Sponsor



Slider

দেশ

মেহেরপুর জেলা খবর

মেহেরপুর সদর উপজেলা


গাংনী উপজেলা

মুজিবনগর উপজেলা

ফিচার

খেলা

যাবতীয়

ছবি

ফেসবুকে মুজিবনগর খবর

» » মেহেরপুরের সাহিত্য:দীনেন্দ্রকুমার রায় - পর্ব-৪




মেহেরপুরের সাহিত্য:দীনেন্দ্রকুমার রায় (২৬ আগস্ট ১৮৬৯ – ২৭ জুন ১৯৪৩)- খ্যাতনামা লেখক, পত্রিকা সম্পাদক এবং অনুবাদক ------------------------------------------ সেকালের মেহেরপুর- পর্ব-৪ -:দীনেন্দ্রকুমার রায় যে দুইজন বর্গী গড়ের অদূরবর্তী বনের ভিতর ঘুরিতেছিল, তাহারা

সেই ভৃত্যকে দেখিবামাত্র তাহাকে ধরিয়া বাঁধিয়া ফেলিল এবং তাহাকে উৎপীড়িত করিয়া গুপ্ত তথ্য জানিবার চেষ্টা করিল ; কিন্তু বিশ্বস্ত ভূত) শত অত্যাচারেও নিব্বকি রহিল | তখন ক্ষুদ্ধ বগী পদাতিকদ্য় ধৈর্যচ্যুত হইয়া তাহার মুন্ডুচ্ছেদ করিল । অতঃপর কি হইল, সে সম্বন্ধে দুই প্রকার জনরব শুনিতে পাওয়া যায় । একটি জনশ্রুতির জানা এই যে, বর্গী দস্যুদ্ধয় সেই ভূত্যের পরিচ্ছেদ খানাতল্লাস করিয়া পাতালঘরের চাবী দেখিতে পায় এবং পাতালঘরের দ্বার আবিষ্কার করিয়া, সহযোগীবর্গকে ডাকিয়া আনিয়া সদলে পাতালঘরে প্রবেশ করে; তাহারা পাতালঘরের অধিবাসিবর্গকে হত্যা করিয়া তাঁহাদের সর্বস্য লুণ্ঠন করিয়া প্রস্থান করে। দ্বিতীয় জনরবের মর্ম এই যে, প্রহরীকে হত্যা করিয়াই তাহারা সেই স্থান ত্যাগ করে। প্রহরীর মৃত্যুতে পাতালঘরের অধিবাসীরা সেই রুদ্ধগৃহে আবদ্ধ থাকিয়া ক্ষুৎপিপাসায় প্রাণত্যাগ করিলেন । বস্তুতঃ, এ কাল পর্যস্ত পাতালঘরের গুপ্তরহসা ভেদের কোন ব্যবস্থা হয় নাই। যে স্থান খনন করিয়া প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে পাতালঘরের চিহ্ন লক্ষিত হইয়াছিল, সেই স্থান খনন করিলে হয়ত একালেও কোন কোন আবিষ্কার হইতে পারে । শুনিয়াছি, আমার কোন পূর্ববপুরুষ দিনাজপুর অঞ্চল হইতে মেহেরপুর আসিয়া গোয়ালা চৌধুরীকে দেওয়ানী পদে গ্রহণ করেন । তাঁহারা গড়বাড়ীর অদূরে বাসগৃহ নির্ম্মাণ করিয়া সেখানে বাস করিতেছিলেন : কিন্তু বর্গীর হাঙ্গামায় গোয়ালা চৌধুরীরা নির্ববংশ হইলে তাঁহারা মেহেরপুরের প্রায় দুই ক্রোশ দূরবর্তী বসন্তপুর শ্রামে গৃহাদি নির্ম্মাণ করিয়া সেই স্থানেই বাস করিতে আরম্ভ করেন। মেহেরপুরে শাস্তি স্থাপিত হইলে তাঁহারা পুর্ণবার মেহেরপুরে প্রত্যাগমন করেন । তাঁহারা বসস্তপুরের যে স্থানে বাস করিতেন, সেই স্থানে একটি পু্করিণীর শেষ চিহ্ন এখনও দেখিতে পাওয়া যায়; পুষ্করিণীর অদূরে এখনও উচ্চভিটা পড়িয়া আছে, কিন্তু ইষ্টকালয়ের চিহ্নমাত্র নাই, মার্টী খুড়িলে অনেক ইট পাওয়া যায়। গোয়ালা চৌধুরীদের গড়বাড়ী গ্রামের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা প্রকাশ্য স্থানে অবস্থিত ; তাহার উত্তরে কালীবাজার এবং দক্ষিণে বৌ-বাজার | স্কুল, বোডিং, দাতব্য চিকিৎসালয় ও সুবৃহৎ হাসপাতাল, মিউনিসিপাল আফিস, ডাকঘর, কালীবাড়ী ইহার অদূরে সংস্থাপিত ; কিন্তু এই স্থানটি ফাঁকা পড়িয়া আছে, অথচ মেহেরপুরের অলিতে গলিতে নৃতন নৃতন বাড়ী নির্ম্মিত হইতেছে, জমীদার ভয়ানক বাড়িয়া গিয়াছে, কোথাও একটু জমী পড়িয়া থাকিবার যো নাই; আর এই গড়বাড়ীতে গৃহ নির্ম্মাণ করিয়া এরূপ প্রকাশ্য স্থানে কেহই বাস করে না-_দেখিয়া অনেক আগন্তক বিস্ময় প্রকাশ করেন ! শুনিতে পাওয়া যায়, গোয়ালা চৌধুরীরা এখানে নির্ববংশ হওয়ায় গ্রামবাসীদের ধারণা, যে গৃহস্থ পরিবার এই গড়ের সীমার মধ্যে গৃহনির্ন্মাণ করিয়া বাস করিবে, তাহাদের বংশলোপ হইবে । এই গড়ের সীমার মধ্যে এখন স্কুল-সংলগ্ন মুসলমান বোর্ডিং প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে বটে, কিন্ত কোন গৃহস্থের বাসভবন নাই বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না । এই গড়ের সীমার মধ্যে কিছুকাল পূর্বে তিনজন গৃহস্থ প্রচলিত প্রবাদ অগ্রাহ্য করিয়া বাসগৃহ নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন ৷ একজনের মৃত্যু হইলে তাঁহার পুত্ররা বাড়ীঘর বিক্রয় করিয়া স্থানাস্তরে গমন করেন । ডাক-বিভাগের একজন পদস্থ কর্মচারী চাকরী হইতে অবসর-গ্রহণের পর এখানে বাস করিবার অভিপ্রায়ে একটি দ্বিতল অট্টালিকা নির্ম্মাণ করেন; কিন্তু গৃহপ্রবেশের পূর্ব্বেই হঠাৎ তাঁহার মৃত্যু হওয়ায় পতিপ্রাণা পত্নী ও একমাত্র পুত্র এই বাড়ীতে বাস করিবার সঙ্কল্প ত্যাগ করেন । তাঁহাদের ধারণা, এই নিষিদ্ধ ভূমিতে গৃহ নির্ম্মাণ করাতেই তাঁহাদের সুখের সংসারে আগুন লাগিয়া গেল। সেই বাড়ীতে এখন ডাকঘর হইয়াছে । ডাকঘরটি পূর্বে অন্য একটি একতলা বাড়ীতে ছিল । এই গড়ের বাড়ীতে ডাকঘরটি স্থানান্তরিত করিবার জন্য আমি আমার স্বর্গীয় সুহৃদ ডেপুটী-পোষ্ট-মাষ্টার-জেনারেল রমনীমোহন ঘোষ মহাশয়কে যথেষ্ট অনুরোধ করিয়াছিলাম ; ইহাতে আমারও একটু স্বার্থ ছিল, কারণ, উহা আমার বাড়ী হইতে প্রায় দুইশত গজ দুরে অবস্থিত । এই বাড়ীতে ডাকঘর প্রতিষ্ঠিত হইলে পোষ্ট-মাষ্টাররা ইহার দোতলায় বাস করিতে থাকেন, একতলায় ডাকঘর । কিন্তু ইতিপূর্বেব যে কয়েকজন পোষ্ট-মাষ্টার এই বাড়ীতে বাস করিয়াছেন, তাঁহাদের প্রায় সকলেরই পরিবারবর্গের কাহারও না কাহারও প্রাণহানি হইয়াছে; কাহারও পিতা, কাহারও পুত্র, কেহ স্বয়ং প্রাণত্যাগ করিয়াছেন। সৌভাগ্যক্রমে বর্তমান পোষ্ট-মাষ্টার এখনও নিরাপদ আছেন । তৃতীয় অট্টালিকার গৃহস্বামী, তাঁহার স্ত্রী ও পুত্র স্থানান্তরে বাস করিলেও অল্প দিনের মধোই প্রাণত্যাগ করায় তাঁহারা এই বাড়ীর সংস্পর্শ ত্যাগ করিয়া উহা কোন সরকারী কর্মচারীকে ভাড়া দিয়াছেন । কোন গৃহস্থ এই বাড়ী ক্রয় করিত চাহেন নাই । একজন নব্য উকীল এই রিল বালা রান সেখানে বাসগৃহ নির্ম্মাণ করিতে সাহস করেন নাই। আমার স্মরণ আছে, আমাদের বাল্যকালে এখানে গ্রামস্থ জমীদার স্বর্গীয় শ্রীকৃষ্ণ মল্লিক মহাশয়ের প্রমোদ-ভবন ছিল । তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র রায় বাহাদুর শ্রীযুক্ত ইন্দুভূষণ মল্লিক মহাশয় মল্লিক-বংশের অলঙ্কারত্বরূপ, গ্রামস্থ প্রতোক সদনুষ্ঠানেরই তিনি প্রাণম্বরূপ । কিন্তু তাঁহার স্বর্গীয় পিতৃদেব যেরূপ বিলাসী ছিলেন, যেরূপ আড়ম্বরের সহিত বাস করিতেন, একালে তাহা উপকথার বিষয়ীভূত হইয়াছে । আমাদের বয়স যখন আট দশ বৎসর মাত্র, সেই সময় গ্রামস্থ প্রধান প্রধান ব্যক্তির উদ্যোগে, বিশেষতঃ স্বর্গীয় শ্রীকৃষ্ণবাবুর আন্তরিক চেষ্টায় গোয়ালা চৌধুরীদের উক্ত গড়বাড়ীতে 'বাসস্তী মেলা' প্রতিষ্ঠিত হইয়া যেরূপ মহা সমারোহে তাহা সুসম্পন্ন হয়-_এই দীর্ঘকাল পরেও তাহা বিস্মৃত হইতে পারি নাই । এখনও স্মরণ আছে এই মেলাক্ষেত্রের উত্তরাংশে একটি বৃহৎ মণ্ডপ নির্মিত হইয়াছিল, এবং কৃষ্ণনগরের শিল্পীরা আসিয়া দ্রৌপদীর বিবাহ-সভার আদর্শে বহু পুত্তলিকা নির্ম্মাণ করিয়াছিল । সভাস্থলে যে বিশাল গ্যালারী নির্মিত হইয়াছিল, তাহার এক দিকে গান্ধার হইতে জলধিসীমা ; ভারতের বিভিন্ন প্রকার রাজ-পরিচ্ছদেও তাহাদের স্ব-স্ব দেশের বিশেষত্ব সূচক শিরক্ত্রাণে মন্ডিত হইয়া শ্রেণীবদ্ধ ভাবে উপবিষ্ট, অন্য দিকে নানা দেশের ব্রাহ্মণ ; তাঁহারা নিমস্ত্রিত হইয়া দ্রৌপদীর স্বয়ংবর দেখিতে আসিয়াছেন । কাহারও মুখ গম্ভীর, কেহ বিস্ময়-বিস্ফারিত-নেত্রে রূপ-লাবণ্যবততী দ্রৌপদীর দিকে চাহিয়া আছেন, গভীর বিস্ময়ে মুখ-বিবর ঈষৎ উন্মুক্ত ; কেহ অর্জুনের মুখের দিকে চাহিয়া বিকট মুখভঙ্গী করিতেছেন, মুখ দেখিলে মনে হয়, তিনি যেন অর্জুনকে লক্ষ্যভেদের চেষ্টা করিতে দেখিয়া মনে মনে বলিতেছেন “এ কি তোমার সাধ্য ? কেন বাপু, লোক হাসাইতে আসিয়াছ ?” গ্যালারীর সম্মুখে সমতলভূমিতে কয়েকটি মূর্তি ;-_ প্রথমেই নীলাভবর্ণ অর্জুনের দীর্ঘদেহ অবনত মুখের প্রতি দর্শকগণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় । অর্জুনের পদপ্রান্তে একটি আধারে জল, তিনি সেই জলে উ্ধস্থিত মৎস্যের প্রতিবিম্ব নিরীক্ষণ করিতেছেন, তাঁহার উভয় বাছু উদ্ধে উৎক্ষিপ্ত, এক হাতে ধনু, অন্য হস্তে “তিনি আকর্ন পূরিয়া' জ্যা আকর্ষণ করিয়া তীর ছারা লক্ষ্যভেদের চেষ্টা করিতেছেন, মুখে গান্তীর্য ও দৃঢ়তা পরিস্ফট, দেখিলেই কবিবর কাশীরাম দাসের সেই বর্ণনাটি মনে পড়ে__ “দেখ দ্বিজ মনসিজ জিনিয়া মূরতি, পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি । অনুপম, তনুশ্যাম, নীলোৎপল আভা, মুখরুচি, কত শুচি করিয়াছে শোভা ।”-_ইত্যাদি কিছু দূরে পদ্মপলাশনেত্রা, সব্বলিষ্কার ভূষিতা, পষ্টবন্ত্র মণ্ডিতা, অপরূপ রূপলাবণ্যবততী পাঞ্চালী ;-_এক হাতে ফুলের মালা, অন্য হস্তে দধিভাণ্, যেন 'পার্থেরে বরিতে যান দ্রুপদের বালা' | তাহার পশ্চাতে ধৃষ্টদ্যুন্ন, ভগিনীকে সভাস্থলে পরিচালিত করিতেছেন । কাশীরাম দাসের মহাভারত তখন পড়িতে আরস্ভ করিয়াছি, ভ্রৌপদীর স্বয়ংবরের এই দৃশ্য দেখিয়া স্থান, কাল, নিজের অস্তিত্ব পর্য্যস্ত বিস্তৃত হইতাম । পৌরাণিক যুগের এক গৌরবময় দৃশ্য মানস-নেত্রের সম্মুখে উজ্জ্বল হইয়া উঠিত। এই মণ্ডপের বিপরীত দিকে-_দক্ষিণে আর একটি মণ্ডপ ; সেখানেও মৃদ্ময় মূর্তির নানা দৃশ্য । প্রায় পঞ্চানন ছাপান্ন বৎসর পুর্ব্বের কথা-_সকল দৃশ্য ঠিক স্মরণ নাই । এক স্থানে দাবা-খেলার দৃশ্য, দুইজন দাবার, একজন বিকট মুখভঙ্গী করিয়া বড়ে টিপিতেছে, পরিধেয় বস্ত্র ক্লথ, কাছা খুলিয়া গিয়াছে । তাহার প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে ডাবা হুকা, সে গন্তীর ভাবে তামাক টানিতে টানিতে প্রতিযোগীর চাল নিরীক্ষণ করিতেছে; পাশে একজন দর্শক উপবিষ্ট. সে লুন্ধ নেত্রে ইহার দিকে চাহিয়া হাত বাড়াইতেছে, ছ্কাধারীর পশ্চাতে একটি দুষ্ট বালক—সে তাহার সম্মুখোবিষ্ট দাবারুর মাথার সুদীর্ঘ শিখাটি বাঁ হাতের দুই আঙ্গুলে আয়ত্ত করিয়া ডান হাতের কাঁচি দিয়া শিখার মূল স্পর্শ করিয়াছে, বালকের মুখ প্রফুল্ল, চক্ষুতে দু্টুমীপূর্ণ হাসি । এই দৃশ্যের পার্শ্বেই নবীন-এলোকেশীর মুন্ময় মূর্তি । এই সময়ের কিছু দিন পূর্বে তারকেশ্বরের মোহাস্ত মাধব গিরি কর্তৃক এলোকেশী-ধর্ষণের মামলা শেষ হইয়াছিল । গ্রামে গ্রামে এলোকেশী-মোহাস্ত-ঘটিত কাহিনী লোকের মুখে মুখে আলোচিত হইতেছিল। বসন্তমেলায় তাহারই সং | এলোকেশীর স্বামী নবীন ধটী উচাইয়া এলোকেশীকে কাটিতে উদ্যত, এলোকেশী সভয়ে দুই হাত উদ্ধে তুলিয়া মাথা বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছে : পাশে 'তেলী বৌ, বামন পিসী" এবং 'মুক্তকেশী' দাঁড়াইয়া আছে, কেহ আতঙ্কে বিস্ময়ে গালে হাত দিয়া, নারী-হত্যা অপরিহার্য বুঝিয়া দাঁত দিয়া জিভ কাটিতেছে, কেহ নবীনের হাতের ধটী কাড়িয়া লইবার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াইতেছে | নবীনের অঙ্গে ডবল-্রেষ্ট সার্ট, মুখে গৌফ, মাথায় বাঁকা টেরী, চক্ষু হইতে ক্রোধ ফুটিয়া বাহির হইতেছে ।__কিছু দূরে মা্টীর ঘানীগাছ, মাধবগিরি মোহান্ত কয়েদীর জাঙ্গিয়া পড়িয়া কাঠের খড়ম পায়ে দিয়া ঘানী টানিতেছে। ঘানীর এক পাশে একটি নল, সেই নলের নীচে মৃৎকলস | সেই নল দিয়া ঘানীর তেল কলসীতে পড়িতেছে, এই ভাবে কলসীটি সংরক্ষিত । কিছু দূরে আর একটি মণ্ডপের অভ্যন্তরে জগৎ সিংহের সহিত ওসমানের অসি যুদ্ধ চলিতেছে । আহত ওস্মানের জানু দিয়া শোণিতস্তরোত প্রবাহিত হইতেছে; অদূরে নবাব-দুহিতা আয়েষা দাঁড়াইয়া উভয়ের যুদ্ধ-কৌশল নিরীক্ষণ করিতেছে ।__এই দৃশ্য প্রদর্শনের একটু কারণ ছিল । এই মেলায় থিয়েটারের “ষ্টরেজ' বাঁধা হইয়াছিল এবং স্থির হইয়াছিল--সেই রঙ্গমঞ্চে “দুর্গেশনন্দিনী' নাটকাকারে অভিনীত হইবে । কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনীর খ্যাতি তখন পল্লী অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে পবিব্যাপ্ত হয় নাই । এই থিয়েটারের সাহাযো কিছু অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল, এই উদ্দেশো সাধারণের কৌতুহল উদ্রেকের জন্যই এই সং-এর অবতারণা | ইহা দুর্গেশনন্দিনীর অভিনয়ের বিজ্ঞাপন মাত্র । মেলার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইয়াছিল । এই থিয়েটারের জনা মেলার পরাচলকবর্গকে যথেষ্ট অর্থ ব্যায় করিতে হইয়াছিল । কারণ, তাহারা গ্রামস্থ সখের থিয়েটার দ্বারা দর্শকগণকে সস্তুষ্ট করিবার চেষ্টা না করিয়া বায়সাধ্য আয়োজনে প্রবন্ত হইয়াছিলেন । আজকাল যেমন গ্রামে গ্রামে দুই একটি সখের থিয়েটারের দলের এবং লাইব্রেরীর আবির্ভাব হইয়াছে.পঞ্চাশ ষাট বওসর পূর্বে পল্লী অঞ্চলে তাহাদের অভাব ছিল | এই মেলায় যে থিয়েটার হইয়াছিল, তাহাই আদর্শ করিয়া অনেক দিন পরে মেহেরপুরে একটি 'এমেচিয়র থিয়েটারের' প্রতিষ্ঠা হয়, তাহার পূর্বেব এই খেয়াল কাহারও মস্তিষ্কে স্থান পায় নাই । মেহেরপুরের 'বসন্ত মেলা' উপলক্ষে যে থিয়েটারের দল আনীত হইয়াছিল, তাহা অপূর্বব, এবং মেহেরপুরের ন্যায় সুদূর মফঃস্বল পল্লীর পক্ষে তাহা অসাধারণ ব্যাপার । কেবল মুখোযোবাবুদের চেষ্টায় উহা সম্ভবপর হইয়াছিল । আমি পূর্ব্বে জমীদার স্বগীয় বাবু চন্দ্রমোহন মুখোপাধায় মহাশয়ের পরিচয় দিয়াছি । তিনি যে কেবল প্রবল প্রতাপ তেজস্বী জমীদার ছিলেন, এরূপ নহে, কলিকাতার সন্ত্রস্ত সমাজের সহিত তীহার যথেষ্ট সন্ভাব ও আনুগতা ছিল । কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ ধনী স্বীয় আশুতোষ দেব অর্থাৎ 'ছাতুবাবু'র সহিত তাহার বন্ধুত্ব ছিল । বাঙ্গালা ১২৬২ সালের মাঘ মাসে ছাতুবাবুর মুত্যু হয়, চন্দ্রমোহনবাবু তাহার কিছুদিন পরেই প্রাণতাগ করেন : মনে হয়, উভয়েই প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন । সম্ভবতঃ উভয় পরিবারের বন্ধুত্ববন্ধন সুদৃঢ় ছিল | আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় ছাতুবাবুর কনিষ্ঠ দৌহিত্র স্বর্গীয় বাবু শরৎচন্দ্র ঘোষ কলিকাতার খ্যাতনামা অভিনেতা ;কলিকাতায় সখের রঙ্গমঞ্চে তিনি শকুস্তলার ভূমিকা গ্রহণ করিয়া প্রভূত খাতি অর্জন করিয়াছিলেন, এবঃ পরে দুর্গেশনন্দিনীর অভিনয়ে জগংসিংহের ভূমিকা লইয়া অভিনয়ের যে উৎকর্ষ প্রদর্শন করিয়াছিলেন, বঙ্গীয় নাটকাভিনয়ের ইতিহাসে তাঁহার সেই গৌরব চিরস্মরণীয় । শরৎবাবুর সহিত স্বর্গীয় চন্দ্রমোহনবাবুর জোষ্ঠপূত্র স্বগীয় মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বন্ধুত্ব থাকায় তাঁহার অনুরোধে শরৎবাবু মেহেরপুরে আসিতে সম্মত হইয়াছিলেন, এবং সদলে দুর্গম মেহেরপুরে পদার্পণ করিয়া “বাসন্তী মেলা'র 'স্টেজে' দুর্গেশনন্দিনী এবং পরুবিক্রম নাটকের অভিনয় করিয়াছিলেন । কলিকাতা হইতে তখন মেহেরপুবে যাইতে হইলে পূর্ববঙ্গ রেলপথের চুয়াডাঙ্গা ষ্টেশনে নামিয়া, পথের কথা ভাবিয়া দুই চক্ষু কপালে তুলিতে হইত । কারণ, চুয়াডাঙ্গা ষ্টেশন হইতে ৯ ক্রোশ দূরবর্তী মেহেরপুর যাইতে গরুর গাড়ী ভিন্ন অন্য যান-বাহন ছিল না । মধ্যে দুইটি নদী পার হইতে হইত । আমরা চুয়াডাঙ্গায় অপরাহ্ন পাঁচটার সময় কলিকাতাগামী “চাটগাঁ এক্সপ্রেস্' ট্রেন ধরিবার আশায় বেলা ৯টার পূর্বেব গরুর গাড়ীতে উঠিয়া ছৈয়ের ভিতর দীর্ঘদেহ প্রসারিত করিতাম, এবং গরুর গাড়ীর ঝাঁকুনীতে সব্বঙ্গি বেদনাপ্নুত করিয়া পাঁচটার কয়েক মিনিট পূর্বে চুয়াডাঙ্গা ষ্টেশনে উপস্থিত হইতাম ; নদী পার হইতে বিলম্ব হইলে ট্রেনের আশা ত্যাগ করিতে হইত । আর এখন মোটর-বাসের অনুগ্রহে অপরাহ্নে মেহেরপুর ত্যাগ করিয়া সন্ধ্যার পর কলিকাতায় আসিতে পারিতেছি। কিন্তু সেই দুর্দিনে শরত্বাধুর মত মহা সন্ত্রান্ত ব্যক্তি সদলে গরুর গাড়ীতে মেহেরপুর যাইবেন, ইহা আশা করা অন্যায় । এ জন্য মেলা সমিতি বহুব্যয়ে তাঁহাদের জন্য পাক্লীর ব্যবস্থা. করিয়াছিলেন । যেদিন অভিনয় আরম্ভ হইবার কথা. শরত্বাবু ও অন্যানা অভিনেতা তাহার কয়েকদিন পূর্ব্বেই মেহেরপুরে উপস্থিত হইয়া মহেন্দ্রবাবুর আতিথ্য গ্রহণ করেন ; কিন্তু তাঁহারা অধিক দৃশ্যপটাদি সঙ্গে লইয়া যাইতে পারেন নাই, এ জন্য শরৎবাবু স্থানীয় চিত্রশিল্পীর সাহায্যে মেহেরপুরেই কয়েকখানি দৃশাপট অঙ্কিত করাইয়াছিলেন । মহেন্দ্রবাবুর কনিষ্ঠ সহোদরের বৈঠকখানা-বাড়ীতে শরৎ্বাবুর উপদেশে সেই সকল পট অঙ্কিত হইতেছিল । আমরা ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলিয়া দূরে দাঁড়াইয়া অঙ্কন কৌশল নিবীক্ষণ করিতাম, এবং কি গভীর সন্ত্রমের সহিত শরৎবাবুর মৌমামৃর্তির দিকে চাহিয়া থাকিতাম | শরত্বাবু তখন যুবা পুরুষ, তীহার ন্যায় পুরুষ তাহার পূর্বেব আর একজনও দেখিয়াছিলাম কিনা স্মরণ নাই | যাহা হউক, নির্দিষ্ট দিনে রঙ্গমঞ্চে অভিনয় আরম্ভ হইল | টিকিটের মুল্য এক টাকার কম ছিল না : এক একখানি 'রিজার্ভড' আসনের মূল্য পাঁচ টাকা । মহকুমার অধিকাংশ জমীদার এবং পদস্থ রাজকর্মমচারীরা “রিজার্ভড' আসন আঁধকার করিয়াছিলেন : দুই টাকা ও এক টাকা মূল্যের টিকিট এত অধিক বিক্রয় হইয়াছিল যে. দরমার ঘেরের ভিতর তিল ধারণেরও স্থান ছিল না । বারো বৎসরের ন্যুন বয়স্ক বালকরা অদ্ধমূল্যে "হাফ টিকিট' পাইয়াছিল। কাকা আমাকে আট আনা দিয়া টিকিট কিনিয়া দিয়াছিলেন, আমি তাঁহার পাশে বসিয়া অভিনয় দেখিয়াছিলাম । সময় আর কাটে না, একতানিক বাদ্য নীরব হইলে যবনিকা উত্তোলিত হইল । শরৎবাবু মহামূল্য পরিচ্ছদে একটি বৃহৎ ওয়েলারে আরোহণ করিয়া ষ্টেজে প্রবেশ করিলেন । মনে হইল, ইনি সতাই জগৎ সিংহ । কিন্তু বালক আমরা, বিদ্যাদিগ্গিজের অভিনয়েই আমরা অধিক মুগ্ধ হইয়াছিলাম। এই মেলা উপলক্ষে, অর্থের অপবায়ও অল্প হয় নাই । বাবুরা বাই, খেমটা প্রভৃতির অয়োজনে বহু অর্থাবায় করিয়াছিলেন । এই উপলক্ষে কলিকাতা হইতে অনেকগুলি খেমটাওয়ালীর আবির্ভাব হইয়াছিল, বাইজীর সংখ্যাও অল্প ছিল না । সে কালে উচ্চশ্রেণীর পুরুষদের নীতিজ্ঞান একাল অপেক্ষা অল্প ছিল । গভীর রাত্রিতে মেলার আসরে খেমটা আরম্ভ হইলে সুরার স্রোত বহিয়াছিল, ছেলেদের কৌতুহল প্রবল, এক রাত্রিতে কয়েক বন্ধুতে চুরি করিয়া খেমটা দেখিতে গিয়াছিলাম, কিন্তু ধরা পড়িয়া কাকার কাছে যে প্রহার লাভ করিয়াছিলাম, তাহা বহুদিন স্মরণ ছিল । যিনি আগ্রহভরে আমাকে থিয়েটার দেখাইয়া আনিয়াছিলেন, ' খেমটা নাচ দেখিতে যাওয়ায় তিনি কি জন্য আমাকে কঠোর শাস্তি দিলেন, তাহা বুঝিবার মত তখন আমার বয়স হয় নাই, কিস্তু বাবুরা মদ্যপানে বিহূল হইয়া খেমটাওয়ালীদের সঙ্গে প্রকাশ্য আসরে সে অভদ্র রসিকতা করিতেছিলেন, তাহা দেখিয়া আমরা অত্যন্ত লজ্জাবোধ করিয়াছিলাম ৷ মেলাস্থলে নানা প্রকার আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করা হইয়াছি। নাগরদোলা, ঘোড়াবাজি প্রভৃতি আসিয়াছিল । চাষীরা পান চিবাইতে চিবাইতে নাগরদোলায় উঠিয়া পাক খাইতেছিল। দুই তিন জন সমস্বরে গাহিতেছিল-_ “যায় বুজি যৈবনের তরী অকুল তুফানে, মদনেরই ঢেউ নেগেচে রাখতে পারিনে |” এক পয়সায় কুড়ি পাক, কেহ কেহ দুই তিন পয়সার পাক খাইতে লাগিল । কাহারও পাশে পল্লী বারবিলাসিনী । কালো কুচকুচে রং, পায়ে মল, কটিতটে রূপার গো বা চন্দ্রহার, দাঁতে মিসি, হাসিলে মনে হয় টিকায় আগুন ধরিয়াছে ! ত্রিশ বৎসরের গত যৌবনা অভাগিনীর নাকে নোলক ! কপালে টিপ,__কি বিশ্রী চেহারা ! মদনের ঢেউই বটে ! এই শ্রেণীর পতিতাদের জন্য মেলার এক অংশে কুটীর-শ্রেণী নির্মিত হইয়াছিল, তাহাদের প্রত্যেকের নিকট হইতে যথেষ্ট খাজনা আদায় হইত ; সেদিকে গ্রাম্য চাষীদের দলের কী ভীড় ! মেলায় নানা স্থান হইতে দোকানী-পসারী আসিয়াছিল । একদিন এক পয়সা দিয়া কাটামুগ্ডের কথা শুনিতে গিয়াছিলাম | বাড়ীর পাশেই মেলা, শেষ রাত্রিতে নহবতে যে সঙ্গীতালাপ হইত, আধঘুমে তাহা বড় মধুর মনে হইত | সকাল হইতে রাত্রি দশটা পর্যাস্ত জুয়ার আড্ডায় 'তেতাস' ও “কুপন খেলার ধূম-_আর সেই দিকেই পল্লীবিলাসিনীদের 'কোয়াটার' | আমার পিতাঠাকুর মহাশয়ের একটি যুবক বন্ধু তখন কৃঞ্ঠনগর কলেজের প্রতিভাবান ছাত্র, তিনি মুখুয্যে পরিবারের রত্বস্বরূপ ছিলেন ; পরে ত্রান্মধন্্ন অবলম্বন করিয়াছিলেন, এবং কলেজে অধ্যাপনা করিতে করিতে সরকারের বৃত্তি লইয়া বিলাতে কৃষি বিদ্যা শিখিতে গিয়াছিলেন । কৃষ্ণনগরের সুপ্রসিদ্ধ ব্যারিষ্টার মনোমোহন ও লালমোহন ঘোষ ভ্রাতৃদ্য তাঁহাকে সহোদরের মতই স্নেহ করিতেন । তিনি এই মেলায় অর্ধ্যের অপব্যয় ও দুর্নীতির ম্লোত দেখিয়া! অতান্ত অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, এবং গুরুজনের কার্যের প্রতিবাদ করিবার জন্য একখানি ক্ষুদ্র কবিতা-পুস্তক প্রকাশিত করিয়াছিলেন, তাহার "টাইটেল" পৃষ্ঠার উপর হেমবাবুর একটি কবিতার কিয়দংশ “মটো' রূপে উদ্ধৃত হইয়াছিল__ “একদিন অনশনে যদি দিন যায়, জান না কি বঙ্গবাসী কি যাতনা তায় “-_ ইত্যাদি । আমরা ছেলের দল অবশেষে মেলার বিরুদ্ধে তাঁহার সহযোগিত! করিয়াছিলাম । লেখাটি দীনেন্দ্রকুমার রায় রচিত সেকালের স্মৃতি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থনা:অধ্যক্ষ মহসীন আলী আঙ্গুঁর ,সম্পাদক ও প্রকাশক, মুজিবনগর খবর ডট কম,মেহেরপুর।






«
Next
Newer Post
»
Previous
Older Post

No comments:

Leave a Reply