন গগন-সাগরে সাঁতার দিতেছিল | বলরাম চক্ষুর নিমেষে ধনুকে বাণ জুড়িলেন, উদ্ধে দৃষ্টিপাত করিয়া বাণ ছুঁড়িলেন। দুই মিনিটের মধ্যে একটি হাঁস শরবিদ্ধ-বক্ষে ধরাশায়ী হইল | কয়েক গজ দূরে হাঁসটাকে মাটিতে পড়িয়া পক্ষান্দোলন করিতে দেখিয়া বলরাম তাহা কুড়াইয়া আনিলেন এবং বিশ্বনাথবাবুকে উপহার দিলেন । বিশ্বনাথের অনুচররা বিস্মিত, সকলেই বলরামের লক্ষ্যভেদের কৌশল লক্ষ্য করিয়া নিব্বকি | বিশ্বনাথ বলরামকে আলিঙ্গন করিয়া বলিল, “হ্যাঁ, তুই একটা মানুষ । তোর শক্তির পরিচয় পেয়ে আমি খুশী হয়েছি ! আমার যে কথা, সেই কাজ । এই মাঠ থেকেই আমি ফিরে যাচ্ছি ।”বিশ্বনাথবাবু সদলে প্রত্যাগমন করিল । শুনিয়াছি, জমীদারবাবু কৃতজ্ঞতার মৃল্যস্বরূপ বলরামকে পুরস্কার দানে উদ্যত হইলে বলরাম তাহা প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন । কিন্তু এই ঘটনার কয়েক বগসর পরে একদিন রাত্রিকালে বলরামের অজ্ঞাতসারে আনন্দবিহারীর অঙ্গ হইতে তাঁহার অলঙ্কারাদি অপহূত হইলে প্রভুভক্ত বলরামকেই চোর বলিয়া সকলে সন্দেহ করিয়াছিলেন । এই মিথ্যা অপবাদে বলরাম এরূপ মন্মাহত হইয়াছিলেন যে, তিনি কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া সেই রাত্রিতেই মেহেরপুর ত্যাগ করিলেন । বহুদিন পর্যন্ত কেহ তাঁহার কোন সংবাদ পাইল না । গ্রামবাসীদের অনেকেরই ধারণা হইল, বলরাম মনের দুঃখে আত্মহত্যা করিয়াছেন । বহু বৎসর পরে প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পদার্পণ করিয়া বলরাম মেহেরপুরে প্রত্যাগমন করিলেন, তখন তাঁহার কেশ-বেশ দরবেশের মত। বলরাম সুদীর্ঘকাল তপশ্চর্য্যার ফলে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন ; দেশ বিদেশে ধর্ম্মপ্রচার করিয়া তিনি বহু শিষ্য সংগ্রহ করিয়াছিলেন ; তাহাদের অনেকে তাঁহার সঙ্গে মেহেরপুরে আসিলে ভৈরব নদের তীরে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠিত করিয়া সশিষ্য সেখানে বাস করিতে লাগিলেন । নদতীরবর্তী সেই আশ্রমটি এখনও “দরবেশৈর আখড়া" নামে প্রসিদ্ধ । তাঁহার শিষ্য ও অনুচররা সাধারণতঃ“দরবেশ' নামে পরিচিত । এই সকল দরবেশ ভিক্ষাজীবী | তাহাদের “আখড়ায় স্ত্রীলোকও দেখিতে পাওয়া যায় । বলরামী দরবেশরা "জয় বলরাম চন্দ্র বলিয়া ভিক্ষা প্রার্থনা করে। তাহারা যে ভিক্ষাপাত্র লইয়া ভিক্ষায় বাহির হয়, সেই পাত্র আমাদের পল্লী অঞ্চলে“দরিয়াবাদ নারিকেলের খোল' নামে প্রসিদ্ধ । একালে বলরামী সম্প্রদায়ভুক্ত ভিক্ষুক আর অধিক দেখা যায় না ; এরূপ ভিক্ষাপাত্রও প্রায় অদৃশ্য হইয়াছে । বৎসরান্তে দোলের সময় মেহেরপুরস্থ “দরবেশের আখড়ায়” বলরামের দোল হয় । সেই উপলক্ষে বঙ্গের, বিশেষতঃ উত্তর-বঙ্গের নানা জেলা হইতে বলরামী সম্প্রদায়ভুক্ত উপাসক ও উপাসিকা-বৃন্দের সমাগম হইয়া থাকে | তিনদিন উৎসব স্থায়ী হয় ; একদিন লুচির ফলার, একদিন চিড়ার ফলার, এবং একদিন অন্ন-মহোৎসব হইয়া থাকে | বলরামী সম্প্রদায়ভুক্ত সকল লোক একত্র বসিয়া আহার করে, তাহারা জাতিভেদ মানে না। বলরাম কোন দিন নিজের উপর ঈশ্বরত্বের আরোপ করেন নাই, কিন্তু তাঁহার চেলা ও শিষ্য-সেবকরা তাঁহাকে ভগবানের অবতার বলিয়া বিশ্বাস করে | বলরামের উদ্দেশ্যে তাহারা মস্তক নত করে, কিন্তু অন্য কাহাকেও প্রণাম বা নত মস্তকে অভিবাদন করে না। এইবার পূর্বব-কথার অনুসরণ করিব । বলরাম সিদ্ধিলাভ করিয়া দীর্ঘকাল পরে মেহেরপুরে ফিরিলে এবং শিষ্য ও ভক্তবৃন্দ সহ নদীতীরে “আখড়া' স্থাপিত করিলে মেহেরপুরের সর্বসাধারণ অধিবাসিবর্গের মধ্যে তুমুল আন্দোলন-আলোচনা আরম্ভ হইল | অনেকে, বিশেষতঃ উচ্চবংশীয় ভদ্রলোকরা বলরামকে 'প্রতারক' 'বুজরুক', “ভন্ড' প্রভৃতি শব্দে অলঙ্কৃতি করিতে লাগিলেন । বলরামের শিষ্যরা ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণবদের গ্রাহ্য করে না, তাঁহাদের চরণে মস্তক অবনত করে না; তাহাদের এই স্পদ্ধা কেহই মার্জনা করিতে পারিলেন না । বলরামও তাঁহার শিষ্যদের এই প্রকার অবিনয় ও 'তেজের' কথা নানা প্রকার অতুক্তি ও অলঙ্কারে মণ্ডিত হইয়া গ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্রাহ্মণ ভূ-স্বামী চন্দ্রমোহন বাবুর কর্ণগোচর হইল । চন্দ্রমোহন বাবু একটা নগণ্য হাড়ীর চেলাদের দম্ভের কথা শুনিয়া সক্রোধে বলিলেন, “বটে ! একটা অস্পৃশ্য হাড়ীর চেলাদের এত তেজ !” __বাবুর পারিষদরা চতুগুণ ক্রোধ প্রকাশ করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল, “ধম্মবিতার একবার পরীক্ষা করলেই সব জান্তে পারবেন ; আপনার ছি চরণে এই দুনিয়ার কে মাথা না নোয়ায় ? কার ঘাড়ে তিনটি মাথা যে, আপনাকে প্রেণাম না ক'রে সাম্নে দাঁড়াবে ? কিন্তু বলা হাড়ীর চেলারা মনিষ্যিকে মনিষ্যি জ্ঞান করে না ;_ধন্মার্বতার এর একটা বিহিত না করলে ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণবের আর মান-ইজ্জৎ বজায় থাকে না!” একদিন হঠাৎ ইহা পরীক্ষার অবসর হইল । চন্দ্রমোহণ পথের ধারে তাঁহার বৈঠকখানায় বসিয়াছিলেন-_-সেই সময় বলরামের একটি ভক্ত শিষা লম্বা একটি মার্টীর ভাড় লইয়া সেই পথে কলুবাড়ীতে তেল আনিতে যাইতেছিল । প্রত্যেক পথিক জমীদারবাবুকে বৈঠকখানায় ধূমপানে রত দেখিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া গন্তব্য পথে চলিতে লাগিল, কিন্তু বলরাম-শিষ্য লখা তাঁহাকে দেখিয়াও দেখে নাই, এইভাবে তাঁহার সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেল । এক জন মো-সাহেব লখার ব্যবহারের প্রতি জমীদারবাবুর দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়া চোখ টিপিয়া বলিল, “এসি চেলাটা মাথা উঁচু ক'রে চ'লে যাচ্ছে, ধর্ন্মাবতার যেন ওর কাছে মশা-মাছির টি জমীদারবাবু হুস্কার দিতেই সোনা ও রূপো নামক তাঁহার দুইজন বিশালদেহ অনুচর তাঁহার আদেশ প্রতীক্ষায় করজোড়ে সম্মুখে দাঁড়াইল । কিন্তু জমীদারবাবুকে কোন কথা বলিতে হইল না, তাঁহার মো-সাহেবের ইঙ্গিতে সোনা ও রূপে লখাকে ঘাড় ধরিয়া প্রায় শৃন্যে তুলিয়া বাবুর সম্মুখে হাজির করিল । একজন মো-সাহেব বলিল, “ বেটা, তুমি বলা হাড়ীর চেলা হয়ে কি পীর না কেষ্টো বেষ্টো হয়েছ যে, রাজার সামনে দিয়ে চলে গেলে, পেন্নামটা করতেও তোমার মরজি হলো না ? রাজা, ব্রাহ্মণ, সব তোমার কাছে তুশ্চ ! তুমি ভেবেছো কি ? এক্ষুনি ওর পায়ের কাছে গড় হয়ে দন্ডবত কর ।” লখা-নড়িল না, মাথা নামাইল না ; মাথা উচু করিয়া বলিল, “উনি রাজা, বামুন, সব মানি । কিন্তু ছিরি বলরাম চন্দরের ছিচরণে যে মাথা নুইয়েছি, সে মাথা আর কোথাও নোয়াতে পারবো না-_তা তিনি যে হোন, আর যত বড়ই হোন ।” হঠাৎ বারুদের স্তূপে যেন আগুনের ফুলকি পড়িল । পারিষদের ইঙ্গিতে রূপো ও সোনা লখাকে বৈঠকখানার থামে বাঁধিয়া এরূপ প্রহার করিল যে, তাহার সববঙ্গি ক্ষত-বিক্ষত হইল | তাহার দেহের বিভিন্ন স্থান হইতে রক্ত ঝরিতে লাগিল ; কিন্তু সকলে চেষ্টা করিয়াও ব্রাহ্মণ রাজ চরণে তাহার উন্নত মস্তক অবনত করাইতে পারিল না। অগত্যা জীবম্মৃত অবস্থায় তাহাকে মুক্তিদান করা হইল । লখা রক্তাক্ত দেহে টলিতে টলিতে অতিকষ্টে অদূরবর্তী আখড়ায় ফিরিয়া আসিল এবং বলরামের পদপ্রানস্তে শোনিতাপ্নুত অবসন্ন দেহ প্রসারিত করিয়া বলিল, “ঠাকুর, তোমার ছিরিচরণে যে মাথা নুইয়েছি, সেই মাথা চন্দোর-মোহনের পায়ের কাছে নোয়াতে পারি নি ব'লে তার মোসাহেবগুলার হুকুমে তার পাক-বরকন্দাজ আমার কি দুর্দশা করেছে, দেখ ঠাকুর! আমি ত কোন অপরাধ করিনি, বিনি অপরাধে মেরে আমার হাড় গুড়ো ক'রে দিয়েছে, আঁচড়িয়ে খাম্চিয়ে আমার চামড়া ছিড়ে নিয়েছে ; এই দেখ রক্ত আর ঠেক মানছে না। তোমাকে এই অন্যায়ের বিচার করতে হবে ঠাকুর ! আমি জানি, তুমি সব পারো । তোমার ছিরি মুখ থেকে একটা শাপ বেরুলে ওরা সবাই উড়ে-পুড়ে যাবে, সক্কলে ছাই হয়ে যাবে । তুমি শাপ দিয়ে ওদের ধবংস কর, ঠাকুর ! তোমার ক্ষ্যামোতা ওদের একবার দেখাও, প্রভু বলরামচন্দ্র ! তুমি থাকতে তোমার দাসানুদাসের এত শান্তি ?-_-তোমাকে প্রতিফল দিতেই হবে ঠাকুর !” বলরাম আহত শিষ্যের সব্বা্গে হাত বুলাইয়া মিষ্ট স্বরে বলিলেন, “লখা, তুই নালিশ করছিস্ কাদের নামে ? শিয়াল-কুকুরে কামড়ালে কেউ কি তাদের নামে নালিশ করে ? তুই বলবি, ওরা কি শিয়াল-কুকুর ? ওরা যে মানুষ । কিন্তু আমি ত দেখছি, ওরা মানুষ নয়, ওরা শিয়াল-কুকুর, না হয় বাঘ-ভাল্লুক | মানুষের চেহারার ভিতর থেকে আমি শিয়াল-কুকুরের দাঁত. নখ শিয়াল-ককারর প্রবন্তি- হিংসটে স্বভাব. সবই দেখতে পাচ্ছি । কেবল হাত-পা আর কথা কইবার শক্তি থাকলেই কি তাকে মানুষ বলতে পারি? মানুষের কাজ, মানুষের ধর্ম মানুষকে ভালবাসা, মানুষের দুঃখে কষ্টে কষ্ট বোধ করা, তাদের বিপদে সাহায্য করা, অজ্ঞানকে জ্ঞান দেওয়া, আনন্দ দেওয়া, সদুপদেশ দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে মানুষকে মানুষ করা ; যারা তোকে মেরে হাড় গুড়ো ক'রে দিয়েছে বলছিস্, মানুষের এ সকল গুণ তাদের কারও আছে কি? না লখা, আমার কাছে তুই শিয়াল কুকুরের নামে নালিশ করিসনে । শিয়াল-কুকুরের অপরাধের বিচার করি- সে শক্তি আমার নেই। বিচারের কর্তা ভগবান্ ! আমি তোর সর্ব্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি-তোর ব্যাথা দূর হবে। তুই মনে কোন আক্ষেপ রাখিস নে।” এই বলরাম অস্পৃশ্য, নীচ জাতীয় হাড়ী ! আমাদের জন্মগ্রহণের অল্পকাল পূর্বে বলরাম ইহলোক ত্যাগ করিয়াছিলেন । মৃত্যৃকালে তিনি শিষ্যদের আদেশ করিয়াছিলেন, তাঁহার দেহ সমাহিত বা অগ্নিতে দগ্ধ করা না হয় । তাহা যেন শিয়াল-শকুনির ক্ষুপ্লিবারণের জন্য কোনও নির্জন স্থানে সংরক্ষিত হয় । তাঁহার অস্তিম আদেশ পালিত হইয়াছিল | বহু বগসর পরে তাঁহার আখড়ায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠিত ও অট্টালিকা নির্মিত হইয়াছিল | আখড়ার প্রান্তবর্তী নদীর ঘাটি ইষ্টকবদ্ধ করা হইয়াছিল । উক্ত অট্টালিকায় বলরামের ব্যবহৃত খড়ম, লাঠি, ছত্র এবং শয্যা সংরক্ষিত হইয়াছে । বলরামের ভক্তরা দেশ-দেশাস্তর হইতে এগুলি দেখিতে আসে। ১২৮০ সালে আমার বয়স যখন পাঁচ বৎসর, সেই সময় মাঘমাসের একদিন প্রত্যুষে আমরা মুখুয্যে-পাড়ার বাড়ী ত্যাগ করিয়া “গোয়ালা চৌধুরী'র গড়ের নিকট বড় রাস্তার ধারে গ্রামের সব্বর্পৈক্ষা অধিক প্রকাশ্য স্থলে আমাদের নূতন বাড়ীতে উঠিয়া আসি | সেদিন অতি ভীষণ দুযেগি, দিবারাত্রি অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে পথ-ঘাট প্লাবিত ও কার্দমাক্ত হইয়াছিল । সেইদিন আমাদের নবগৃহে প্রবেশ । এই “গোয়ালা চৌধুরী'র গড়ের কেটি কৌতৃহলোদ্দীপক ইতিহাস আছে; বাঙ্গালায় বর্গির হাঙ্গামার সহিত সেই কাহিনী বিজাড়িত, পরে তাহার আলোচনা করিবার ইচ্ছা রইল। লেখাটি দীনেন্দ্রকুমার রায় রচিত সেকালের স্মৃতি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থনা:অধ্যক্ষ মহসীন আলী আঙ্গুঁর ,সম্পাদক ও প্রকাশক, মুজিবনগর খবর ডট কম,মেহেরপুর।






«
Next
Newer Post
»
Previous
Older Post

No comments:

Leave a Reply